ইসরায়েলের প্রায় অভেদ্য আয়রন ডোমকে যেভাবে ফাঁকি দিয়েছে হামাসের রকেট

শনিবার (৭ অক্টোবর) সকালে আচমকা ইসরায়েল আক্রমণ করে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। এ আক্রমণে হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজা থেকে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ২০ মিনিটের মধ্যে পাঁচ হাজার রকেট ছোড়া হয়। হামাস এ আক্রমণের নাম দিয়েছে অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড। এ আক্রমণের পর গাজায় স্থল ও আকাশপথে পালটা আক্রমণ চালায় ইসরায়েল।
হামাসের রকেট হামলার পর এয়ার রেইড সাইরেনের শব্দে প্রকম্পিত হয় ইসরায়েলের আক্রান্ত এলাকাগুলো। একইসঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে সেরা আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নামে পরিচিত ইসরায়েলের আয়রন ডোম। মাঝ আকাশেই হামাসের ছোড়া রকেট ধ্বংস করে এটি। তবে এবারের হামলা ছিল পুরোদস্তুর নজিরবিহীন।
আয়রন ডোম ব্যবস্থা কী?
ইসরায়েলের বিভিন্ন অংশে মোতায়েন করা আয়রন ডোম হলো ভূমি থেকে আকাশে ক্ষেপণযোগ্য স্বল্পপাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। এটি রকেট হামলা, আর্টিলারি গোলা, ও আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকল (ইউএভি) মোকাবিলায় ব্যবহৃত হয়।
আয়রন ডোমের পাল্লা মোটামুটি ৭০ কিলোমিটার। তিনটি কেন্দ্রীয় অংশ নিয়ে একটি আয়রন ডোম তৈরি হয়। এগুলো হলো: ডিটেকশন অ্যান্ড ট্র্যাকিং, ব্যাটল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ওয়েপন কন্ট্রোল, এবং মিসাইল লঞ্চার। এ ব্যবস্থায় প্রতিটি ইউনিটে ২০টি করে তামির মিসাইল থাকে।
২০১১ সাল থেকে ইসরায়েল আয়রন ডোম ব্যবহার করছে। ২০০৬ সালে লেবানন যুদ্ধের সময় হিজবুল্লাহ কয়েক হাজার রকেট নিক্ষেপ করলে ইসরায়েলের হাফিয়াসহ আরও অনেক স্থানে অনেক ইসরায়েলি নিহত হন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল নিজেদের এ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তৈরি করে।
আয়রন ডোম কীভাবে কাজ করে?
যখন ইসরায়েলের দিকে রকেট ছোড়া হয়, তখন আয়রন ডোমের ডিটেকশন অ্যান্ড ট্র্যাকিং রাডার আগত রকেটের গতিপথ চিহ্নিত করে। এরপর এটি এ তথ্য ওয়েপন কন্ট্রোল সিস্টেমকে জানায়।
তারপর ওয়েপন কন্ট্রোল সিস্টেম দ্রুত ও জটিল হিসাবের মাধ্যমে আগত রকেটের গতিপথ, দ্রুতি ও সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করে।
যদি দেখা যায় রকেটটির সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু কোনো জনবহুল এলাকা বা কৌশলগত স্থাপনা, তখন আয়রন ডোমের তৃতীয় অংশ — মিসাইল লঞ্চার — স্বয়ংক্রিয়ভাবে রকেট লক্ষ্য করে তামির মিসাইল নিক্ষেপ করে। এভাবে আকাশে থাকা অবস্থাতেই রকেট ধ্বংস করে আয়রন ডোম।
এ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি ব্যাটারিতে তিন–চারটি মিসাইল লঞ্চার থাকে। ইসরায়েলের কাছে কমপক্ষে ১০টি ব্যাটারি আছে। আয়রন ডোমের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেম-এর দাবি, আয়রন ডোমের সাফল্যের হার ৯০ শতাংশ এবং এখন পর্যন্ত এটি দুই হাজারের বেশি রকেট ধ্বংস বা প্রতিহত করেছে।
এবার কী হলো?
নিখুঁত এ ব্যবস্থাটি এবার হামাসের মুহুর্মুহু রকেট হামলার সামনে কিছুটা খাবি খেয়েছে। কয়েক বছর ধরেই হামাস আয়রন ডোমের দুর্বলতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। সালভো রকেট হামলা তথা অল্প সময়ের মধ্যে একাধিক রকেট নিক্ষেপের মাধ্যমে তারা এ কাজে বেশ সফলও হয়েছে। এবার হামাস ২০ মিনিটে পাঁচ হাজার রকেট নিক্ষেপ করেছে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে।
হামাস নিজেদের তৈরি রকেট প্রযুক্তির নিয়মিত উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। ইসরায়েলের তেল আবিব ও জেরুজালেমের মতো বড় শহরগুলোতে হামলার জন্য গত কয়েক বছরে এটি নিজেদের রকেটের পাল্লা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।
তামির মিসাইলের তুলনায় হামাসের রকেটগুলো অনেক কম ব্যয়বহুল। তবে আয়রন ডোমের প্রমাণিত সক্ষমতার কারণে ইসরায়েলের কাছে এর খরচ মুখ্য নয়।
২০১২ সালে হামাসের সঙ্গে লড়াইয়ে ইসরায়েল দাবি করেছিল, এটি গাজা উপত্যকা থেকে হামাসের নিক্ষিপ্ত ৪০০টি রকেটের ৮০ শতাংশ প্রতিহত করেছে।
২০১৪ সালের সংঘর্ষে ১৪ দিনে সাড়ে চার হাজারের বেশি রকেট নিক্ষেপ করেছিল হামাস। এর মধ্যে ৮০০টি প্রতিহত এবং ৭৩৫টি রকেট ভূপাতিত করে ইসরায়েল। ওই যাত্রায় আয়রন ডোমের সাফল্যের হার ছিল ৯০ শতাংশ।
আপগ্রেড ও ২০২১-এর হামলা
২০২১ সালে ইসরায়েল জানায় এটি ড্রোন ও মিসাইল প্রতিহত করার জন্য আয়রন ডোম ব্যবস্থাকে সফলভাবে আপগ্রেড করেছে।
২০২১ সালের মে মাসে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের দু সপ্তাহের লড়াইয়ে প্রথম কয়েকদিনে এক হাজারের বেশি রকেট এবং সবমিলিয়ে সাড়ে চার হাজারের বেশি রকেট নিক্ষেপ করা হয়েছিল ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে। ওই সময় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানায়, আয়রন ডোম রকেটের বিরুদ্ধে ৯০ শতাংশ পালটা আঘাতের সাফল্য পেয়েছে।