যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এড়াতে টিকটকের লড়াই
ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ টিকটক যুক্তরাষ্ট্রে 'প্রাইভেসি ইস্যুতে' নিষেধাজ্ঞায় পড়তে পারে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা। এ অবস্থা চলতে থাকায় এ মাসে হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ কনফারেন্সে প্ল্যাটফর্মটির সিইও শোউ চিউ এ বিষয়ে কোম্পানির অবস্থান তুলে ধরেন। খবর সিএনএন এর।
চিউ আশ্বস্ত করেন, টিকটক কোনো অবস্থাতেই চীন সরকারের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহারকারীদের তথ্য দেবে না। একইসাথে জানান, প্ল্যাটফর্মটি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহারকারীদের তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিতে কার্যকরী উদ্যোগ নিয়েছে।
কনফারেন্সে মোট চারবার শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সিইও বলেন, প্ল্যাটফর্মটির লক্ষ্য ব্যবহারকারীদের সৃজনশীলতায় অনুপ্রেরণা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের আনন্দ দেওয়া।
টিকটকের ওপর মার্কিন সরকারের অভিযোগ অবশ্য পুরনো। সম্প্রতি দেশটির কংগ্রেশনাল কমিটি প্ল্যাটফর্মটির বিরুদ্ধে কন্টেন্টটের মাধ্যমে শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব তৈরির অভিযোগ এনেছে। একইসাথে টিকটকের মালিকানাধীন চীনা তথ্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্সের বিরুদ্ধে মার্কিন ব্যবহারকারীদের তথ্য চীন সরকারের কাছে হস্তান্তরের অভিযোগ করা হয়েছে।
এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডেরাল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে টিকটকের চীনা মালিকদের শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার দাবি উঠেছে। অন্যথায় প্ল্যাটফর্মটি যে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ হতে পারে, তারও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
২০২১ সালে টিকটকের সিইও হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেকটা পর্দার আড়ালেই ছিলেন চিউ। তবে বর্তমান টালমাটাল পরিস্থিতি সামাল দিতে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার ও প্ল্যাটফর্মে ভিডিও বার্তা দিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে দেখা গেছে। চিউয়ের দেওয়া তথ্যমতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী রয়েছে।
ভিডিও বার্তায় চিউ বলেন, "বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক মানুষ টিকটক ব্যবহার করছেন। এখানে তারা কন্টেন্ট বানাচ্ছে, শিখছে, শেয়ার করছে, আনন্দ পাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। তবে কিছু রাজনীতিবিদ টিকটক নিষিদ্ধ করার কথা বলছেন। কিন্তু এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১৫০ মিলিয়ন মানুষ টিকটক ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হবেন।"
টিকটকের পক্ষ থেকে গত সপ্তাহে একটি ডকু-সিরিজ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নিজেদের জীবিকা নির্বাহে কীভাবে টিকটকের ওপর নির্ভরশীল, সেটি তুলে ধরা হয়। একইসাথে সিইও চিউ প্ল্যাটফর্মটিকে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতির জন্য 'অত্যাবশ্যক' বলে অভিহিত করেছেন।
নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার পাশাপাশি টিকটক সিইও যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্যদের সাথেও সাক্ষাৎ করেছেন। চিউ কংগ্রেস সদস্যদের টিকটকের ওয়াশিংটন ডিসির অফিস পরিদর্শনে আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমের স্বচ্ছতা সম্পর্কে অবহিত করার আশ্বাস দিয়েছেন।
