‘আমরা আসলে খুঁজছি একজন চেঞ্জমেকার’
মেয়াদ শেষ হলে নতুন কেউ একজন দায়িত্ব নেবেন, ১৯৭২ সালে নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার পর থেকে সেভাবেই চলে এসেছে। এবার নির্বাচন কমিশন নিয়োগ সংক্রান্ত আইন তৈরি হয়েছে এবং সেই নুতন আইনের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রপতি নতুন কমিশনের নিয়োগ দিয়েছেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি শপথ নেয়ার মধ্য দিয়ে নয়া কমিশন দায়িত্ব গ্রহণ করল এবং এই কমিশনই আগামী সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করবে।
একজনের বিদায় আর একজনের আগমন; এই গতানুগতিকতার মধ্য দিয়ে কোন পরিবর্তন ঘটে না। পরিবর্তন কিছু করতে হলে শক্তি ও সাহস নিয়ে দাঁড়াতে হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এক নির্বাচনী বিরোধ মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক রাজ্যনির্বাচন কর্মকর্তার কাছে জানতে চান, "টি এন সেশনের নাম শুনেছেন?" ২৭ বছর আগের প্রধান নির্বাচন কমিশনার এখনও কেন প্রাসঙ্গিক? টি এন সেশনকে কেন সকলে উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করে? কারণ, টি এন সেশন একজন চেঞ্জমেকার। আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থার উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একজন চেঞ্জমেকারের।
টি এন সেশন ছিলেন ভারতীয় প্রশাসনিক সার্ভিস (আইএএস) ১৯৫৫ ব্যাচের অফিসার। ১৯৮৯ সালে হন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর তাকে ডেকে বলেন, নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দিন, আমরা কোন কোন তারিখে নির্বাচন করতে চাই। সেশন উত্তরে প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, আমরা নির্বাচন কমিশনকে একথা বলতে পারি না। সরকার নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত- এটুকুই বলতে পারি। তিনি সবসময় অনমনীয় মনোভাব নিয়ে কাজ করতেন, তাঁর আনুগত্য ছিল দেশের সংবিধান ও আইনের প্রতি। সংবিধান ও আইনের প্রতি আনুগত্যের কারণেই চন্দ্রশেখর তাকে প্রধান নির্বাচন কমিশন হিসেবে মনোনীত করেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে কাজে যোগ দেওয়ার দিনে তার জন্য নির্ধারিত কক্ষে গিয়ে দেখেন, বিভিন্ন দেবদেবীর অনেক অনেক ছবি ও মূর্তি। তিনি সেগুলো তাৎক্ষণিক সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। যদিও তিনি ব্যক্তিজীবনে ধর্মপরায়ণ মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তবুও প্রথমদিনই তিনি নিজের 'জাত' চিনিয়ে দেন। টি এন সেশন তার স্মৃতিচারণে বলেছেন, তার লক্ষ্য ছিল, কমিশনকে স্বাধীন এবং সরকারের প্রভাব বলয়ের বাইরে নিয়ে আসা। কাজটি ভীষণ কঠিন, তারপরও তিনি সেইভাবে এগিয়েছেন। তার উত্তসূরিরা খুব সামান্য অঙ্কের কেনাকাটার জন্য সরকারের অনুমোদনের জন্য চিঠি লিখতেন। নির্বাচন কমিশনে যেসব চিঠি আসতো তার খামের ওপর লেখা থাকত, "নির্বাচন কমিশন- ভারত সরকার"। খুব ছোট ছোট বিষয় কিন্তু সেশন শুরু করেন এখান থেকেই। তিনি বুঝিয়ে দেন কমিশন সরকারের অংশ নয়।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের লোকবলের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে ৩০০ জন, যারা কেবল কমিশনের নিজস্ব প্রশাসনিক কাজের সাথে যুক্ত। টি এন সেশন যথার্থই উপলদ্ধি করেছিলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে ভারতের এই আমলাতন্ত্রের ওপরই নির্ভর করতে হবে। সেই আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে যতই স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও দলবাজীর অভিযোগ থাক না কেন। আমাদের এই অঞ্চলের আমলাতন্ত্রের উপর অভিযোগগুলো একই ধরনের। এই অভিজ্ঞতার কারণেই হয়ত বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন নিজস্ব লোকবলের কথা ভেবেছে। বর্তমান লোকবল প্রায় ৪ হাজার, যেটা সাড়ে ৭ হাজারে উন্নীত করার কথা। দুর্নীতি অনুপ্রবেশ, স্বজনপ্রীতি ও দলবাজী প্রতিরোধের জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে- তা যদিও আমাদের সামনে স্পষ্ট নয়।
১৯৯১ সালে ভারতে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী জনসভায় রাজিব গান্ধী নিহত হলে প্রধান নির্বাচন কমিশন সরকারের কোনো পর্যায়ের কারো সাথে আলোচনা না করেই নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করেন। টি এন সেশন মনে করেন, সাংবিধানিকভাবে এটা তারই দায়িত্ব। টি এন সেশন তার সময়কালে সামান্যতম গ্রহণযোগ্য অভিযোগ থাকলেই নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি কোন কোন কেন্দ্রে ২ বার এমনকি ৩ বার নির্বাচন করিয়েছেন। কমিশনের ৫ বছরের মেয়াদকালে মিথ্যা হলফনামা দেবার অভিযোগে ১৪ হাজারের বেশি প্রার্থীকে ৩ বছরের জন্য যে কোনো নির্বাচনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
