ভবনটি বিশ্বসেরা খেতাব এনে দেবে কখনো ভাবেননি স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী
হাসপাতালে নেই কোনো সীমানাপ্রাচীর। ভিতরে ১০ ফুট প্রশস্ত জলাশয়। খানিকটা জায়গা ফাঁকা রেখে একতলা আর দুইতলা কিছু ভবন। তবে ভবনে নেই পলেস্তারা। ইটের গাঁথুনি আর ঢালাইয়ে বানানো দেয়াল ও ছাদ। নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে পানির প্রবাহ। রয়েছে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার বিশেষ ব্যবস্থা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো মাথায় রেখেই কম খরচে ভবনটির নকশা করেন হাসপাতালটির স্থপতি ও ঢাকা-ভিত্তিক স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান আরবানার পরিচালক কাশেফ মাহবুব চৌধুরী।
বুধবার (২৬ জানুয়ারি) দুপুরে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস (রিবা) ঘোষিত ফলাফলে বিশ্বে কম খরচে ব্যতিক্রমী নকশায় নির্মিত ভবন হিসেবে 'বিশ্বের সেরা নতুন ভবন' হিসেবে স্বীকৃতি পায় কাশেফ মাহবুবের নকশায় নির্মিত এই ভবন। ভবনটি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সোয়ালিয়ায় ফ্রেন্ডশিপ এনজিও নির্মিত প্রথম "ভূমি হাসপাতাল"।
স্থাপত্য সৌন্দর্যে দৃষ্টি কেড়েছে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। মনোরম পরিবেশ, স্বল্প খরচে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয় হাসপাতালটিতে। বিশ্বে কম খরচে ব্যতিক্রমী নকশায় নির্মিত ভবন ও ভবনের স্থপতি অর্জন করে নিয়েছে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটি আর্কিটেক্টস (রিবা) বিশ্বসেরা খেতাব।
১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে হাসপাতালটি। ২০১৪ সালে নির্মাণ কাজ শুরুর পর ২০১৮ সালে শেষ হয় ও এরপর থেকেই শুরু হয় চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত হাসপাতালটি। ২০টি ভবনের সমন্বয়ে ৪৭ হাজার ৭৭২ বর্গফুট জায়গাজুড়ে বিস্তৃত স্থাপনা। স্থানীয় প্রযুক্তি ও নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে নির্মিত হাসপাতালে আউটডোর ও ইনডোর চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। আরও রয়েছে অডিটরিয়াম, কনভেনশন সেন্টার, ক্যানটিন ও প্রার্থনাকক্ষ। চিকিৎসক-নার্সসহ ৫৬ কর্মকর্তা-কর্মচারীর আবাসিক সুবিধা হাসপাতালটিতে। রয়েছে অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও। সবধরনের রোগীর চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয় এখানে। ৮০ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালে রয়েছে সার্জারির ব্যবস্থা।
কাশেফ মাহবুব চৌধুরী একজন বাংলাদেশি স্থপতি। জন্মগ্রহণ করেন ঢাকায়। বাবা ছিলেন একজন প্রকৌশলী। বাংলাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে স্থাপত্যে স্নাতক করেন কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। এর আগে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জন করেন। চট্টগ্রামে চান্দগাঁও মসজিদ নকশার জন্য তিনি ২০১০ সালে স্থাপত্যে আগা খান পুরস্কার পান। রিবা পুরস্কার পাওয়ার পর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কাছে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন কাশেফ মাহবুব চৌধুরী।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস): রিবা আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘোষণার পর কেমন লাগছে?
কাশেফ মাহবুব চৌধুরী: পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ সব পুরস্কারের মধ্যে এই পুরস্কার অন্যতম। এরকম একটি অর্জনে খুব ভালো লাগছে। একক প্রকল্পের জন্য যদি এই পুরস্কার হয়ে থাকে তবে এটি বড় একটি পুরস্কার। আমি অভিভূত। তবে যেসব কারণে এ পুরস্কারটি দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে আমি আরও বেশি আনন্দিত। আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় মাথায় রেখেই কাজটি করেছিলাম। আমাদের চিন্তা-ভাবনার স্বীকৃতিই তারা দিয়েছেন।
টিবিএস: বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ভবনটি কীভাবে সম্পর্কিত?
কাশেফ: বঙ্গোপসাগর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে সাতক্ষীরাতেও লবণ পানি চলে এসেছে। শুধু মাটির ওপরে নয় নিচেও লবণাক্ততা। এই পানি খাওয়া যায় না, রান্না হয় না আবার গোসলও করা যায় না। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য এই অঞ্চলে একরকম যুদ্ধ করে মানুষ। এটি মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এসব কথা চিন্তা করেই ভূমি হাসপাতাল ভবনের নকশা করা হয়।
টিবিএস: এই ভবনের নকশায় গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো কী?
কাশেফ: হাসপাতাল নির্মাণের বিভিন্ন দিক মাথায় রেখেই ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, বৃষ্টির পানি ধারণ করা, খুব তাড়াতাড়ি বৃষ্টির পানি সরিয়ে নেওয়ার মতো পরিবেশবান্ধব খুব ছোট ছোট বিষয় ধরে ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কাজটি করা হয়।
টিবিএস: বাংলাদেশের অন্যান্য হাসপাতাল থেকে এই ভবনের নকশা একেবারেই ভিন্নধর্মী। এ বিষয়ে কী বলবেন?
কাশেফ: সবারই ধারণা থাকে হাসপাতাল একটি যন্ত্রের মত। একদিক দিয়ে রোগী ঢুকবে, তাদের চিকিৎসা হতে থাকবে আর অন্যদিকে বর্জ্য বেরিয়ে যাবে ইত্যাদি। কিন্তু আমরা সেখানে আটকে থাকিনি, আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, আলো বাতাস কীভাবে থাকবে, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ কীভাবে থাকবে এসব দিকে খেয়াল রাখার পাশাপাশি রোগীদের মানসিক দিক বিবেচনা সুন্দর একটা জায়গা দেওয়ার চিন্তা করেছি। পৃথিবীর তর্ক এবং বিতর্কের যে কেন্দ্রস্থল সেখান থেকে আমাদের এই ভাবনার স্বীকৃতি আসাটা একটা বড় ব্যাপার।
টিবিএস: বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় এই স্বীকৃতি কীভাবে কাজে আসবে?
কাশেফ: ভবনটি নিয়ে কাজ করার আগে বা নির্মাণের সময় অবশ্যই চিন্তা করিনি এটি বিশ্বসেরা খেতাব অর্জন করিয়ে দিবে। এটি আমার জন্য নয় আমাদের দেশের জন্য বড় প্রাপ্তি। দেশের জলবায়ু সংকট পৃথিবীর কাছে তুলে ধরাটা একটা কঠিন কাজ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা বহিঃবিশ্বের মানুষ সহজে বুঝতে পারে না। তবে এই হাসপাতালটির মধ্য দিয়ে তারা খুব সহজেই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন এবং তার স্বীকৃতিও দিয়েছেন। হাসপাতালটির মাধ্যমে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্ববাসীর সামনে এসেছে।