মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কেন ব্যর্থ হচ্ছে? কারণ প্লাটিপাস পাখি নয়!
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র হুমকির মুখে। সুইডেনের ভি-ডেম ইনস্টিটিউট গত বছর জানিয়েছে, বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৭২ শতাংশ স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে বা স্বৈরাচারী সরকারের অধীনে বাস করে। মাত্র ১৩ শতাংশ বাস করে উদার গণতন্ত্রের দেশে। ৪২টি দেশ স্বৈরাচারী হয়ে উঠছে বা গণতন্ত্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
তবে কীভাবে সেগুলো অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠছে তা চিহ্নিত করা হয়নি। ফলে শাসনব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক পথে ফেরাতে অনেক সময় নিষেধাজ্ঞার মতো এমন সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যা সব দেশে কার্যকর হয় না।
আর কেন কার্যকর হয় না তা জীববিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ডেনভার-এর জোসেফ কোরবেল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধ্যাপক অ্যারন স্নাইডার।
উদাহরণ হিসেবে তিনি প্লাটিপাসের কথা উল্লেখ করেন। প্লাটিপাস হলো একটি ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী যা তাসমানিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায়ে দেখা যায়।
জীববিজ্ঞানে কোনো প্রাণীর বৈশিষ্টের ভিত্তিতে সেগুলোকে শ্রেণিবদ্ধ করা যায়। যেমন চঞ্চু থাকলে পাখি। মায়ের দুধ পান করলে স্তন্যপায়ী। সরীসৃপ সাধারণত হয় বিষাক্ত। এভাবে শ্রেণি বিভাজনের পদ্ধতিকে ফিনেটিক বলে। অথচ প্লাটিপাসের একটি চঞ্চু আছে। এটি মায়ের দুধ পান করে আবার বিষাক্তও। এ প্রাণীর ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শ্রেণিকরণ কাজ করে না।
অন্যদিকে ক্লাডিস্টিক বা বিবর্তনীয় মতবাদে মনে করা হয় একক কোষ থেকে জীবের শুরু। এরপর বিবর্তিত হয়ে ধীরে ধীরে এখনকার বিভিন্ন প্রাণীর রূপ পেয়েছে। প্লাটিপাসে পাখি এবং সরীসৃপের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, তবে বিবর্তনবাদ অনুযায়ী প্লাটিপাস স্তন্যপায়ী পরিবারের অন্তুর্ভুক্ত।
তাই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাগুলো কেন বারবার ব্যর্থ হচ্ছে তা বুঝতে, দেশগুলোর বিবর্তনের ইতিহাস বিবেচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক স্নাইডার। তার মতে, দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থাকে বিবেচনা করতে হবে সেই একক কোষ হিসেবে। অর্থাৎ শাসন ব্যবস্থার বিবর্তন দিয়ে, শুধু গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য দিয়ে নয়।
দেখা যায়, বর্তমানে গণতান্ত্রিক হোক বা অগণতান্ত্রিক; আদর্শিকভাবে বাম ঘরানার সরকারের বিপ্লবী এবং উপনিবেশবিরোধী ইতিহাস থাকে। সম্পদ পুনঃবন্টন এবং ধনী-গরিবে সমতা আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা ক্ষমতায় আসে।
বিপরীতে ডানপন্থী সরকারের উৎপত্তি তাদের ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে যুক্ত। আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী ও তাদের স্থানীয় মিত্রদের সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতা অর্জন করে এ ধরনের সরকার। ব্যবসায়িক সমিতি এবং অভিজাতদের সাথে সম্পর্ক ধরে রাখে। এ ছাড়া সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিপরীতে প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে সমর্থন করে।
দেশগুলো দৈবভাবে তাদের শাসন ব্যবস্থা বেছে নেয় না। পূর্ব শাসনের ইতিহাস ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের মিশ্রণে ডান বা বাম ঘরানার সরকার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।
সরকার কাঠামো সময়ের সাথে বিকশিত হতে পারে। এক সময় অগণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যও অর্জন করতে পারে। আর এতেই দেশটিকে অগণতান্ত্রিক হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করে ভুল করে বসতে পারে কেউ। এ ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ফেরাতে নিষেধাজ্ঞার মতো উদ্যোগ ব্যর্থ হবে।
যেমন অগণতান্ত্রিক হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করতে সূচক হিসেবে ধরে নেওয়া হয় নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠু না হওয়া বা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকা, সুশীল সমাজের কাজের সীমাবদ্ধতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকা ইত্যাদি।