টি এন সেশন বিশ্বাস করতেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব কেবল নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা ও নির্বাচনী আচরণবিধি প্রণয়ন করা নয়। বরং সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন নির্বাচনী বিধি ও অন্যান্য আইন বাস্তবায়নের দিকে। নির্বাচনী বিধি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সামান্যতম অবহেলা তিনি সহ্য করেননি। কমিশনের নির্দেশনা পালনে ব্যত্যয় ঘটলে তিনি প্রসঙ্গটি বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) 'কমিশনের নির্দেশনা অমান্যের গুরুতর অপরাধ' বলে উল্লেখ করে লিখতেন। শাস্তির এই খড়গ থেকে সচিবস্থানীয় কর্মকর্তারাও বাদ পড়েননি। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই আমলাতন্ত্রের মধ্যে ধারণা দিতে পেরেছিলেন, কমিশনের নির্দেশনা অমান্যের পরিণতি চাকরিজীবনের স্থায়ী ক্ষতি।
সেশন ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ এই ৬ বছর ভারতের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। নির্বাচন ব্যবস্থার মধ্যে "ত্রুটি" রয়েছে উল্লেখ করে তিনি পশ্চিমবঙ্গের একটি আসনের নির্বাচন হতে দেননি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচিত হয়ে না আসতে পারার কারণে প্রণব মুখার্জিকে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। তিনি জ্যোতিবসুরও বিরাগভাজন হন। কিন্তু পিছু হটেননি। প্রতিটি ঘটনায় তাকে আদালতের মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আদালতের সমর্থন পেয়েছেন। আর সমর্থন পেয়েছেন ভারতের সাধারণ মানুষের।
ভারতের সাথে আমাদের রাজনীতির মিল-অমিল দুই-ই রয়েছে। দুদেশের রাজনীতিতেই দুর্বৃত্তায়ন মারাত্মক আকারে রয়েছে। ধর্মের ব্যবহার, সংখ্যালঘু নির্যাতন ও সংখ্যাগুরু তোষণ, দুর্নীতি ও গণতন্ত্রহীনতার সংস্কৃতি, বিরোধী মত ও চিন্তার দমন আর সাম্প্রদায়িকতা রাজনীতির মধ্যে স্থায়ী আসন নিয়েছে।
ভারতের সাথে আমাদের অমিলের প্রধান দিক হলো, ভারতের সংসদীয় পদ্ধতির ধারা প্রথমদিন থেকেই। ভারত তার জন্মের ৭৫ বছর যাবত একই ধরনের সরকার ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে। ফলে একধরনের নির্বাচনী সংস্কৃতি সেখানে প্রতিষ্ঠিত। ভারতের রাজনীতি, প্রশাসন ও জনগণ নির্বাচনী ব্যবস্থায় অভ্যস্ত। টি এন সেশনদের একবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়নি। তারা নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো মেরামত করে গিয়েছেন। ভারতের ৫টি প্রদেশে বিধানসভার নির্বাচন চলছে। ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও বড় ধরনের সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। আমাদের সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচন ৮ধাপে সম্পন্ন করার পরও শতাধিক মানুষের জীবনহানি ঘটেছে।
আমাদের রাজনীতি- অন্যদের সাথে মিল-অমিলের চেয়েও জটিল। ৯০ এর গণতন্ত্রে উত্তরনের পর ছয়টি নির্বাচনের মধ্যে প্রথম চারটি সম্পন্ন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। এই চারটি নির্বাচনই গ্রহণযোগ্যতার পরীক্ষায় "উত্তীর্ণ"। বাকি দুটি নির্বাচনের সময় দলীয় সরকার ক্ষমতায় এবং সেই দুটি নির্বাচন "উত্তীর্ণ" নয়। গণিতের সাধারণ সূত্র অনুয়ায়ী, 'দলীয় সরকারের সময়ে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না'। সেকারণে প্রায় বলতে শুনি, "আমাদের মনোযোগ নির্বাচন কমিশনে কে আসলো- তা নিয়ে নয়, আমাদের মনোযোগ নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে"। আমাদের দেশের রাজনীতি এখন এই প্রশ্নে বিভক্ত।
আমরা প্রতিষ্ঠানগতভাবে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন কাঠামো হিসেবে দেখছি না। সে কারণে কমিশনের বিকাশ, সক্ষমতা অগ্রাধিকার পায় না। নির্বাচন কমিশনকে সরকারের অংশ না করে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হওয়ার জন্য কী কী ক্ষমতা ও বিধি থাকতে হবে- সে আলোচনায় অনেকে অংশ নেন না। দেশে যখনই নির্বাচন হবে তখন নির্বাচনকালীন একটি অনির্বাচিত বা অন্য কোন ধরনের 'অস্বাভাবিক সরকার ব্যবস্থা' রাখতেই হবে- এটি একটি সর্বনাশী চিন্তা।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক