বিদেশি কূটনীতিকরা কেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলেন?
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা সেই সুদূর কাল থেকেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের শরণাপন্ন হওয়ার এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন, যে ইতিহাসের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই জড়িত।
বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সংকটকালে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের শরণাপন্ন হতে দেখা গেছে অতীতে। ফলে ক্রমান্বয়েই রাষ্ট্রদূতদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি মন্তব্য করার পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে উত্তরোত্তর। সঙ্গে আছে আমাদের গণমাধ্যম। কখনো কোনো অনুষ্ঠানে যদি এদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে দেখা-সাক্ষাৎ হয়, তাৎক্ষণিকভাবে গণমাধ্যমের কর্মীরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়গুলো তুলে ধরেন তাদের সামনে, প্রশ্ন করেন দেশের রাজনীতি-সংক্রান্ত।
ফলে প্রায়ই দেখা যায় এই কূটনীতিকবৃন্দ অথবা রাষ্ট্রদূতরা সরাসরি এ বিষয়ে মন্তব্য করেন। কূটনৈতিক শিষ্টাচারে এ ধরনের মন্তব্য করার এখতিয়ার কতটা আছে, সে প্রশ্ন আমরা করতে পারি। এ বিষয়ে পরিষ্কার কোনো সীমারেখা নেই হয়তো, তবে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিকে যখন আমরা তাকাই তখন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে এই রাষ্ট্রদূতদের কখনো মত প্রকাশ করতে দেখিনি।
ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একাধিক বিষয় আছে যা ভারতীয় রাষ্ট্রকে, সমাজকে নানানভাবে বিভক্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে—কিন্তু কখনো আমরা দেখছি না যে এই রাষ্ট্রদূতরা সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়, অতি সম্প্রতি ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করা হয়, যা কাশ্মীরের জনগণকে এক বিশেষ অধিকার দিয়েছিল। এনআরসি (নাগরিকত্ব আইন) অথবা তাদের সর্বশেষ সিএএর কোনো কিছু নিয়েই তারা মন্তব্য করেন না। এমনকি তাদের কারাগারে হাজার হাজার সংবাদকর্মীর আটক থাকা অবস্থায়ও তারা কোনো মন্তব্য করেননি। কিন্তু বাংলাদেশ একটি ছোট অর্থনীতির দেশ হওয়াতে কূটনীতিকরা খানিকটা তাদের নিজের ইচ্ছামতো অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চর্চা করেন।
সাম্প্রতিককালে কাজে যোগ দেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কিংবা যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত একই কাজ করেছেন। কখনো কখনো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের একই কাজ করতে দেখছি। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মত প্রদান করার অধিকারের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার একটি গভীর সম্পর্ক আছে। আমাদের নেতাদের অনেকেই এ বিষয়ে নানান মন্তব্য করেন। দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমকর্মীদেরকে উপদেশ দিয়েছেন যে তারা যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে পরবর্তী সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি সম্পর্কিত প্রশ্ন করেন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপদেশ। কারণ আসলেই আমরা কখনো আমাদের গণমাধ্যমের কর্মীদেরকে খুব একটা দেখি না এই রাষ্ট্রদূতদের কাছে তাদের দেশসমূহের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে। আমাদের গণমাধ্যমকর্মীদের এই প্রবণতা কূটনীতিকদের বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করছে কি না সেটি একটি প্রশ্ন।
যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের নিরপেক্ষতার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তার বক্তব্যের ভেতর থেকে এটি স্পষ্ট যে বিগত নির্বাচন নিয়ে ভিন্নমত আছে। যদিও যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত দেশ নয়, তবুও বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যতম একটি বাজার। এই বাজারের ওপর ওপর দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা নির্ভর করে।
তার বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি সামনে এসেছে; তা হচ্ছে তিনি বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের উদাহরণ টেনে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের সমাজের সংকটের সমাধান আছে ১৯৭২ সালের সংবিধানে। এই বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা তিনি প্রদান করেননি, তবে যে অংশগুলো নিয়ে ১৯৭২ সালের সংবিধান গুরুত্ব পায় তার অন্যতম হচ্ছে সংবিধানে উল্লেখ আছে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের বিষয়টি।
১৯৭২-এর সংবিধানে উল্লেখ আছে নিম্ন আদালতের দায়ভার সুপ্রিমকোর্টের উপর ন্যস্ত থাকবে, যে কাজটি আজও পরিপূর্ণভাবে সম্পূর্ণ হয়নি। তিনি সংবিধানের এই বিষয়টি উল্লেখ করলেন কি না সেটি স্পষ্ট করেননি। এর বাইরে আর কোন কোন বিষয় থাকতে পারে যা তিনি বাহাত্তরের সংবিধানের মধ্যে সমাধান দেখতে পেয়েছেন, তা উল্লেখ করেননি। তবে তার একটি কথার খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের যদি সুশাসনের ঘাটতি হয় তাহলে আগামী দিনে বাংলাদেশের উপর অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।
