‘হুসনেয়ারা, আমি দশটি সন্তানের পিতা, আমি পিতা হতে পারিনি, তোমার একটি মেয়ে আছে, তুমি মা হয়ো।’
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/05/11/taken_in_early_seventies_at_the_official_residence_of_abba_the_then_secretary_of_jessore_education_board.jpg)
পাঁচবছর আগের এই দিনে তুমি চলে গেছো।
তোমার স্পর্ধিত জীবনের দিকে রোজই ফিরে তাকাই আম্মা।
১৩ বছর সংসার করার পরে তুমি সেইকালে যে আলাদা থাকতে চাইলা, তার একটা বড় কারণ সম্ভবত আত্মসম্মান। অনেক পরে আমার আর লুনার সংসারে যে তুমি থাকলানা সেটার কারণ সম্ভবত নীতিনিষ্ঠা। এরকম বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারার জন্য সাহস লাগে, জেদ থাকতে হয়।
প্রথম সংসারে তোমাকে বলা হইছিলো, সব বাড়িতে এম এ পাশ হয়না, তোমার বাবা পারেননি, তোমারও হবেনা। তুমি কথাটার জবাব দিছিলা দুইটা এম এ পাশ করে। সংসারে অশান্তি করে তুমি এসব করো, এটা এমনকি তোমার সবচাইতে প্রিয় মানুষ, তোমার বাবাও চাননি। মেয়ের পীড়াপীড়িতে ফর্মের টাকাটা টেবিলের ওপরে রেখে, না খেয়ে তোমার বাসা থেকে বের হয়ে গেছিলেন নানা। তুমি কদমবুসি করতে গেলে নানা পা সরায়ে নিছিলেন। তোমার তীব্রতম কষ্টের দিন ছিলো সেটা। ফর্মের টাকা জোগাড় হলে কি হবে, বই কেনার টাকা ছিলোনা। সাথে শর্ত ছিলো সংসারের কাজে কোনো ব্যত্যয় ঘটা চলবেনা। তুমি হাল ছাড়োনি। এম এ করেছো। একসময় সংসার ছেড়ে এসছো। বাংলায় এম এ করার পর ড. শহীদুল্লাহ্-র সাথে পিএইচডি শুরু করছিলা তুমি। এই পণ্ডিত মানুষটি ছিলেন তোমার বাবার বন্ধুজন। তোমাদের রাজশাহীর বাসায় তাঁর নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিলো। একদিন তিনি তোমাকে বললেন, "হুসনেয়ারা, আমি দশটি সন্তানের পিতা, আমি পিতা হতে পারিনি, তোমার একটি মেয়ে আছে, তুমি মা হয়ো।" তোমার আর পিএইচডি করা হলোনা। কষ্টটা কতবড় ছিলো আমি জানিনা, কিন্তু গল্পটা বহুবার তোমার মুখে শুনছি।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/05/11/three_ladies._amma_at_our_place_with_her_daughter-in-law_and_grand_daughter.jpg)
আব্বার সাথে সংসার শুরু করার পরে ইকোনমিক্সে এম এ করলা তুমি। আব্বার ডিসিপ্লিন ছিলো ইকোনমিক্স। প্রথম সংসার ছেড়ে আসার ধাক্কার কারণেই কিনা কে জানে সিভিয়্যার গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সমস্যায় ভুগছিলা দীর্ঘদিন। হয়তো ডিপ্রেশনের একটা ব্যাপার ছিলো। ডাক্তার বললেন চাকরিতে ঢুকতে। তুমি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করলা। নানা সময়ে যেমন সমাজের অনুশাসনকে ডিঙ্গিয়ে গেছো, এই বেলায় এসে কিন্তু তুমি নর্ম রক্ষা করলা! ওই যে ড. শহীদুল্লাহ্ -র আপ্ত বাণী। তুমি ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবলা না। চাকরিটা নিষ্ঠার সাথে করলা ঠিকই, কিন্তু সেখানকার অর্জন বা প্রাপ্তির দিকে তাকালা না। আমার জন্মেরও আগে, যশোরে দাউদ ক্যান্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে অধ্যক্ষ হবার অফার ছিলো, যাওনি। বাইরে পড়তে যাবার স্কলারশিপ, নিলানা। স্বামীর সাপোর্টিং ক্যারেক্টার হয়েই থাকলা। আব্বার অধ্যক্ষ জীবনের জটিল মুহূর্তগুলোতে পাশে থাকাটাই কর্তব্যজ্ঞান করলা। আমার ছোটবেলায় খুব রাগ হতো। যতোবার গল্পটা শুনতাম, ডঃ শহীদুল্লাহকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হতো কেন তিনি তোমার জীবনের গণ্ডিকে এমন ছোট করে দিলেন, আর তুমিই বা কেন সেই একটা কথাকে শিরোধার্য করে নিলা!
