শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ভবনে মানুষের হুল্লোড়, পিকনিক, ঘুম, পিয়ানো বাজানোর আসর
শ্রীলঙ্কার ঔপনিবেশিক আমলের প্রেসিডেন্ট ভবনটি ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আচাহে। কিন্তু রোববার বিক্ষুব্ধ জনস্রোতের সামনে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া পালিয়ে যাওয়ার পর ভবনটি হয়ে উঠেছে দ্বীপরাষ্ট্রটির 'জনশক্তির' প্রতীক।
শনিবার শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের সুদৃশ্য, আলিশান বাসভবনের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ নারী, পুরুষ, শিশু। দলে দলে ঢুকেছিলেন ভেতরে। অজস্র মানুষ গোতাবায়া রাজাপাকসের চেয়ারে বসার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। আবার অজস্র শিশু বাবা-মায়ের সঙ্গে নিচতলায় একটি গ্র্যান্ড পিয়ানো বাজাতে লেগে যায়।
আবার গদি আঁটা সোফায় গা এলিয়ে দেন কয়েকজন। সেখানেই চলে খোশ গল্প। তার সঙ্গে সেলফি তোলার পর্বও চলে পুরোদমে।
এদিকে একজন আবার এক টুকরো কাপড় ধরেও টানাটানি শুরু করেন। তার দাবি, এটা প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের অন্তর্বাস। তবে শুধু প্রেসিডেন্টের বাসভবনেই নয়, প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতেও ঢুকে পড়েছিলেন অনেকেই। সেখানকার ভিডিও সামনে এসেছে এবার।
অপর এক ভিডিওতে দেখা যায় প্রেসিডেন্সিয়াল কনফারেন্স রুমে আইএমএফের নকল মিটিং বসেছে। আর সেই ছবি দেখে হাসি চেপে রাখতে পারেননি আমজনতা।
প্রেসিডেন্ট ভবনের মনোহর 'গর্ডন গার্ডেন' পার্কে হাসি-আনন্দে মেতে ওঠে বহু পরিবার। পিকনিকের আয়োজন করে দুপুরের খাবার খায় তারা। আর মাথা কামানো, জাফরান রঙের পোশাক পরা বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মার্বেলপাথরের মেঝে ও কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ঘুরে ঘুরে দেখেন।
বিশাল এই প্রাসাদটি এক নজর দেখার জন্য ৫০ কিলোমিটার ভ্রমণ করে আসা সন্ন্যাসী শ্রী সুমেদা এএফপিকে বলেন, 'নেতারা যখন এমন বিলাসী জীবনযাপন করেন, তখন সাধারণ মানুষের জীবন কীভাবে চলছে সে ব্যাপারে তাদের কোনো ধারণা থাকে না।'
'[সাধারণ] মানুষ যখন তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে তখন কী ঘটতে পারে, তার একটি উদাহরণ এই ঘটনা,' যোগ করেন তিনি।
অভূতপূর্ব
একসময়ের মোটামুটি ধনী অর্থনীতি শ্রীলঙ্কা এখন এক অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সংকটে ডুবে আছে। এমন সংকট দেশটিতে কখনও দেখা দেয়নি। অতি-মূল্যস্ফীতির সঙ্গে গুরুতর খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধ ঘাটতিতে ভুগছে দ্বীপরাষ্ট্রটি।
বিক্ষোভকারীরা কয়েক মাস ধরে গোতাবায়া রাজাপাকসেকে—যিনি কয়েক দশক ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করা শক্তিশালী এক বংশের সদস্য—পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। সম্প্রতি ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে এমনই বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হলেও এতদিন প্রাণপণে ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন গোতাবায়া।
কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, শেষতক শনিবার স্রোতের মতো বিক্ষুব্ধ জনতা প্রেসিডেন্ট ভবনের দিকে আসতে থাকলে পেছনের দরজার দিয়ে পালান ৭৩ বছর বয়সি গোতাবায়া। সেনাবাহিনী তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়।