অন্যদিকে গবেষণা সংস্থা ওপেনসিক্রেটের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, টিকটকের মালিকানাধীন চীনা তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্স যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের ভেতর নিজেদের পক্ষে জনমত তৈরিতে গতবছর ৫ মিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় করেছে।
ওইয়াশিংটন ভিত্তিক রিসার্চ ও এডভাইজরি ফার্ম গ্লোবাল সাইবার স্ট্রাটেজিসের সিইও জাস্টিস শেরম্যানকে 'প্রজেক্ট টেক্সাস' এর অধীনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ১.৫ বিলিয়ন ডলারের এ প্রজেক্টটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের নিকট টিকটকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তুলে ধরে প্ল্যাটফর্মটির সম্পর্কে বিরোধিতা নিরসনের চেষ্টা করে।
জাস্টিস শেরম্যান বলেন, "টিকটকের জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হুমকি অনেকটা জীবন-মরণের প্রশ্ন। তাই এটি ঠেকাতে প্ল্যাটফর্মটির পক্ষ থেকে যা কিছু করা সম্ভব, তার সবকিছুই করা হচ্ছে।"
এক বিবৃতিতে টিকটকের পক্ষ থেকে মুখপাত্র জামাল ব্রাউন বলেছেন, "মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টিকটকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে তা দেশটির লাখ লাখ মানুষের জীবিকার ওপর আঘাত হানবে। নিষেধাজ্ঞার দাবি তোলা আইনপ্রণেতাদের উচিত সেইসব মানুষদের সাথে সরাসরি কথা বলা যাদের জীবন এই সিদ্ধান্তের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।"
টিকটকের পক্ষ থেকে শিশুদের সুরক্ষায় ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহারকারীদের প্রাইভেসি রক্ষায় গত বছর থেকেই নতুন নতুন পলিসি ও ফিচার যুক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের প্ল্যাটফর্মটির প্রতি আসক্তি কমাতে দৈনিক মাত্র এক ঘণ্টা টিকটক ব্যবহার করতে পারার ফিচার যুক্তের সুবিধা অন্যতম। এছাড়া ঠিক কোন ধরনের কন্টেন্ট প্ল্যাটফর্মজুড়ে বেশি প্রচারিত হয় সে সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য জানানোর একটি ফিচার যুক্ত করেছে টিকটক।
এমনকি মার্কিন সরকারকে সন্তুষ্ট করতে প্ল্যাটফর্মটি তাদের যুক্তরাষ্ট্রের অংশের কার্যক্রম ও তথ্য ভাণ্ডার অন্যদের থেকে পৃথক করেছে। টিকটকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহারকারীদের সকল তথ্য বিশ্বাসযোগ্য 'ওরাকল ক্লাউড প্ল্যাটফর্ম' এ স্থানান্তর করা হয়েছে।
টিকটকের পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়, মানবধিকার বিষয়ে সোচ্চার হতে এবং ইন্টারন্যাশনাল লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের সাথে সমন্বয় করতে কন্টেন্টের কমিউনিটি গাইডলাইনেও নতুনত্ব আনা হয়েছে। এছাড়া টিকটকের ওপর চীন সরকারের যেকোনো হস্তক্ষেপের অভিযোগকে বারবার অস্বীকার করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।
টিকটক সিইও চিউ বলেন, "একটা ভ্রান্ত বিশ্বাস আছে যে, টিকটকের ওপর চীন সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কিংবা টিকটক চীন সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহারকারীদের তথ্য প্রদান করে। এটা একেবারেই অসত্য।"
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের পক্ষে সমর্থন আদায়ে 'টিকটক স্পার্কস গুড' নামের ডকু-সিরিজ মুক্তির মাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। মিসিসিপি'র সাবান প্রস্তুতকারক এক উদ্যোক্তা টিকটক ব্যবহার করে নিজের ব্যবসায় কীভাবে সাফল্য পেয়েছেন সেটি তুলে ধরা হয়েছে সিরিজটির শুরুতে।