বাংলাদেশ বর্তমানে একটি তীব্র অর্থনৈতিক চাপের মুখে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। অভ্যন্তরীণ ডলার সংকট এবং বাণিজ্য ঘাটতি প্রতি মাসে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সাথে সাথে বৈদেশিক আয়ের কোনো উন্নয়ন দেখা যাচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতিতে সর্তকতা খুবই জরুরি। এলডিসি উত্তোলনের সময়কালে যদি বাংলাদেশ একটি স্বাভাবিক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না দিতে পারে তাহলে অবশ্যই বাংলাদেশকে আগামী দিনে বড় সংকটের মুখোমুখি হতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি দৃশ্যত ইউরোপ আর বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের মধ্যপ্রাচ্যের উপর নির্ভরশীল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো দারুণভাবে পশ্চিমা ভাবাদর্শ ও পশ্চিমা রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে। সেই বিবেচনাকে সামনে রাখতে হবে আমাদের। যদি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমরা অবশ্যই এক ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়ব। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে সামরিক শাসন এবং দীর্ঘদিন নানান ধরনের অবরোধ থাকা সত্ত্বেও দেশটির অর্থনৈতিক সংকট আছে। কিন্তু আমাদের মতো এত তীব্র নয়, কারণ তাদের কিছু অভ্যন্তরীণ সম্পদ আছে যা তারা আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করছে। বিশেষ করে চীনের কাছে তাদের রপ্তানিযোগ্য গ্যাস একটি বিরাট ভূমিকা রাখছে। এছাড়াও তাদের আরও বেশ কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ আছে। তার ফলে তারা এই পশ্চিমা অবরোধ উপেক্ষা করে সামরিক শাসন বজায় রাখতে পেরেছে এবং তার সঙ্গে অনেকটা চীনের গভীর সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা যায়।
কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তাদের এমন কোনো অবস্থান নেই। আমরা পশ্চিমাদের কাছে তেমন কোনো গুরুত্ব বহন করি না। আমাদের প্রতিবেশী বড় অর্থনীতির দেশ ভারত তার রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের জন্য দীর্ঘকাল যাবত আমাদের সঙ্গে যে বন্ধুত্বের প্রকাশ ঘটায়, কিন্তু আমরা নানান চেষ্টা করলেও অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভারত আমাদের তেমন কোনো ছাড় দেয় না। যৌথ নদীর পানি বণ্টন কিংবা অর্থনীতির কোনো ক্ষেত্রেই। অতি সম্প্রতি যখন বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে খাদ্যদ্রব্যের উপর মূল্যস্ফীতির দিকে যাচ্ছে, তখন নানান ধরনের নিষেধাজ্ঞা—কখনো পেঁয়াজের নিষেধাজ্ঞা, কখনো গমের নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি—আমরা দেখতে পাচ্ছি। বন্ধুত্ব রাজনৈতিকভাবে যতটা প্রকাশ করা হয়, পারস্পরিক সম্পর্কের গভীরতার জায়গায় ততটা আছে কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রশ্নের সৃষ্টি করে।
শেষের কথাটা বলা যায়—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য, এ দুই দেশের রাষ্ট্রদূতের সপ্তাহান্তের বক্তৃতা, সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়—সবকিছুকেই গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপদেশ সাংবাদিকদের প্রতি যথেষ্ট নয়। অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে প্রধান। সেই ক্ষেত্রটিতে ব্যর্থ হলে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যে ভঙ্গ হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। এই দেশের রাজনীতির প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। সমাজের সংস্কার, সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রধান্য পায় না। রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যে কখনো সমাজের গণতান্ত্রিক সংস্কারের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণভাবে কোনো বিষয়কে সামনে তুলে ধরতে আমরা দেখি না। এই ধারার রাজনীতি অবশ্যই অর্থনৈতিক সংকটের ক্ষেত্রে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে দেশে।
পশ্চিমা বিশ্বেও মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রায় প্রতিটি দেশেই নানান পণ্যের দাম আকাশচুম্বী। তেলের দাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিন্তু সেখানকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জনগণকে বাস্তবতা মেনে নিতে বাধ্য করছে। জার্মানি অর্থনৈতিক সংকটকে মোকাবেলা করার জন্য প্রত্যেক নাগরিককে ইতিমধ্যে ৩০০ ইউরো প্রদান করেছে। যা আমাদের মতন দেশের পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে না। সেদিকটা মাথায় রেখে রাজনৈতিক সমঝোতার পথে হাঁটা জরুরি। কোনো অবস্থাতেই রাস্তার সংঘাত নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক কালের ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষদের কাছে এটি একটি বড় অনুরোধ। যদিও সরকারি দলের অনেক নেতানেত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের সংঘাতকে হাততালি দিয়ে উসকানি দিচ্ছেন। আবার ছাত্রদলের পৃষ্ঠপোষক বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ এই সংঘাতকে বাহবা দিয়ে হাততালি দিচ্ছেন।