ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য বিশ্বজুড়ে অস্ত্রের সন্ধান করছে রাশিয়া
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরেও গেল মাসের শেষ দিকে বাণিজ্যিক একটি জাহাজে করে সিরিয়া থেকে যুদ্ধ সরঞ্জাম পৌঁছেছে রাশিয়ায়। ইউরোপীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, 'স্পার্টা ২' নামের ওই জাহাজটি সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে তুরস্কের বসফরাস প্রণালী পার হয়ে গন্তব্যে পৌঁছে। ইউক্রেনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের 'সামরিক অভিযানকে' সমর্থন দিতেই এসব সরঞ্জাম ব্যবহার করা হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম নভোরোসিস্কের কৃষ্ণসাগর বন্দর দিয়ে ইউরোপে কোনো সামরিক অভিযানের জন্য বড় পরিসরে রসদ নিয়ে আসা হলো। ক্রেমলিনের এই অভিযান ষষ্ঠ মাসে পা দিয়েছে।
অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সহায়তা পেয়েছে ইউক্রেন। তাই রাশিয়া হয়তো নিজেদের অনুমানের চেয়ে কিছুটা বেশি ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তবে, অভিযানের সমর্থনে পুতিনের বাহিনীকে অবশ্যই নিজস্ব সম্পদ ও সক্ষমতার ওপর নির্ভর করতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যুক্তরাষ্ট্রের অনুমান, এ পর্যন্ত অন্তত ১০ হাজারেরও বেশি রুশ সেনা নিহত ও আহত হওয়ার পাশাপাশি কয়েক হাজার রুশ সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়েছে।
ইউরোপীয় গোয়েন্দাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন কর্মকর্তা জানান, মার্কিন সরকারের বিশ্বাস, কৃষ্ণ সাগর দিয়ে সামরিক সরঞ্জাম পরিবহনে বাণিজ্যিক জাহাজ ব্যবহার করেছে রাশিয়া।
স্যাটেলাইটে তোলা ছবি ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যানুসারে, গত ১৭ জুলাই থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত স্পার্টা ২ প্রায় নিশ্চিতভাবেই সিরিয়ার তারতুস বন্দর থেকে সামরিক যান নিয়ে এসেছে। যা ব্যবহার করেছে রাশিয়া। কর্মকর্তারা বলছেন, সিরিয়ায় জাহাজটিকে সামরিক যান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে, বসফরাস প্রণালী অতিক্রম করতে দেখা গেছে এবং পরে জাহাজটি নভোরোসিস্কে কমপক্ষে ১১টি যান আনলোড করেছে বলেও দাবি করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
কৃষ্ণসাগর ও বসফরাস প্রণালী ব্যবহার করে রাশিয়ার সামরিক রসদ বহনে দৃশ্যত কোনো বাধা দিচ্ছে না ন্যাটো সদস্য তুরস্ক।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই যুদ্ধজাহাজ চলাচলে প্রণালীটি বন্ধ করতে মন্ট্রেক্স কনভেনশনের আহ্বান জানিয়েছিল তুরস্ক। তবে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে কোনো বাধা নেই এই কনভেনশনে। এই সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছে রাশিয়া। যুদ্ধজাহাজের পরিবর্তে বাণিজ্যিক জাহাজে করে সামরিক সরঞ্জাম বহন করছে দেশটি।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তুর্কি সরকারের ওপর। ইস্যুটি সম্পর্কে অবগত এক তুর্কি কর্মকর্তা বলেন, কোনো বাণিজ্যিক জাহাজকে কেবল তখনই পরীক্ষা করা হয়, যখন জাহাজটি কোনো অন্যায় কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে সন্দেহ থাকে। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে হোয়াইট হাউসের একজন মুখপাত্র মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছেন। বিষয়টি নিয়ে তুর্কি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কথা বলেছে কিনা সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। এদিকে, ক্রেমলিন এবং ওই জাহাজের কোম্পানি (মালিকপক্ষ) ওবোরোনলজিস্টিকাও মন্তব্যের অনুরোধে কোনো সাড়া দেয়নি।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের তত্ত্বাবধানে প্রায় দশকব্যাপী সামরিক আধুনিকীকরণ কর্মসূচির আওতায় অস্ত্রের বিশাল মজুদ তৈরি করেছে রাশিয়া। তবুও মার্কিন এবং ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের ধারণা, ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যাপক সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে রাশিয়ার। এ কারণে মস্কোকে তার কয়েক দশক পুরনো টি-৬২ ট্যাংকসহ অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামের দিকে নজর দিতে হয়েছে।
তবে রাশিয়ার মতো ইউক্রেনের সামরিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব প্রকাশ করা হয়নি। যদিও ধারণা করা যায়, রাশিয়ার মতো বড় শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে নিশ্চিতভাবেই রাশিয়ার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ইউক্রেন। গত ২২ জুলাই ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে হতাহতের সংখ্যা মে এবং জুন মাসে দৈনিক ১০০-২০০ এর চেয়ে অনেক কমে এসেছে; এই সংখ্যা গড়ে প্রায় ৩০-এ নেমে এসেছে। তবে জেলেনস্কির এই দাবি স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
