'সম্পূর্ণ' গাজা অবরোধ কি সকল ফিলিস্তিনির বিরুদ্ধেই শাস্তি?
ইসরায়েলে হামাসের অতর্কিত হামলার দুইদিন পর গাজা উপত্যকায় সম্পূর্ণ অবরোধ ঘোষণা করেছে ইসরায়েল সরকার।
হামাসের আক্রমণে অন্তত ৮০০ জন নিহত এবং কয়েক ডজন ইসরায়েলি বন্দী হওয়ার পর এমন ঘোষণা আসে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট সোমবার (৯ অক্টোবর) এক ভিডিও বার্তায় বলেন, "আমরা গাজাকে সম্পূর্ণ অবরোধ করছি … কোনো বিদ্যুৎ, খাবার, পানি, গ্যাস কিছুই থাকবে না– সব বন্ধ।"
ফিলিস্তিনিদেরকে 'বর্বর মানুষ' আখ্যা দিয়ে এই পদক্ষেপের ঘোষণা দেন তিনি।
২.৩ মিলিয়নের বাসস্থান গাজা ছিটমহলের আবাসিক ভবন এবং অফিসগুলোকে লক্ষ্য করে ইসরায়েলি হামলায় পাঁচ শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় তিন হাজার মানুষ আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
গত ১৬ বছর ধরে ইসরায়েলি অবরোধের মধ্যে থাকা গাজায় বিদ্যুৎ, পানি এবং জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করার সিদ্ধান্তকে জাতিসংঘ একটি 'কালেক্টিভ পানিশমেন্ট' বা সকল ফিলিস্তিনির ওপরেই শাস্তিস্বরূপ বলে নিন্দা জানিয়েছে।
এরইমধ্য দিয়ে গাজায় ইসরায়েলের স্থল আক্রমণের সম্ভাবনাও বাড়ছে। হামাসের হামলার পরের দিন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার দেশে 'যুদ্ধের মতো অবস্থা' ঘোষণা করেছেন। দেশবাসীকে হামাসের হামলার কঠিন জবাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
গাজায় ব্যাপক বোমাবর্ষণ
গাজায় ইসরায়েলের পাল্টা হামলার পর এক লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন জাতিসংঘের স্কুলগুলোতে।
হামাসের হামলার প্রতিশোধ নিতে গাজার ভবন, মসজিদ এবং অফিসগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।
এতে রোববার গাজার একটি আবাসিক ভবনে ইসরায়েলের বিমান হামলায় একই পরিবারের ১৯ জন নিহত হন। গাজার জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরও বেশি লোক এখন ইসরায়েলে শরণার্থী হিসেবে রয়েছেন, যারা এর আগে ইসরায়েলের দ্বারাই জাতিগত নিধনের শিকার হন।
গাজা কি ইতোমধ্যেই অবরুদ্ধ নয়?
হামাস গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার এক বছর পর ২০০৭ সাল থেকে গাজাকে স্থল, সমুদ্র এবং আকাশপথে অবরুদ্ধ করে রাখেছে ইসরায়েল। গাজা থেকে ইসরায়েলি সৈন্য ও বসতি স্থাপনকারীদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার প্রায় দুই বছর পর এই ভোট অনুষ্ঠিত হয়।
এই অবরোধের মাধ্যমে গাজা সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইসরায়েলের হাতে।
যদিও ইসরায়েল বলেছে, তারা হামাসের আক্রমণ থেকে তাদের নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য সীমানা অবরুদ্ধ করেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইসরায়েলের এই 'কালেক্টিভ পানিশমেন্ট' আন্তর্জাতিক জেনেভা কনভেনশনকে লঙ্ঘন করে এবং রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন দীর্ঘদিন ধরেই এটিকে অবৈধ বলে আসছে।
১৯৬৭ সাল থেকে অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক মাইকেল লিংক তার ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে বলেন, "আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের ৩৩ নং অনুচ্ছেদ দ্বারা 'কালেক্টিভ পানিশমেন্ট'-কে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখানে কোনো প্রকার ব্যতিক্রমের সুযোগ নেই।"
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গাজার ওপর ইসরায়েলের এই কালেক্টিভ পানিশমেন্ট নীতির ফলে অঞ্চলটিতে ভঙ্গুর অর্থনীতি, বিধ্বস্ত অবকাঠামো সৃষ্টি হয়েছে; সেইসঙ্গে এখানকার সামাজিক পরিষেবা ব্যবস্থাও ব্যাহত হচ্ছে।
যদিও গাজার ওপর অবরোধ আরোপে যুক্তি হিসেবে ইসরায়েল হামসের কাছ থেকে তার নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এনেছে; তবে এই নীতির কারণে গাজার অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, যার ভুক্তভুগী হচ্ছেন সমস্ত গাজাবাসী।
এই প্রথম গাজার বিরুদ্ধে 'কালেক্টিভ পানিশমেন্ট' নীতি ব্যবহার করছে ইসরায়েল?
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এর আগেও গাজায় মানবিক সংকট সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে। এটি এমন একটি কৌশল, যা প্রায়শই ফিলিস্তিনিদের ওপর প্রয়োগ করে থাকে ইসরায়েল। কোনো গোষ্ঠী বা নির্দিষ্ট কোনো ব্যাক্তির করা কাজের শাস্তি ফিলিস্তিনের জনসাধারণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ইসরায়েলের জন্য নতুন কিছু নয়।
লিংক অবশ্য তার প্রতিবেদনে বলেছেন, "কেবল দোষীদেরই তাদের কাজের জন্য শাস্তি দেওয়া যেতে পারে এবং সেটিও অবশ্যই একটি ন্যায্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। নিরপরাধ কাউকে কখনোই অন্যের কাজের জন্য শাস্তি দেওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়।"
এর আগে ফিলিস্তিনিদের ওপর কী ধরনের 'কালেক্টিভ পানিশমেন্ট' ব্যবহার করা হয়েছে?
সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও, ইসরায়েল এর আগে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ভেঙে দিয়েছে, কারফিউ জারি করেছে, রাস্তা অবরোধ করেছে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে, কৃষি জমি এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে।
১৬ বছরের এই অবরোধের প্রভাবে গাজায় বিশ্বের সর্বোচ্চ বেকারত্বের হার তৈরি হয়েছে, যা ৪৫ শতাংশেরও বেশি। জাতিসংঘের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে গাজার বাসিন্দারা দৈনিক মাত্র ১৩ ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ সুবিধা পেয়েছেন। এছাড়া, গাজায় ফিলিস্তিনিদেরও জন্য বিশুদ্ধ পানির তেমন ব্যবস্থা নেই এবং নেই কোনো কার্যকর বিমানবন্দর।