তোমার কাছে ধর্মকর্ম শেখা, তোমার কাছেই মহাভারতের গল্প। তোমার সাথে দাবা, মনোপলি কিংবা ব্রীজ খেলার শুরু। তোমার কাছেই বিতর্কের হাতে খড়ি, তোমার কাছেই প্রগতি প্রকাশনের বই চেনা। একসময় লিখতা, রেডিওতে টক দিতা, সেতার বাজানো শিখছিলা। পরের জীবনে এসবের কিছুই ধরে রাখোনি। পরের জীবনে আমরা তোমাকে চিনলাম কড়া মা, রাগী ফুপু/খালা/চাচী হিসেবে, কড়া শিক্ষক হিসেবে। নানা সময়ে তোমাকে খুব কনভেনশনাল আর নর্ম্যাটিভ মনে হতো। আমরা ছেলেমেয়েরা ভাবতাম কি দরকার সেধে বর্ধিত পরিবারের সবকিছুতে নাক গলানোর, কি দরকার তিতা কথাটা সবার মধ্যে বলার। তুমি কিন্তু তোমার ঠিক-বেঠিকের মানদণ্ডে অবিচল থাকতা। এতোটাই থাকতা যে তোমার বিবেচনার উল্টোপিঠে কি আছে, ভেবে দেখতা না। তোমার সব বিবেচনা নিশ্চয়ই ঠিক ছিলোনা। মানুষ হিসেবে আমরা কেউই ভ্রান্তির উর্ধ্বে নই। কিন্তু তুমি মাথা উঁচু করেই হেঁটে গেছো তোমার পথটুকু।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/05/11/nanu_queen_victoria_at_the_centre_wth_her_two_daughter-in-laws_and_four_daughters._amma_in_white_printed_saree.jpg)
এমন একরোখা মানুষের চলার পথ কুসুমাস্তীর্ণ হয়না, তোমারও হয়নি। কিন্তু তোমার গায়ে লেপ্টে থেকে বড় হইছি আমি। তোমার সাহস, একাগ্রতা, নীতিনিষ্ঠার কণামাত্রভাগও যদি পাই, আমি বর্তে যাই। আমার গর্ব হয় এই ভেবে যে, সন্তানকে কখনো শেখাওনি বিপদ দেখলে দূরে সরে যেতে। কেবল বলছো যেটা করতে হবে করবা, আল্লাহ কে ডাকবা, দিনকাল ভালোনা।
তুমি ধর্মে বিশ্বাস করতা প্রবলভাবে। ইসলামে আল্লাহর কাছে সন্তানের একটা প্রার্থনা আছে। আমি অজ্ঞেয়বাদী হলেও দোয়াটা আমার খুব প্রিয়, 'রাব্বির হাম হুমা, কামা রাব্বা ইয়ানি সগিরা'। আম্মা, আমাকে শিশুকালে তুমি যে মমতা দিছো, তোমাকে নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক তেমন যত্নেই রাখবেন।
-
সাঈদ ফেরদৌস: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়