এসব মানদণ্ডে কিউবা, নিকারাগুয়া, ভেনেজুয়েলা, ফিলিপাইন ও বর্ণবাদকালীন দক্ষিণ আফ্রিকাও অগণতান্ত্রিক হিসেবে বিবেচিত।
দক্ষিণ আফ্রিকায় একসময় ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয় দেশটিকে। আর তা কাজও করেছে। কিন্তু কিউবার ক্ষেত্রে একই উদ্যোগ ভিন্ন ফল দেখিয়েছে। ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা বা আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা সেখানের সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনেনি।
যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ৩৫টিরও বেশি দেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যে কারণে দেশগুলোতে মানবাধিকার সংকট তৈরি হয়েছে তবে গণতন্ত্রীকরণ হয়নি।
আর তার কারণ দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থার বিবর্তন। দক্ষিণ আফ্রিকা যেমন ডানপন্থী বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। দেশটির সরকারব্যবস্থা প্রচলনে অবদান রাখা সম্প্রদায়গুলো নিষেধাজ্ঞার কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সে সম্প্রদায়গুলো হলো পশ্চিমাপন্থী সরকার, পুঁজিবাদের সমর্থক, স্থানীয় অভিজাত ও আধিপত্য ধরে রাখা শ্বেতাঙ্গ লোকজন। এই শ্রেণিগুলো বিচ্ছিন্নতা মেনে নিতে পারেনি তাই তারা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে।
অন্যদিকে কিউবা এবং ভেনেজুয়েলায় ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার ফলে অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে। অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এসব দেশে গণতন্ত্রীকরণ হয়নি। কারণ দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থার শেকড় হলো বামপন্থা। তাই বিবর্তনের ধারার পার্থক্য বুঝেই দেশগুলোর জন্য গণতন্ত্রীকরণের নীতি বেছে নেওয়া উচিত।
যেসব দেশ বাম ধারার বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, সেগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা সরকারের বিচ্ছিন্নতার প্রচেষ্টা পশ্চিমা-বিরোধী অবস্থান আরও শক্ত করতে ব্যবহার করা হয়। তারা অর্থনীতি ধ্বংস ও মানুষের কষ্টের জন্য পশ্চিমা বিচ্ছিন্নতাকে দায়ী করে।
অনেক সময় যুক্তরাষ্ট্র এই বিবেচনায় ভুল করে যে, বামপন্থী সরকার থেকে ডানপন্থী সরকারে পরিবর্তনই গণতন্ত্রের পথ উন্মুক্ত করে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয় না। যেমন চঞ্চু আছে এবং বিষাক্ত বলেই প্লাটিপাস সরীসৃপ বা পাখি হয় না।
বামপন্থায় বিবর্তিত রাষ্ট্রে এখন ডানপন্থী সরকার ব্যবস্থা থাকলেও ওই দেশ কখনো গণতন্ত্রীকরণ বেছে নেবে না। এ ক্ষেত্রে গণতন্ত্রীকরণের উপায় হতে পারে এ ধরনের সরকারকে বৈধতা দেওয়া জনগোষ্ঠীর মানসিকতা পরিবর্তন আনা — নিম্নশ্রেণিকে কাছে টেনে নিয়ে এবং এই পরিবর্তনে আন্তর্জাতিক সংহতি জানিয়ে। এতে দেশগুলোতে জনপ্রিয় আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। যা তাদের গণতন্ত্রের দিকে নিয়ে আসতে পারে।
তবে মূলত দুটি কারণে এমন উদ্যোগ সফল হয় না। প্রথমত, সমমনা দেশগুলো সমালোচনা করে না। যেমন, ইউক্রেনে রাশিয়ার প্রাণঘাতী হামলার সমালোচনা করেনি চীন বা কিউবার মতো বামপন্থী দেশ। আর দ্বিতীয় কারণ যুক্তরাষ্ট্র নিজে। যারা বামদের জনপ্রিয় আন্দোলন নিয়ে ভীত। এবং সম্ভাব্য ডানপন্থী মিত্রতা নিয়ে তারা সহজেই প্রলুব্ধ হয়।
নিকারাগুয়ার ক্ষেত্রেও একই বিষয় ঘটেছে। ২০১৮ সালে দেশটিতে পেনশন ব্যবস্থা সীমিত করার উদ্যোগে শিক্ষার্থী, নারী, কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি রাস্তায় নেমে আসে। এতে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের দ্বারপ্রান্তে ছিল নিকারাগুয়া। কিন্তু তা পণ্ড হয় যুক্তরাষ্ট্রের কারণে।
ওয়াশিংটন এখানে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়। এতে সেখানের আন্দোলনের রূপরেখা পাল্টে যায়। নিকারাগুয়া সরকার সেখানে দমন নিপীড়ন চালায় আর বিরোধীদের যুক্তরাষ্ট্রের দালাল বলে আখ্যা দেয়।
দেশে দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে অনেকাংশে অবদান রাখছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে ওয়াশিংটনের উচিত এমন দেশে চাপ প্রয়োগ করা যেখানে তার সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।