পরবর্তীতে একজন মার্কিন শিক্ষককে দেখানো হয় যিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে টিকটকে কন্টেন্ট বানিয়ে শিশুদেরকে পড়াচ্ছেন। ঐ শিক্ষক বলেন, "টিকটকের কারণেই আমি লাখ লাখ পরিবারের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি যারা কিনা তাদের শিশুদের পড়ালেখা শেখাতে চায়।"
অন্যদিকে টিকটকে কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের একটা অংশ সরকারের নিষেধাজ্ঞার যে হুমকি, সেটির বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল গ্রাউন্ডে প্রেস কনফারেন্স করার ঘোষণা দিয়েছে। এমনকি দেশটির বিখ্যাত সব কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের এই প্রেস কনফারেন্সে একত্রিত করার জন্য টিকটকের পক্ষ থেকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে।
টিকটকের পক্ষ থেকে এতসব উদ্যোগ নেওয়ার পরেও এগুলো খুব কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন না শেরম্যান। এ বিশেষজ্ঞ জানান, দেশটির আইনপ্রণেতারা নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারটি নিয়ে খুবই দ্বিধাবিভক্ত। সকলেই যে নিষেধাজ্ঞা চায়, বিষয়টি এমন নয়। কেউ কেউ হয়তো টিকটকের জনসংযোগের উদ্যোগগুলো আমলে নিচ্ছেন। আবার কিছু আইনপ্রণেতা আছেন, যারা টিকটকের এই প্রচেষ্টার পরেও নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে এক চুল পরিমাণও নড়বেন না।
শেরম্যান বলেন, "সত্যি কথা বলতে, বহু আইনপ্রণেতা টিকটকের অবস্থান পরিষ্কার করে লেখা ব্লগ কিংবা অনুষ্ঠিত ইভেন্টগুলোকে পাত্তাই দেবেন না। কেননা তারা শুধু প্ল্যাটফর্মটির ওপর এবং মার্কিন ব্যবহারকারীদের তথ্যের উপর চীন সরকারের নিয়ন্ত্রণ লাভের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাই টিকটককে নিষিদ্ধ করার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই তারা করবেন।"
বাইডেন প্রশাসনের সাবেক উপদেষ্টা প্রযুক্তিবিদ লিন্ডসে গরম্যানও মনে করেন, টিকটকের জনসংযোগ কার্যক্রমগুলো ততোটা ফলপ্রসূ হবেনা। কেননা 'টেক্সাস প্রজেক্ট' এর মাধ্যমে প্ল্যাটফর্মটি নিজেদের প্রাইভেসির পক্ষে যতই প্রচারণা করুক না কেন দিনশেষে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের জন্য একটা ঝুঁকি থেকেই যায়। কেননা চাইলেই খুব সহজে একটি আপডেটের মাধ্যমে টিকটকে থাকা মার্কিন ব্যবহারকারীদের তথ্য হুমকিতে পড়তে পারে।
অন্যদিকে 'প্রাইভেসি ইস্যুতে' টিকটকের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কাছে পূর্বে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল সেটি কংগ্রেসের কাছে অসত্য বলে মনে হয়েছে। এর ফলে মার্কিন সরকারের কাছে টিকটক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিয়ে বিতর্ক এই প্রথম নয়। ২০২১ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের সময়েও দেশটির টিকটক ব্যবহারকারীদের তথ্যর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। ২০২১ সালে গণমাধ্যম বাজফেডের রিপোর্টে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের টিকটক ব্যবহারকারীদের তথ্যভাণ্ডারে বেশ কয়েকবার চীন প্রবেশ করেছে এবং দেশটি চাইলেই আবারও এ তথ্যভাণ্ডারে প্রবেশ করতে পারবে।
অন্যদিকে টিকটকের তৎকালীন একজন নির্বাহী জানান, চীন থেকে টিকটকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহারকারীদের তথ্যে প্রবেশ করার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি সিকিউরিটি টিম নিয়ন্ত্রণ করে। এ ঘটনার পর প্ল্যাটফর্মটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক সমালোচনা হয়। ঐ সময় টিকটক নিষিদ্ধের দাবি উঠলেও পরবর্তীতে সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি।