তামাক কোম্পানির নজর এখন তরুণ ও শিশুদের দিকে
বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে ১৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সের মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ; ১৫ বছর থেকে ২৪ বছরের জনসংখ্যা হচ্ছে ১৮.৫৬ শতাংশ, ২৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সের জনসংখ্যা ৪০.৭২ শতাংশ। এই পরিসংখ্যানটি একদিকে ইতিবাচক, কারণ দেশের তরুণ বয়সের মানুষের সংখ্যাই বেশি, এবং বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা কম। এই বয়সটা মানুষের কাজের বয়স, তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু অন্যদিকে ৫৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা মাত্র ১৪ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে গড় আয়ু ৭২ বছর। অর্থাৎ কিছু মানুষ যারা ৬৫ বছরের বেশি (৭ শতাংশ) তাদের কেউ কেউ হয়তো একটু দীর্ঘ আয়ু পাচ্ছেন। জনমিতির এই ধরন বিশ্বজুড়েই একরকম, তরুণদের সংখ্যা বেশি, শুধু পার্থক্য হচ্ছে উন্নত দেশে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যাও বেশি।
জনসংখ্যার পিরামিড দেখলে বোঝা যাচ্ছে, ৫৫ বছরের বেশি আয়ু অনেকেই পাচ্ছেন না, অকালেই ঝরে যাচ্ছেন। গড় আয়ু ৭২ বছর হওয়া সত্ত্বেও সেই বয়স পর্যন্ত অনেকেই পৌঁছাতে পারছেন না। নারীদের তুলনায় পুরুষদের মৃত্যুর হার বেশি। তার একটি অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে পুরুষদের মধ্যে ধূমপানের হারও বেশি। যেমন ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের তরুণদের মধ্যে ধূমপানের হার ৩৫ শতাংশ; পুরুষদের মধ্যে ধূমপানের হার অর্ধেকেরও বেশি। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ধূমপানের হার ২৮.৬ শতাংশ।
শুধু তামাক সেবনের কারনে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার জন মানুষ মারা যাচ্ছে। তামাক সেবনের কারণে অসুস্থ হয়ে যারা মারা যাচ্ছেন, তারা বৃদ্ধ হবার সুযোগ পান না। তাদের জীবন সংক্ষিপ্ত হয়ে যায় অসুস্থতার কারণে, এবং একপর্যায়ে মৃত্যুও ঘটে। বলা হয়, কমপক্ষে ১০ বছর আয়ু হারায় তামাকের কারণে। ইংরেজিতে বলা হয় premature death. উন্নত বিশ্বে তামাক নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সেখানে এই গবেষণাগুলো খুব স্পষ্টভাবে করা হচ্ছে। যেমন কানাডার গবেষণায় দেখা গেছে যারা ধূমপান করে, তাদের মধ্যে অকাল মৃত্যুর সম্ভাবনা অধূমপায়ীদের তুলনায় বেশি। এবং যত কম বয়স থেকে ধূমপান শুরু করবে, ততই তার মৃত্যু অকালে হবে। চীনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষদের মধ্যে তামাক সেবনের সময়কাল অনেক লম্বা—প্রায় ৩৫.২ বছর এবং দৈনিক সিগারেট ব্যবহারের সংখ্যা ১৯.৬। তারা গড়ে ২২.২ বছর বয়সে ধূমপান শুরু করেছেন। গবেষণাটি আরও দেখিয়েছে যে বর্তমান ধূমপায়ীদের মধ্যে অকালমৃত্যুর ঝুঁকি ১.৬ গুণ বেশি, আবার যারা ছেড়েও দিয়েছেন তাদেরও অকালমৃত্যুর ঝুঁকি ২.৩ গুণ বেশি। চীনের মতো এত ব্যাপকসংখ্যক ১৬ হাজার ৭০১ জন, যাদের বয়স ৪৫ বছরের বেশি, তাদের নিয়ে তামাক ব্যবহারের সাথে অকালমৃত্যুর ঝুঁকির সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা আর কোথাও তেমন হয়নি। এই গবেষণার ফলাফল ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে ২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর ছাপা হয়েছে। ধূমপানের দীর্ঘমেয়াদি সময়কালের সাথে সব ধরনের রোগের কারণে মৃত্যু এবং বিশেষ করে অকালমৃত্যুর সাথে সম্পর্ক রয়েছে।
এই তথ্য আমাদের জন্য গুরুত্বপুর্ণ হলেও তামাক কোম্পানি সেদিকে তাকায় না। তার দৃষ্টি হচ্ছে ১৫ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে যে বিশাল তরুণ (নারী ও পুরুষ) রয়েছে, সেই সংখ্যার দিকে। ২০২৪ সালের বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য 'Protecting children from tobacco industry interference'. বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এর ভাবানুবাদ করেছে 'তামাক কোম্পানির আগ্রাসন প্রতিহত করি, তরুণ ও শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি'।
তামাক কোম্পানি প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি আর আগ্রহী নয়, কারণ তারা তো মরেই যাচ্ছেন। তারা বেশি দিন তামাক সেবন করতে পারবেন না। কোম্পানি চায় তরুণ এবং শিশুরা তামাক সেবন করুক। এরা যদি একবার তামাক সেবনে আসক্ত হয়ে পড়ে, তাহলে তাদের দীর্ঘদিন ধরে রাখা যাবে। এটাই তাদের বাজার, তাহলে হাজার কোটি ব্যবহারকারী পাবে এবং তাদের মুনাফা বাড়বে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডাটা অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ৩ কোটি ৭০ লক্ষ শিশু (১৩-১৫ বছর বয়স) তামাক সেবন করছে।
তামাক কোম্পানির কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ হচ্ছে তার আয় । তামাক সেবনের কারণে বিশ্বব্যাপী বছরে ৮০ লক্ষ মানুষ মারা যায়, এটা তুচ্ছ ব্যাপার। তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমও জোরদার হচ্ছে, ফলে অনেক তামাকসেবী তামাক ব্যবহার ছেড়ে দিচ্ছে, যাকে বলে cessation. মৃত্যুর কারণে কিংবা সেবন ছেড়ে দেয়ার কারণে হোক, বছরে তামাক পণ্যের ব্যবহারে ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের এই ঘাটতি পূরণ করতে হলে তরুণদের প্রতিই নজর দিতে হবে। এবং সেটা করতে গিয়ে তারা শিশুদের আকৃষ্ট করার কৌশল অবলম্বন করছে। নিত্যনতুন আকর্ষণীয় তামাকপণ্য, বিশেষ করে ই-সিগারেট, নিকোটিন পাঞ্চ ইত্যাদি বাজারে ছাড়ছে। বিভিন্ন চকলেট ও আকর্ষণীয় খাবারের মধ্যে ফ্লেভারের সাথে আসক্তির জন্য তামাক ঢোকাচ্ছে। এগুলোর প্রতি শিশু এবং তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অন্যান্য অনলাইন মিডিয়াতে প্রচার করে যাচ্ছে। এই কর্মকাণ্ড এত বেড়ে গেছে যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্বিগ্ন হয়ে ২০২৪ সালের বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে এই প্রতিপাদ্য ঘোষণা করেছে।
কোম্পানির সোজা হিসাব। শিশু বয়স থেকে (১৫ বছর) কাউকে তামাক পণ্যে আকৃষ্ট করতে পারলে কোম্পানি তাকে অন্তত ৫০ বছর ধরে রাখতে পারবে। এই ৫০ বছরে কোটি কোটি টাকা তাদের আয় হবে।
কোম্পানি এই তৎপরতা পুরুষদের ক্ষেত্রে যেমন চালাচ্ছে, তেমনি নারী ধূমপায়ীর সংখ্যা বাড়ানোরও চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ধূমপানে আকৃষ্ট করানোর চেষ্টা চলছে। তরুণ বয়সের নারীর হাতে সিগারেট আধুনিকতার লক্ষণ বলে ধরে নেওয়া হলেও শিক্ষিত হওয়ার লক্ষণ বলে কিন্তু ধরা যাবে না। সরি। কারণ তামাক সেবনের ক্ষতি সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানেন। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষমাত্রই জানেন তামাক কোনো নির্দোষ পণ্য নয়। এই পণ্যের নিয়ন্ত্রণের জন্য জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সনদ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) করা হয়েছে। বাংলাদেশ এই কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে জাতীয় ধূমপান ও তামাকদ্রব্য ব্যবহার ও উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়েছে এবং তা কার্যকর আছে। কাজেই কোনো 'শিক্ষিত' মানুষ যদি এই আইন থাকা সত্ত্বেও এর ব্যবহার করেন, তাকে শিক্ষিত বলে মানতে কষ্ট হয় নিশ্চয়। কেউ যদি নারীবাদী হওয়ার জন্য বা পুরুষের 'সমকক্ষতা' অর্জনের জন্য নিজের হাতে মৃত্যু তুলে নেন, তাকে কিছু বলার নেই, শুধু অনুরোধ করব, এখানে নারীবাদী পরিচয় দেবার প্রয়োজন নেই। মৃত্যু হাতে নিয়ে সমকক্ষতার কোনো অর্থ নেই।
ফেসবুক এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের ছবি ব্যবহার করেও নতুন তামাকদ্রব্যের প্রচার হচ্ছে, যা একেবারে বেআইনি, অথচ এই বিষয়ে কেউ দেখছে না।
ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের ব্যবহারকারী মূলত নারী এবং বিবাহিত নারী। এদের অধিকাংশই গরিব গ্রামীণ নারী। তারা জানেন না তামাকের ক্ষতির কথা। জর্দা, সাদাপাতা পানের সাথে খাওয়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিষয়। বাংলাদেশেও জর্দা ও সাদাপাতার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ধূমপায়ীদের চেয়েও বেশি। প্রায় ২৭.৫ শতাংশ মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক (জর্দা, সাদাপাতা ও গুল) ব্যবহারকারী নারী ও পুরুষ আছে। কিন্তু নারীদের সংখ্যা পুরুষের চেয়েও বেশি, ২৮ শতাংশ নারী এবং ২৭ শতাংশ পুরুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করেন। পুরুষদের অনেকেই একইসাথে ধূমপানও করেন। তবে এটা ঘটে বেশিরভাগ গরিব ও গ্রামের মানুষের ক্ষেত্রে।
পানের সাথে জর্দা ও সাদাপাতা খাওয়া পারিবারিকভাবে গ্রহণযোগ্য, কিন্তু সামাজিক নিয়ম অনুযায়ী অবিবাহিত মেয়েদের খেতে দেওয়া হয় না। কিন্তু বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়িতে গেলে শ্বাশুড়ি, দাদি, নানি ও অন্যান্য মুরুব্বিদের জন্য পান বানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব এই তরুণীর ওপরই বর্তায়। স্বামীকেও পান বানিয়ে দেওয়া এবং নিজের ঠোঁট লাল করে রাখার পরামর্শ গোপনে আনেক কিশোরী বিবাহিত মেয়েকে দেওয়া হয়। তামাকবিরোধী নারী জোটের সদস্যরা ১৯টি জেলায় ২৮৮ জন নারীর অংশগ্রহণে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তারা দেখেছেন, জর্দা ও সাদাপাতা ব্যবহারকারীরা বিবাহিত এবং এদের বয়স বেশিরভাগই (৭৪ শতাংশ) চল্লিশ বছরের বেশি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশের বয়স ৫০ বছরের বেশি। কিন্তু ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে রয়েছেন ২৫.৬ শতাংশ। অর্থাৎ তরুণ বয়েসের নারীদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য সেবন করছেন। এরাই পরবর্তীকালে আসক্ত হয়ে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত সেবন করে যাচ্ছেন।
ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের কোম্পানি এই ব্যবহারকারীদের ধরে রাখার জন্য তামাক পাতা ছাড়াও অন্যান্য উপাদান ব্যবহার করে। একেক জর্দায় একেক ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে তামাকপাতা, গ্লিসারিন, ম্যানথল, গ্লিসারিন পারফিউম, জাফরানি ও মৃগনাভী, গ্লুকোজ, সুগন্ধি, হারবাল গরম মসলা এবং সুগন্ধি প্যারাফিন, অ্যারাবিক গাম, ভেজিটেবল অয়েল, কাবাব চিনি, সেকারিন, গরম ত্রিফলা, ময়দা, মোলাসেস, দারুচিনি, গমেরকন, ফুড কালার এবং অন্যান্য অন্যান্য উপাদান। যার মধ্যে ম্যানথল, প্যরাফিন, ফুড কালার ইত্যাদি বেশ ক্ষতিকর। নারীদের আকৃষ্ট করার জন্য জর্দার নানা আকর্ষণীয় নাম ব্যবহার করা হয়, যেমন শোভা, শাহজাদী, সূচিমনি, রসিদা ইত্যাদি।
এবারে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস যে সতর্কতা জারি করেছে, তাতে দেশে মানুষের যথেষ্ট উদ্বগ্ন হবার কারণ রয়েছে। তামাক কোম্পানি তরুণ এবং শিশুদের দিকে হাত বাড়ালে জাতির ভবিষ্যতের সর্বনাশ হয়ে যাবে। এইদিকে সরকারকে নজর দিতেই হবে।
- লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী
- বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।