সব লক্ষণ বসন্তকালীন আক্রমণের? হামলার তীব্রতা বাড়াচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেন
ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ অভিযান অচিরে শুরু হবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা এমন প্রত্যাশা করছেন বসন্তের শুরু থেকেই। গতকাল সোমবার (১ মে) তারই ইঙ্গিত মিলেছে রণাঙ্গনে। রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় পক্ষই জোরালো করেছে আক্রমণের ধার। রুশ সেনারাও নিচ্ছে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান। এরমধ্যেই রাশিয়ায় এক বিস্ফোরণে লাইনচ্যুত হয়েছে একটি সরবরাহ ট্রেন। খবর দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের
ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভ বলেছেন, তার দেশের সামরিক বাহিনী পাল্টা-আক্রমণ অভিযানের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছে। এখন কবে, কোথায় ও কখন তা শুরু হবে সে বিষয়ে কমান্ডাররাই সিদ্ধান্ত নেবেন।
সোমবার দিনের শুরুতেই আকাশপথে ইউক্রেন জুড়ে ব্যাপক হামলা চালায় রাশিয়া। গত চারদিনের মধ্যে যা ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তর আক্রমণের ঘটনা।
মধ্য- ইউক্রেনের পাভলোগ্রাদ শহরে স্কুল ও বসতবাড়িসহ কয়েক ডজন ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান স্থানীয় কর্মকর্তারা। রাজধানী কিয়েভসহ অন্যান্য জনপদেও ভোরের আগে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী জানায়, এসময় তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ১৫টি রাশিয়ান ক্রুজ মিসাইল ভূপাতিত করেছে।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, ইউক্রেনের সামরিক শিল্প অবকাঠামো লক্ষ্য করে দূরপাল্লার ও লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে সক্ষম মিসাইল ছোঁড়া হয়। তবে পাভলোগ্রাদ নগর কর্মকর্তারা দাবি করেন, এতে পাঁচ শিশুসহ অন্তত ৩৪ জন আহত হয়েছেন।
রাশিয়া হামলার তীব্রতা বাড়ালেও, রুশ বাহিনী ইউক্রেনীয় কাউন্টার-অফেন্সিভ মোকাবিলার প্রস্তুতিও নিচ্ছে। ইউক্রেনীয় ও পশ্চিমা কর্মকর্তাদের দাবি, দক্ষিণদিকে প্রতিরোধমূলক অবস্থানে সরে যাচ্ছে রুশ সেনারা।
এদিকে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা সোমবার জানিয়েছে, 'রাশিয়া যে ব্যাপক সামরিক প্রতিরোধ অবকাঠামো গড়ে তুলেছে, গত কয়েক দশকের মধ্যে বিশ্বে আর তেমনটা দেখা যায়নি।' শুধু রণাঙ্গনের সম্মুখভাগেই নয়, 'প্রতিরোধ কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে রাশিয়া-অধিকৃত ভূখণ্ডের অনেক দূর পর্যন্ত'।
ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা এরমধ্যেই হতাহতের নতুন হিসাব দিয়েছেন। তাদের দাবি, শুধু ডিসেম্বরেই ২০ হাজার রুশ সেনা নিহত হয়েছে।
এসময়ে প্রচুর ইউক্রেনীয় সেনাও হতাহত হয়েছে। আসলে গত শীতকালে উভয়পক্ষে ব্যাপক প্রাণহানি হলেও, সে তুলনায় তাদের অগ্রগতি ছিল যৎসামান্য। শীতকালীন লড়াইয়ে শক্তিক্ষয় হওয়া উভয় সেনাবাহিনীই এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এজন্য রাশিয়ার মতোন ইউক্রেনীয় বাহিনীও প্রতিপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। তারা রাশিয়া-অধিকৃত ভূখণ্ডের অনেক ভেতরেও হামলা চালাচ্ছে বলেও জানিয়েছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। এসব হামলার প্রধান লক্ষ্য আসন্ন বৃহৎ লড়াইয়ের আগে রুশ বাহিনীর সক্ষমতাহানি।
