পাকিস্তানে বন্যা: ধনী দেশগুলো কি কখনো জলবায়ু ক্ষতিপূরণ দেবে?

পাকিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা জলমগ্ন। ভেসে গেছে ক্ষেতের ফসল। প্রাণহানি হাজার ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। বাস্তুচ্যুত প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ। ক্ষয়ক্ষতি, অর্থের অঙ্কে পরিমাপ করলে শত শত কোটি ডলারের; কিন্তু মানবিক দুর্ভোগের মূল্য বিচার করাই দুঃসাধ্য। বন্যার পর ঘনিয়ে আসছে খাদ্যের মহাসংকট। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন দুর্ভিক্ষের। আর বৃষ্টিও হয়েই চলেছে।
এবারের বর্ষায় আগস্ট মাসে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৭০০ শতাংশ বেশি হয়েছে বৃষ্টিপাত। তার ফলে যে বন্যা দেখা দেয়, তাতে আরও বিনাশী শক্তি যোগ করেছে হিমবাহ গলে আসা জলরাশি।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যা পরিস্থিতিকে বহুগুণে মারাত্মক করে তুলেছে জলবায়ু পরিবর্তন।
একারণেই পাকিস্তানের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী- শেরি রহমান আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোকে তাদের গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি তুলেছেন।
তিনি প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, পাকিস্তান বিশ্বের মোট গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের মাত্র ১ শতাংশেরও কম করে– কিন্তু, এরমধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের কাতারে রয়েছে। 'বৈশ্বিক উত্তরের সাথে দক্ষিণের দর কষাকষি ব্যর্থ হচ্ছে, অন্যদিকে ধারণাতীত দ্রুত গতিতে হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন'।
শেরি ন্যায্য দাবি জানালেও, নিজেদের দূষণ ও জলবায়ুতে করা ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ দানে বলতে গেলে কোনো আগ্রহই নেই ধনী দেশগুলোর। তারা যখন উদাসীন, ঠিক সেই মুহূর্তেই বৈরী জলবায়ুর আঘাত শোচনীয় রূপ নিচ্ছে। বন্যা, ক্ষরা, মহামারি– পৃথিবীকে করে তুলছে অস্থিতিশীল। স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের শত শত কোটি জনতা হচ্ছে খাদ্য সংকটের মুখোমুখি।
তাই প্রশ্ন উঠছে, ধনী দেশগুলি এই বাস্তবতায় আর কতদিন উদাসীন থাকতে পারবে? আদৌ কী ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন দেশের সরকার ও অধিকার গোষ্ঠীগুলো তাদের টনক নড়াতে পারবে?
ধনী দেশগুলি কেন ক্ষতিপূরণের বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আয় ও সম্পদ হারাচ্ছে ভুক্তভোগী দেশগুলি, ক্ষয়ক্ষতিও হচ্ছে ব্যাপক– এনিয়ে আজ আর বিতর্ক নেই। জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে এই 'লস অ্যান্ড ড্যামেজ' শব্দযুগলকেই ব্যবহার করছেন জলবায়ু আলোচকরা। এর মাধ্যমে তারা তুলে ধরেন জলবায়ু অভিঘাতের মারাত্মক পরিণতিকে।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক রূপকাঠামো ঘোষণায় ১৬৫ জাতির সম্মতি রয়েছে, কিন্তু এজন্য কে ক্ষতিপূরণ দেবে তা নিয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনও ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অনেকাংশে দায় ছিল এ মতভেদের। সেখানে জলবায়ু ক্ষতিপূরণ কে দেবে–এই প্রশ্নে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক হয়।
২০২০ সাল নাগাদ বার্ষিক ১৪৫ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল শিল্পোন্নত অর্থনীতিগুলি। কিন্তু, তারা সেটি বাস্তবায়ন করেনি। এ ব্যর্থতার জন্য ধনী দেশগুলির কতোটা কড়াভাবে সমালোচনা করা উচিত– জি-২০ ঘোষণায় সে বিষয়েও মতৈক্য হয়নি।
কিন্তু, সে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ ও অর্থায়নের তাগিদ– অনুভব করতে শুরু করছে উন্নয়নশীল দেশগুলি। তবে ঐতিহাসিকভাবে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের ক্ষতিপূরণ নিয়ে এখনও আলোচনা হচ্ছে না।
