ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত আর আগের অবস্থায় থাকবে না
আজ শুক্রবার দিনের শুরুতেই গাজায় যুদ্ধবিরতির খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে একটি বিষয় প্রতীয়মান, ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা হয়তো আবারও তাদের ভঙ্গুর, অথচ উত্তেজিত স্থিতাবস্থায় ফিরে যেতে আগ্রহী। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে অবিরাম গাজা ভূখণ্ডে বোমা ও গুলিবর্ষণ করার পর এই মুহূর্তে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, ইতোমধ্যেই তাদের সামরিক স্বার্থসিদ্ধি হয়ে গেছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের দিকে এখন পর্যন্ত চার হাজার রকেট নিক্ষেপের পর গাজা ভূখণ্ডের শাসক গোষ্ঠী হামাসও নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করেছে। হামাসকে বলা যায় ক্ষত-বিক্ষত, অথচ অবনত নয়- এমন এক শক্তি, যারা লাখ লাখ ফিলিস্তিনির ওপর দখল বজায় রাখা ইসরায়েলি রাষ্ট্রের মুখোমুখি হওয়ার জন্য তাদের সমগোত্রীয়দের চোখে প্রশংসিতই হয়েছে। কিন্তু সংঘাতের ফলে শত শত ফিলিস্তিনি ও ডজনখানেক ইসরায়েলির মৃত্যুর কথা ভাবা হচ্ছে না।
তবু ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত পর্যবেক্ষণকারী ও বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, এখন আর দুই পক্ষের সম্পর্ক আগের পর্যায়ে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। সর্বশেষ সহিংসতার হিংস্র রূপ একইসঙ্গে ইসরায়েল সরকার ও বাইডেন প্রশাসনকেও হতবাক করে দিয়েছে। কিন্তু আসলে এমনটা হওয়াই উচিত ছিল না।
তবে ঘটনার মূল ইন্ধন এসেছে গাজা থেকে অনেকটা দূরে, ইসরায়েলি ইন্ধনদাতা পুলিশ ও জেরুজালেমের দিকে এগোতে থাকা রক্ষণশীল চরমপন্থী ইহুদিদের কাছ থেকে। ফিলিস্তিনিরা পবিত্র নগরী থেকে তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন এবং ইসরায়েলি পুলিশ আল-আকসা মসজিদে হামলা করার পর পরিস্থিতি চরমে ওঠে। তখনই হামাস ইসলামের তৃতীয় পবিত্র নগরীর রক্ষাকর্তা রূপে আবির্ভূত হওয়ার একটি সুযোগ খুঁজে পায় এবং হামলা শুরু করে। ক্রমেই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে নদী ও সমুদ্রের মধ্যবর্তী অঞ্চলগুলোতে। আর সেই যুদ্ধের হাওয়া লাগে ইসরায়েলের নিজ সীমানার ভেতরে থাকা আরব ও ইহুদি ইসরায়েলিদের মধ্যেও।
যুদ্ধের উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসয়ায়েল ও ফিলিস্তিন- দুই পক্ষের রাজনৈতিক ত্রুটিও সবার চোখে পড়েছে। দুই বছর ধরে নিরলস নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে নিয়ে কিংবা তাকে ছাড়াই শক্তিশালী কোনো মিত্র গঠন করতে ইসরায়েল ব্যর্থ হওয়ায় সরকার পরিচালনা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটি আবারও রক্ষণশীল গোষ্ঠীকেই দেশটির রাজনৈতিক সংখ্যাগুরু হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছে।
অন্যদিকে, ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে তাদের অবরুদ্ধ ক্ষমতা ও বুড়িয়ে যাওয়া প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে নিয়ে বৈধতা সংকট শুধু আরও তীব্রতর হয়েছে। প্রায় দেড় দশক পর আব্বাস প্রথমবারের মতো হতে যাওয়া ফিলিস্তিনি নির্বাচনের পরিকল্পনা বাদ দেওয়ার পর হামাস তাদের সামরিক বাহিনীকে আরও সুসজ্জিত করেছে।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার পর ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা হয়তো আগের 'শান্ত' পরিস্থিতি কামনা করতে পারেন; কিন্তু বিশেষজ্ঞরা ভাবছেন তার উল্টো। ইসরায়েলের বহু রাজনীতিবিদ এখনো স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হতে দেওয়ার বিপক্ষে। বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি সীমান্তের ওপর দখলদারি ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে এবং তাদের মৌন সম্মতি দিয়ে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রও এ বিষয়ে আর মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করেনি। এসব কারণে ফিলিস্তিনিদের ক্ষোভ ও প্রতিরোধ আরও বাড়তে পারে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ভোট বিশ্লেষক খলিল শিকাকি লিখেছেন, 'আব্বাস ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে (পিএ) গৌণ করে তুলতে ইসরায়েল যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এর ফলে পশ্চিম তীরকে পরবর্তী সংঘাত থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে না। ইসরায়েল ও পিএ-এর মধ্যকার নিরাপত্তা সমন্বয়ের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। সেইসঙ্গে দখলদারি বজায় রাখতে তারা যে অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করে রেখেছে, তা দেখে মনে হয় না- কোনো ডানপন্থী ইসরায়েলি সরকার এমন কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যাবে, যেখানে পিএ নেতৃত্বের সঙ্গে সমঝোতা করতে হয়।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে এমন হবে, তা আগে থেকেই আশঙ্কা করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে করা সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, তাদের অধিকাংশই মনে করেন, এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সমঝোতা সম্ভব নয়। পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে যেখানে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গড়ে ওঠার কথা ছিল, ১৯৯০ সালের পর থেকে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যা সাত গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক সময় ইসরালের প্রান্তিক গোষ্ঠী হিসেবে থাকা এই ইহুদিরাই এখন ইসরায়েলি ডানপন্থীদের অগ্রদূত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন। ১৯৯৩ সালের অসলো রেকর্ড চুক্তি অনুযায়ী দুই রাষ্ট্রের সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে যেসব কাজ করার কথা ছিল, ইসরায়েলি ডানপন্থীরা এখন আর সেসব নিয়ে ভাবছেনও না।
আমেরিকাভিত্তিক 'থিংক ট্যাঙ্ক' ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র কর্মী তামারা কফম্যান উইটস লিখেছেন, 'ইসরায়েলে আগের সমঝোতা অনুযায়ী কোনো কাজই করেনি, বরং তারা ইহুদি বসতি স্থাপন আরও প্রসারিত, এবং পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করেই চলেছে। এর ফলে নতুন একটি সংকটের উত্থান অনিবার্য হয়ে উঠেছে।'
দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক তৈরিতে এতদিন ধরে যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি ও কূটনীতিবিদ নিজেদের ক্যারিয়ার ঝুঁকির মুখে ফেলেছেন, তারা এখন বুঝতে পারছেন এই সম্ভাবনা কতটা অসম্ভব। দুই দশক আগে আরব পিস ইনিশিয়েটিভ নিয়ে কাজ করা সাবেক জর্ডানি কূটনৈতিক মারওয়ান মুয়াশের বলেন, 'অসলো ফ্রেমওয়ার্ক এখন শেষ। প্রশিক্ষণগতভাবে টু-স্টেটার, কিন্তু বাস্তবে আমি ওয়ান-স্টেটার।'
অসলো পরবর্তী যুগের অন্য যেসব বিজ্ঞ ব্যক্তি সেই ইভেন্টে অংশ নিয়েছিলেন, তারা তেমন জোরাল ছিলেন না। ইসরায়েলের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিপি লিভনি প্রত্যাশা করেছিলেন, 'প্রায়োগিক মধ্যস্থতা' করার মাধ্যমে দুই পক্ষই শান্তি ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা 'সমাধান' নয়, বরং স্রেফ একটি আকাঙ্ক্ষা বলেই মনে হচ্ছে।
ইসরায়েলের সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল কার্টজার মনে করেন, টু-স্টেট সল্যুশনই এখন পর্যন্ত একমাত্র নীতি যার জন্য এখনো প্রয়াস চালানো যেতে পারে। অর্থাৎ, একটি দ্বিজাতি রাষ্ট্র তৈরি কিংবা ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি কনফেডারেশন তৈরি করা- যেখানে জেরুজালেমের মালিকানা দুই পক্ষেরই থাকবে, অথবা সে রকম ব্যবস্থা রাখা হবে। কার্টজার বলেন, 'টু-স্টেট সল্যুশনের বিকল্প ব্যবস্থা যিনিই ভেবেছেন, তিনি জানেন, এটি কার্যকরী হবে না।'
কিন্তু বহির্বিশ্বে ফিলিস্তিনি আন্দোলনকে ঘিরে, বিশেষত আমেরিকান ডেমোক্রেটদের মধ্যে আলোচনার মূল কেন্দ্র ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের অভাব থেকে সরে অধিকারবঞ্চিত হওয়ার দিকে যেতে থাকা প্রসঙ্গে পাল্টা জবাবে মুয়াশের বলেন, 'তাহলে মানুষের অধিকারকেই তর্কের মূল বিষয় হিসাবে রাখা যাক। সমাধানের আলোচনা চলতে থাকুক; কিন্তু তাদের সম অধিকারের দাবি এড়িয়ে যাওয়া কোনো যৌক্তিক কথা নয়।'
শেষোক্ত দাবির পক্ষে খোদ ফিলিস্তিনিরাই কথা বলছেন। এ সপ্তাহেই একটি গণআন্দোলনে গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আরব ইসরায়েলিরাও যোগ দিয়েছেন; কারণ তাদের অধিকাংশই নিজেদের ফিলিস্তিনি ভাবেন।
লন্ডন রিভিউ অব দ্য বুকসের তারেক ব্যাকনি লিখেছেন, 'প্রথমত, ফিলিস্তিনিদের চুপ থাকাকে তাদের নিজেদের গোষ্ঠিরই কেউ কেউ অভিযুক্ত করেছেন; কিন্তু তারা কখনোই হার স্বীকার করে নেননি। তারা দেখিয়ে দিয়েছেন, ইসরায়েল কোনো মূল্য না চুকিয়ে তাদের নিজস্ব নীতির মধ্যে জোর খাটাতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে আরও বৃহৎ আন্দোলন তৈরি হলেও, তাদের একত্রে জেগে ওঠা প্রমাণ করে, বিভাজনের মিথ্যা আশা, সীমান্ত বিভাজন এবং তাদের রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনকে টুকরো টুকরো করে ফেলা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিরা মানুষ হিসেবে প্রতিবাদী আত্মপ্রকাশ করেছেন।'
নিউইয়র্ক টাইমসের ইউসেফ মুনায়ের লিখেছেন, 'বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনের সঙ্গে সমাধানের পথ না খুঁজে বরং তাদের হিংস্রভাবে দমন করে গেছেন। ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি নাগরিকদেরও তারা নির্বাসিত বা অবহেলিত করে রেখেছেন কিছু অঞ্চলে। কিন্তু বর্তমান গণআন্দোলন ও অস্থিরতা ইসরায়েলিদের সামনে এক নতুন বাস্তবতা তুলে ধরেছে- ফিলিস্তিনিরা শেষ হয়ে যাননি, বরং তারা এখন তাদের চারপাশে সর্বত্র।'
- লেখক: ইন্ডিয়ান-আমেরিকান কলাম লেখক
- দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে অনুবাদ: খুশনূর বাশার জয়া