সিরিয়ার বিপর্যস্ত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে রক্ষা করতে ২০১৫ সাল থেকেই সেদেশে সেনা পাঠিয়ে রেখেছেন পুতিন। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই শোইগু ২০১৭ সালে বলেছিলেন, রুশ সামরিক বাহিনী সেখানে ফাইটার জেট, লেজার গাইডেড মিসাইল, ট্যাংক, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং এয়ার-ডিফেন্স সিস্টেমসহ ১৬০ টিরও বেশি অত্যাধুনিক ও উন্নত অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে।
ক্রেমলিন অতিরিক্ত সামরিক সরঞ্জামের সরবরাহ নিশ্চিত করতে এসব জায়গায় সন্ধান চালাতে পারে বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
ইরানের কাছ থেকে ড্রোন কেনার চেষ্টাও করেছে রাশিয়া, গতমাসে এমন দাবি করেছিলেন সিআইএ পরিচালক উইলিয়াম বার্নস। তিনি বলেছিলেন, "আজ রাশিয়ার প্রতিরক্ষা খাত ঘাটতি এবং উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন, এ ঘটনা তারই প্রমাণ দিচ্ছে।"
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা নীতির সম্পর্কে অবগত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে জানান, উত্তর কোরিয়াও রাশিয়ার অস্ত্রশস্ত্রের নতুন যোগানদাতা হয়ে উঠতে পারে। গত মাসে পূর্ব ইউক্রেনের ক্রেমলিন-নিয়ন্ত্রিত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে দেশটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা আরও জানান, দক্ষিণ ইউক্রেনে মোতায়েনের জন্য ক্রিমিয়াতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনা স্থানান্তর করেছে রাশিয়া। ৮০০ থেকে ১,০০০ সৈন্যের কমপক্ষে ৮টি ব্যাটালিয়ন পূর্ব ডনবাস অঞ্চল থেকে সরানো হয়েছে।
এদিকে পেন্টাগন বলছে, ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ইউক্রেনেকে প্রতিরক্ষা সহায়তা হিসেবে ৯.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে তারা। এরমধ্যে সোমবার (৮ আগস্ট) দূরপাল্লার আর্টিলারি যুদ্ধাস্ত্র, অ্যান্টি-ট্যাংক অস্ত্র এবং মেডিকেল যানবাহনের সরবরাহ বাড়াতে ১ বিলিয়ন ডলার ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য ন্যাটো মিত্রদের কাছ থেকে আরও কয়েক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র পেয়েছে কিয়েভ সরকার।
এদিকে, ইউক্রেনীয় বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত দূরপাল্লার আর্টিলারি 'হিমার্স' ব্যবহার করছে যুদ্ধের ময়দানে। এই অস্ত্র মূলত রাশিয়ার সরবরাহ চেইনের মূল অবকাঠামো এবং গোলাবারুদের গুদামকে লক্ষ্য করেই ব্যবহার করা হচ্ছে। যাতে রাশিয়ার সক্ষমতা দ্রুতই দুর্বল হয়ে পড়ে।
সোমবার পেন্টাগনের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিষয়ক সচিব কলিন কাহল দাবি করেন, যুদ্ধে এ পর্যন্ত ৮০ হাজার রুশ সেনা নিহত বা আহত হয়েছেন। এছাড়া, সংঘাতে সামরিক সরঞ্জামের দিক দিয়েও রাশিয়া ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে আকাশপথে এবং সমুদ্রে চলে এমন ক্ষেপণাস্ত্র এবং প্রায় ৪ হাজার ট্যাংকসহ অন্যান্য সাঁজোয়া যান।
মার্কিন কর্মকর্তাদের ধারণা, এরপরও এপর্যন্ত ইউক্রেনে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করেননি পুতিন, কারণ এটি করলে যুদ্ধের ব্যাপক ব্যয়ের দিকে আঙ্গুল তুলতে পারে রুশ জনগণ। তবে আঞ্চলিক কর্মকর্তারা স্বল্পমেয়াদী চুক্তিতে স্বেচ্ছাসেবকদের উৎসাহিত করতে নগদ অর্থ দিচ্ছেন। এছাড়া, গেল মে মাসে রাশিয়ার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ সেনাবাহিনীর চাকরির ক্ষেত্রে বয়সসীমা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সেইসঙ্গে রুশ সরকার অভ্যন্তরীণভাবে অস্ত্র উৎপাদনের দিকেও মনোযোগী হয়েছে।
তবে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি, এতসব চেষ্টার পরেও পূর্ব ইউক্রেনে সুবিধাজনক অবস্থানে নেই রাশিয়া। ওই অঞ্চলে অত্যন্ত সীমিত এবং ধীরগতিতে এগোচ্ছে রুশ বাহিনী।
মস্কোর হাই স্কুল অফ ইকোনমিক্সের রুশ সমরবিদ ভ্যাসিলি কাশিন বলেন, রাশিয়ার সক্ষমতাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তবে সেইসঙ্গে তিনি উত্তর কোরিয়ার দূরপাল্লার মাল্টি-লঞ্চ রকেট সিস্টেমের কথা উল্লেখ করে বলেন, রাশিয়ার কাছে যা আছে, তারচেয়ে বেশি শক্তিশালি এগুলো। তাই অস্ত্র আমদানি এক্ষেত্রে বেশি যুক্তিযুক্ত।
"যুদ্ধের ময়দানে অবশ্যই কিছু সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে রাশিয়া, কিন্তু আমরা এখনও পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ পাইনি যে, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অস্ত্র আমদানি করেছে দেশটি। তবে এটি করলে রাশিয়ার লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে", যোগ করেন তিনি।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