একদিক থেকে এই বিবেচনা ন্যায্য। কারণ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো সবার আগে শিল্পায়নের যুগে প্রবেশ করা দেশগুলি বিপুল পরিমাণ গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ করেছে। কিন্তু, এটি জলবায়ুর গতিপ্রকৃতি বদলাতে কতখানি ভূমিকা রেখেছে– তা সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করা যায় না।
পাকিস্তানে এবার বর্ষাকালেই হয়েছে অতিবৃষ্টি। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের বর্ষাকালের আবহাওয়া চক্রেরই অংশ। নিঃসন্দেহে এতে জলবায়ু পরিবর্তনের রয়েছে বিশাল ভূমিকা। কিন্তু, উচ্চ নির্গমনকারী কোন ধনী দেশ–এজন্য কতটুকু দায়ী– তা তাদের ঐতিহাসিক নির্গমনের পরিমাণ জানা না থাকলে নির্ধারণ করা যায় না। সে অনুযায়ী, কে কত টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে তার দাবি ওঠানোও অসম্ভব।
জটিলতাটি এড়ানোর উপায়ও আছে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবসায় জড়িত কোম্পানিগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে বিশাল অবদান রেখেছে নিঃসন্দেহে। তাই পুরো দেশের ওপর ক্ষতিপূরণ আরোপ না করে ওই কোম্পানিগুলোকে অনেকাংশে দায়ী করা যেতে পারে।
কিন্তু, যদি কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ও করা হয়, তাহলেও পুরো সমস্যার সমাধান হয় না। তখন প্রশ্ন ওঠে, এই তহবিল কোথায় যাবে? এটা কী ক্ষতিগ্রস্ত দেশের প্রান্তিক ও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সমাজের কাছে পৌঁছাবে? নাকি বেমালুম গায়েব হয়ে যাবে দেশগুলির কেন্দ্রীয় আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার পাকচক্রে? তাছাড়া, চীন ও ভারতের মতো উদীয়মান অর্থনীতির উচ্চ দূষণকারী দেশেরও কি ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিত নয়?
এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আন্তর্জাতিক আদালতকে। কিন্তু, এপর্যন্ত গঠিত হয়নি সর্বজন স্বীকৃত কোনো জলবায়ু বিচার ব্যবস্থা।
জলবায়ু ন্যায্যতার আইনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আইনিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, দেশ বা সংস্থা ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ দেয়। কিন্তু, শুধু ধনী দেশগুলি উন্নয়নশীল দেশকে ক্ষতিপূরণ দিতে থাকলে, দুর্নীতি বা তহবিল অব্যবস্থাপনার কারণে তা তলাবিহিন পাত্রে মণ মণ ঘি ঢালার মতোই নিস্ফল হবে।
আর এসব মিলিয়ে বেশ জটিল ও উত্তেজনাপূর্ণ এক প্রসঙ্গ জলবায়ু ক্ষতিপূরণ। উন্নত বিশ্বকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে– উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশে রয়েছে এ দাবির জনপ্রিয়তা। তাই অনগ্রসর দেশের কিছু নেতা এবং জলবায়ু ন্যায্যতাকামীরা এ দাবি তুললেও, শেষমেষ আইনি জটিলতা এবং ক্ষতিপূরণের সম্ভাব্য পর্বত-প্রমাণ অঙ্ক জড়িত থাকায়; শেষপর্যন্ত তা ধোপে টিকবে না বলেই মনে হয়।
সে তুলনায় আমরা হয়তো দেখব, শিল্পোন্নত দেশেরা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন এবং দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া শক্তিশালী করতে অর্থায়ন বাড়াবে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হচ্ছে, ক্লাইমেট ফাইন্যান্স বা জলবায়ু অর্থায়ন। ক্ষতিপূরণের সাথে এর পার্থক্য হলো– এটি তারা নিজেদের ইচ্ছে অনুসারে দেবে, এখানে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। আর হয়তো সেকারণেই জলবায়ু অর্থায়ন যে পরিমাণে হওয়া দরকার, তার ধারে কাছেও হচ্ছে না বর্তমানে।
ক্ষতিপূরণ নিয়ে অনৈক্য কি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে?
সম্ভাবনা যতই কম থাক, কিছু উন্নয়নশীল দেশ এখন স্রেফ ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ওপর মনোযোগ দিচ্ছে। তুলনামূলক নগণ্য নিঃসরণ করেও বিশাল সম্পদ ও জীবনহানির শিকার হওয়ায়–তাদের এমন দাবি করাটা বোধগম্য বটে। কিন্তু, এই যুক্তি দিলেই আলোচনা ভেস্তে যাবে ধনী দেশের সাথে। তাদের মনোভাব যেমন, তাতে না হবে কোনো চুক্তি বা সমঝোতা।
এখানে মূল সমস্যা হলো, উভয় পক্ষের এই বিপরীত মেরুতে অবস্থানের কারণে অত্যন্ত অপরিহার্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রচেষ্টায় তার কালোছায়া পড়ছে। ক্ষতিপূরণের বিষয়টিকে করা হচ্ছে রাজনৈতিকীকরণ। ফলে জলবায়ুর অবনতি ঠেকাতে যেসব দিকে আশু অগ্রগতি দরকার, সেখানে অগ্রগতি স্থবির হয়ে পড়ছে। আর সেজন্যই জলবায়ু দুর্যোগ কবলিত জনগোষ্ঠীর জন্য তাৎক্ষণিক তহবিল মিলছে না।
আসছে নভেম্বরে মিশরে অনুষ্ঠিত কপ-২৭ জলবায়ু সম্মেলনে উন্নয়নশীল বিশ্বের পক্ষে দাবিদাওয়া তুলবে পাকিস্তান। এই সম্মেলনে জলবায়ু অর্থায়ন ও ক্ষতিপূরণ নিয়ে তীব্র বাদানুবাদ ও কঠোর মতবিনিময় দেখা যাবে বলেই ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থাৎ, চলতি বছরের সম্মেলনটি উত্তেজনাপূর্ণই হবে নিঃসন্দেহে। বিশেষ করে, যখন ইউরোপে চলছে জ্বালানি সংকট, এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের ঘাটতি পূরণে কয়লার মতো অধিক দূষণকারী জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারও বাড়ছে মহাদেশটিতে।
ধনী দেশগুলিও জলবায়ু ক্ষতির বাইরে নয়, আমেরিকা ও ইউরোপে নজিরবিহীন খরা-ই তার প্রমাণ। কিন্তু, তাদের আছে সুবিশাল সম্পদ, যা দিয়ে পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে অন্যদের চেয়ে ভালোভাবে মানিয়ে চলতে পারে এবং বিপর্যয়ের পর ঘুরেও দাঁড়াতে পারে।
কিন্তু, তারপরও ক্ষতিপূরণ নিয়ে আইনি প্রক্রিয়া তৈরি করা উচিত। আর একইসঙ্গে জলবায়ু অর্থায়নকে বহুগুণে বাড়াতে হবে এবং এই বরাদ্দ যেন অপচয় না হয়- তাও নিশ্চিত করতে হবে। এই অর্থায়নকে হতে হবে আশাব্যঞ্জক ও বাস্তবসঙ্গত; নিশ্চিত করতে হবে যাতে প্রতিটি টাকার সুফল পায়–পাকিস্তানে বন্যায় বাস্তুচ্যুত কোটি কোটি মানুষের মতো জলবায়ু দুর্যোগে প্রভাবিত কাঙ্ক্ষিত জনগোষ্ঠী।
- সূত্র: স্ক্রল ডটইন