বন্দুক, কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান নিয়ে প্রস্তুত ছিল পুলিশ; তবু লোহার গেট ভেঙে প্রেসিডেন্ট ভবনে ঢুকে পড়ে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। তার খানিক আগেই অবশ্য পালান গোতাবায়া।
রোববার গোতাবায়া সমুদ্রে নৌবাহিনীর একটি জাহাজে আশ্রয় নেন। বুধবার (১৩ জুলাই) পদত্যাগ করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
'পেইন্টিং নষ্ট করবেন না'
রোববারও ভারী অস্ত্রসশস্ত্রে প্রেসিডেন্টের গার্ডরা প্রেসিডেন্ট ভবনে ছিলেন। কিন্তু এবার তারাও নতুন অভ্যাগতদের সঙ্গে মিশে গেছেন। এমনকি বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সেলফিও তুলছেন।
মানুষ ব্যয়বহুল শিল্পকর্মের সামনে ছবি তুলতে ছুটে গেলেই তারা মৃদু ঠাট্টা-তামাশা করছিলেন।
'পেইন্টিং নষ্ট করবেন না, এগুলো গোতাবায়া আঁকেনি'—এরকম লেখা সংবলিত ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন 'আরাগালায়া' বা সংগ্রাম নামে পরিচিত একদল বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া শিক্ষার্থী।
ছবি তোলার পর অনেকেই শরীর জুড়ানোর জন্য প্রেসিডেন্ট ভবনের সুইমিং পুলে ঝাঁপ দেন। সাঁতার কেটে, জলকেলি করে শরীর জুড়ান তারা।
ইচ্ছাপূরণের সফর
৪৬ বছর বয়সি বুদ্ধিকা গুনাতিলাকা কলম্বোর একটি শহরতলি মোটরসাইকেল নিয়ে চলে এসেছেন সুদৃশ্য ভবন দেখতে। ভবনটিতে সাধারণত জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ থাকে।
গুনাতিলাকা এএফপিকে বলেন, 'আমার স্ত্রীকে নিয়ে এখানে আসার জন্য জমানো পেট্রোল খরচ করে ফেলেছি, কারণ শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাড়িটি দেখার এরকম সুযোগ আর কখনও পাব না।'
বিক্ষোভের বেদনাদায়ক স্মৃতিচিহ্ন এখনও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রেসিডেন্ট ভবনের আশপাশে।
প্রেসিডেন্ট ভবনের দিকে যাওয়ার ছোট সড়কে পুলিশের দুটি জলকামান ছিল। শনিবার সেনারা বিক্ষোভকারীদের একটি দলকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। রাস্তার পাশের দেয়ালে দেখা গেছে বুলেটের গর্ত।
প্রেসিডেন্ট সচিবালয়ের কাছে রাজাপাকসের অফিসের লোহার বেড়া ভেঙে মূল লবির দখল নিয়ে রোববার সেখানে একটি অস্থায়ী গ্রন্থাগার স্থাপন করেছে বিক্ষোভকারীরা।
গোতাবায়াকে বিদায় নিতে হবেই
দুই কন্যার মা, ৪৯ বছর বয়সি বলেছেন চামারি বিক্রমাসিংহে বলেন, 'আমি প্রতিদিন প্রতিবাদ শিবিরে যাই। গোতাবায়া অফিস না ছাড়া পর্যন্ত আমি থামব না।'
প্রেসিডেন্ট সচিবালয়ের লবিতে বসে এ কথা বলেন তিনি। '১৩ জুলাইয়ের মধ্যে চলে যাব বলাটাই যথেষ্ট নয়। তাকে এখনই ক্ষমতা ছাড়তে হবে।'
লাইব্রেরির কিউরেটর ৩৩ বছর বয়সি সুপুন জয়াবীরা বলেন, তারা সিংহলি, তামিল ও ইংরেজি ভাষার প্রায় ৮ হাজার বই রেখেছেন লাইব্রেরিতে। মানুষ সেগুলো পড়বে বলে আশা করছেন তারা। বিক্ষোভে সমর্থন দেওয়া মানুষদের অনুদান দিয়ে বইগুলো কেনা হয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবকরা বিক্ষোভকারী ও পুলিশ দুই পক্ষ্মকেই খাবার দিচ্ছিলেন।
জ্বালানির অভাবে কয়েকদিন ধরে গণপরিবহন বন্ধ। তার মধ্যেই এক শিক্ষার্থী বিক্ষোভকারী রাজাপাকসের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে জনতাকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন।
গুনাতিলাকা বলেন, 'আশা করি শনিবার যা ঘটেছে, তা ভবিষ্যৎ রাজনীতিবিদদের জন্য শিক্ষা হয়ে থাকবে। চিরকাল মানুষকে দাবিয়ে রাখা যায় না। একসময় তারা ঘুরে দাঁড়াবেই।'
- সূত্র: এএফপি ও হিন্দুস্তান টাইমস