হামাস কেন ইসরায়েলে আক্রমণ করলো?
১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ বা ইয়োম কিপুর যুদ্ধ যেদিন শুরু হয়, তার ৫০ বছর পূর্তির একদিন পর, শনিবার ইসরায়েলে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ গোষ্ঠী হামাস।
হামাস অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, শনিবার অতর্কিতে সমুদ্র, স্থল ও আকাশপথে (গ্লাইডারের সাহায্যে) হামাসের যোদ্ধারা ইসরায়েলের (দখলকৃত) ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। একইসঙ্গে, বিপুল পরিমাণ রকেট নিক্ষেপ করছে। জবাবে গাজায় ব্যাপক বোমাবর্ষণ করছে ইসরায়েল।
এই সংঘাত ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরায়েলের বড় এক যুদ্ধে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, ইতোমধ্যেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
নেতানিয়াহু বলেন, 'ইসরায়েলের জনগণ, আমরা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি (উই আর অ্যাট ওয়ার)। ...আজ সকালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ও এর জনগণের বিরুদ্ধে খুনে হামলা চালিয়েছে হামাস।'
নজিরবিহীনভাবে পাল্টা হামলা চালাতে তিনি সর্বোচ্চ সংখ্যক রিজার্ভ সেনা তলবের নির্দেশও দেন।
বিস্ফোরক এই অবস্থায় পরিস্থিতি সম্পর্কে যা জেনে রাখা দরকার:
যখন যা হয়েছে–
# হামাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের সামরিক অভিযান 'অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড' শুরু করেছে। শনিবার ভোর সাড়ে ছয়টায় হামাস অভিযান শুরু করে। ২০২১ সালে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে ১১ দিনব্যাপী চলা লড়াইয়ের পর এটিই সবচেয়ে বড় লড়াইয়ের ঘটনা।
# ইতোমধ্যেই পাঁচ হাজার রকেট নিক্ষেপ করার কথা জানিয়েছে হামাস। ইসরায়েলি (দখলকৃত) ভূখণ্ডে হামাস যোদ্ধারা প্রবেশ করার কথা তেল আবিব নিশ্চিত করেছে।
# ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি জানান, হামাস আকাশ, স্থল ও নৌপথে হামলা করেছে।
# ভোর সাড়ে ছয়টার দিকেই রকেটের প্রথম ঝাঁক নিক্ষেপ করা হয়।
# ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, গাজা উপত্যকায় তারা 'অপারেশন আইরন সোর্ডস' নামে সামরিক অভিযান শুরু করেছে।
# সপ্তাহব্যাপী চলমান ইহুদিদের ধর্মীয় উৎসব সুক্কতের শেষদিন– সিমচ্যাত তোরাহ এর দিন সকালে হামাস আক্রমণ শুরু করে।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি পক্ষে হতাহতের সংখ্যা
ইসরায়লের জরুরি সেবাগুলোর বরাত দিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, অন্তত ২২ জন ইসরায়েলি এ হামলায় নিহত হয়েছে। বার্তাসংস্থা রয়টার্স ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে জানায়, তাদের পাঁচ শতাধিক নাগরিক আহত হয়েছে।
বার্তাসংস্থা আনাদলু এজেন্সি জানায়, গাজা উপত্যকার সীমান্তে ইসরায়েলি সেনা ও হামাস যোদ্ধাদের মধ্যে লড়াইয়ে চার ফিলিস্তিনি নিহত এবং আরও পাঁচজন আহত হয়েছেন।
হামাস কেন ইসরায়েলে আক্রমণ করেছে?
হামাসের মুখপাত্র খালেদ কাদুমি আল-জাজিরাকে জানান, গত কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান বর্বরতার জবাব হিসেবে এই সামরিক অভিযান চালানো হচ্ছে।
'আমরা চাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে, গাজায়, আমাদের পবিত্র স্থান আল-আকসায় নৃশংসতা বন্ধ করুক। এ যুদ্ধ শুরুর পেছনের কারণ এসবই'- বলেন তিনি।
হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ বলেছেন, 'পৃথিবীর শেষ দখলদারিত্ব অবসানে আজ সবচেয়ে বড় যুদ্ধের দিন।'
দেইফ বলেন, 'অস্ত্র চালাতে সক্ষম, সবাই হাতে বন্দুক তুলে নিন। আজ সময় এসেছে।'
টেলিগ্রামে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে হামাস পশ্চিম তীরের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের পাশাপাশি সকল আরব ও মুসলিম দেশগুলোকে এই যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ইসরায়েলের সরকার কী বলছে?
গাজার সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসকারী ইসরায়েলি নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়, 'সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হামাস গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে রকেট হামলা শুরু করেছে। সীমান্তের বিভিন্ন স্থান দিয়ে সন্ত্রাসীরা আমাদের ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করেছে। গাজার শাসকগোষ্ঠী হিসেবে এই হামলার দায় হামাসকে বহন করতে হবে। এর পরিণতি ও দায়দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তাবে।'
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতিনিয়াহু বলেন, তার দেশ যে যুদ্ধে জড়িত হয়েছে, তাতে জয়ী হবে।
সামাজিম মাধ্যম এক্স- এ (সাবেক টুইটার) ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট ডেভিড হারজগ লিখেছেন, 'ইসরায়েল এক কঠিন সময়ের সম্মুখীন হয়েছে।'
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেছেন, 'ইসরায়েল এই যুদ্ধে জিতবে। আজ ভোরবেলা ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে চরম ভুল করেছে হামাস। শত্রুর সাথে প্রতিটি স্থানে লড়ছে ইসরায়েলি সেনারা। এই অবস্থায়, আমি দেশের সকল নাগরিকের প্রতি নিরাপত্তা বাহিনীর নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছি।'
যুদ্ধের সর্বশেষ খবরাখবর
গাজার সীমান্ত বেড়ার কাছে সাতটি স্থানে হামাস যোদ্ধাদের সাথে ইসরায়েলি বাহিনীর প্রচণ্ড লড়াই চলছে বলে জানিয়েছে টাইমস অব ইসরায়েল।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে আজ দুপুরে (স্থানীয় সময় বেলা ১টা) এক জরুরি বৈঠকে অংশ নেয় ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা।
এপর্যন্ত আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কী?
ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের মিত্র চেক সরকার 'সন্ত্রাসী হামলা' পরিচালনার জন্য হামাসের নিন্দা জানিয়েছে।
ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটির সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল।
ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, 'ইসরায়েল ও তার জনসংখ্যার বিরুদ্ধে চলমান সন্ত্রাসী হামলার' নিন্দা জানাচ্ছে ফ্রান্স। প্যারিস ইসরায়েলের প্রতি তাদের সম্পূর্ণ সহমর্মিতা রয়েছে বলে জানিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি বলেন, শনিবার ইসলামী গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলে যে অতর্কিত আক্রমণ করেছে আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
# এই সংঘাতের চরম পরিণতির বিষয়ে হুঁশিয়ার করে এক বিবৃতি দিয়েছে মিশর। বিবৃতিতে, বেসামরিক নাগরিকদের বিপদমুক্ত রাখতে সকল পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
# লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ এক বিবৃতিতে জানায়, গাজা পরিস্থিতির দিকে তারা ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখছে, এবং 'ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রেখেছে।'