সোমবার দিনটি ছিল ঘটনাবহুল। দিনের শেষভাগে ইউক্রেন জানায়, তাদের বিমান শত্রুসেনাদের জমায়েত লক্ষ্য করে ৪ বার হামলা করেছে। এছাড়া, রুশ বাহিনীর অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সমবেত করা হয়েছিল- এমন অবস্থানে তারা রকেট ও কামানের গোলা ছুঁড়েছে। হামলা করা হয় একটি গোলাবারুদের ডিপো ও লজিস্টিকস সেন্টারেও।
ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার একটি সীমান্ত অঞ্চল ব্রিয়ানস্ক। সোমবার রাতে এই অঞ্চলে এক বিস্ফোরণে লাইনচ্যুত হয় একটি মালবাহী ট্রেন। এবিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেই ছিল কিয়েভ।
তবে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ছবি ও ভিডিওতে ট্রেনটিতে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। রাইবার নামক রাশিয়া-সমর্থক একটি ব্লগের পোস্টে দাবি করা হয়, ট্রেনটি কাঠ এবং মোটরকারের তেলের মতো পণ্যবহন করছিল।
রাশিয়ান রেলওয়ে কোম্পানি তাদের এক বিবৃতিতে জানায়, 'প্রবেশাধিকার ছিল না এমন কিছু ব্যক্তি অনুপ্রবেশ করে' লোকোমটিভে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং রেলপথে চলাচল ব্যাহত করে। ব্রিয়ানস্ক অঞ্চলের গভর্নর ম্যাসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামে করা এক পোস্টে 'অজ্ঞাত বিস্ফোরক সরঞ্জামে'র মাধ্যমে হামলা করা হয়েছে বলে জানান। তবে এর জন্য কে দায়ী – সে সম্পর্কে কিছু বলেননি।
সন্দেহের তীর ইউক্রেনের দিকেই। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী রাশিয়ার ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে পরিচালিত হামলার বিষয়ে কখনো স্পষ্ট করে কিছু বলে না। তবে রাশিয়ার যেসব স্থান থেকে ইউক্রেনীয় শহরগুলোয় হামলা করা হচ্ছে, সেগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার অনুমতি দিয়েছে কিয়েভ।
গত সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক নির্দেশনায় সই করেন। ঘোষণা অনুসারে, ইউক্রেনের যেসব এলাকা রাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত, সেখানকার অধিবাসীরা রাশিয়ান পাসপোর্ট না নিলে, তাদের সরিয়ে নেওয়া হবে।
ইউক্রেনের অভিযোগ, অধিকৃত অঞ্চলের বাসিন্দাদের রাশিয়ার নাগরিকত্ব নিতে ক্রেমলিন এভাবে চাপ দিচ্ছে। কীভাবে তারা এই চাপ সামলাবে তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে জেলেনস্কি প্রশাসনে।
তবে ইউক্রেনের মানবাধিকার কমিশনার দিমিত্র লুবিনেৎস, অধিকৃত এলাকায় বসবাসকারী ইউক্রেনীয়দের নিজেদের সুরক্ষার খাতিরে রাশিয়ান পাসপোর্ট নেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, 'পাসপোর্ট নিন, টিকে থাকুন। আমরা দখলীকৃত এলাকা মুক্ত না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন'।
তবে সোমবারেই ভিন্ন বার্তা দেন ইউক্রেনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইরিনা ভার্সচুক। তিনি বলেন, 'রাশিয়ার পাসপোর্ট নেবেন না। দখলদারদের কোনো প্রকার সহযোগিতাও করবেন না'।
তবে মানবাধিকার কমিশনারের সাথে একটি ক্ষেত্রে তার ভাষ্যে মিল ছিল, তিনিও বলেছেন, 'ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর জন্য প্রতীক্ষা করুন'।