যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় বিশদ যা বললেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ
দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
সোমবার (২০ মে) মধ্যরাতে (বাংলাদেশ সময়) মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অযোগ্য ঘোষণার কথা জানানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্তের পর আজ মঙ্গলবার দেশের একটি বেসরকারি সম্প্রচারমাধ্যমের সঙ্গে সরাসরি আলাপে অভিযোগগুলো নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন আজিজ আহমেদ। তিনি বলেছেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো অবান্তর। তার ধারণা- সরকারকে কিছুটা হলেও বিব্রত বা হেয় করার জন্য এই নিষেধাজ্ঞা হতে পারে। নিচে পাঠকের জন্য তার বক্তব্য তুলে ধরা হলো।
সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, যে দুটি অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে আমাকে ও আমার পরিবারকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সে দুটি অভিযোগ হলো- আমার ভাইকে বাংলাদেশে তার অপরাধের জবাবদিহিতা এড়ানোর জন্য আমি আমার পদ-পদবি ব্যবহার করার মাধ্যমে সহযোগিতা করে করাপশন করেছি।
দ্বিতীয়ত, আমি আমার ভাইকে সামরিক কন্ট্রাক্ট দিয়ে, ঘুষ নিয়ে আরেকটা দুর্নীতি করেছি।
সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, ২০২১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি আলজাজিরা 'অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন' শিরোনামে যেটি প্রচার করা হয়েছিল, সেখানে এ দুটি অভিযোগের কথা ছিল। হ্যাঁ, এখানে তারা ব্যাপকভাবে অনেক কিছুর তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যদিও আমি ২০২১ সালের আগস্টে ডয়েচে ভেলেতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রতিটি বিষয় ধরে ধরে, বিভিন্ন এভিডেন্স দিয়ে বলেছিলাম যে আলজাজিরা যেটি প্রচার করেছে, সেটি সঠিক নয়। ভুল তথ্য দিয়ে তারা সেটি প্রচার করেছে।
প্রথম অভিযোগের বিষয়ে সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, আমার সেই ভাই কিন্তু ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশের বাইরে। সে বৈধ ডকুমেন্ট নিয়েই বাংলাদেশের বাইরে গিয়েছে। আমি তাকে চলে যাওয়ার জন্য সহযোগিতা করেছি, এই অভিযোগ আমি মেনে নিতে পারছি না। এটি আমার জন্য প্রযোজ্য নয় বলে মনে করি।
দ্বিতীয় অভিযোগটির বিষয়ে আমি আপনাদের মাধ্যমে আবারও বলতে চাই, আমি চার বছর বিজিবির ডিজি ছিলাম। তিন বছর সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলাম। এই সাত বছরে বিজিবিতে অথবা সেনাবাহিনীতে আমার কোনো ভাইকে আমি কোনো একটা কন্ট্রাক্ট দিয়েছি কি না, এটার কোনো প্রমাণ কেউ আমাকে দেখাতে পারবে কি না? আমি দেইনি। কেউ যদি তদন্ত করে প্রমাণ আনতে পারে যে আমি বিজিবিতে কিংবা সেনাবাহিনীতে আমার ভাইকে কোনো কন্ট্রাক্ট দিয়েছিলাম, তাহলে আমি যেকোনো কনসিকুয়েন্স মেনে নিতে প্রস্তুত আছি।
আমি চার বছর বিজিবিতে ছিলাম। আমি চাইলে কি তাদের বিজিবির লাইসেন্স করে দিতে পারতাম না? আমি সেনাপ্রধান ছিলাম। আমি চাইলে কি ডিজিডিপিতে (প্রতিরক্ষা ক্রয় মহাপরিদপ্তর) লাইসেন্স করে দিতে পারতাম না?
আমার কোনো ভাইয়ের সেনাবাহিনী বা বিজিবিতে ঠিকাদারি করার জন্য কোনো ধরনের লাইসেন্স আছে কি না, বা তাদের কোনো কন্ট্রাক্ট দিয়েছি কি না, আপনারা খুঁজে বের করুন। যদি কন্ট্রাক্টই না দিয়ে থাকি, তাহলে সেখানে করাপশনের কথা কেন মেনে নেব? অবান্তর। আল জাজিরাও একই জিনিস বলেছিল যে হাঙ্গেরি থেকে স্পাইওয়্যার, যে সিগন্যাল ইকুইপমেন্ট কেনা হয়েছিল, সেটির কন্ট্রাক্ট নিয়ে আমি দুর্নীতি করেছি।
আজিজ আহমেদ বলেন, এখানে দুটো বিষয় হলো কাকতালীয়। এটাকে তারা লিংক করেছে খুব ইম্যাচিওরড ওয়েতে।
তিনি বলেন, ইকুইপমেন্টটা কেনা হয়েছে হাঙ্গেরি থেকে। আমার ওই ছোট ভাইটা হাঙ্গেরিতে থাকত। এটাকে লিংকআপ করিয়েছে যে হয়ত আমার ভাইয়ের মাধ্যমে এটা করা হয়েছে।
সেকেন্ড যেই জিনিসটা হলো- ২০১৮ সালের ২৫ জুন আমি দায়িত্বভার গ্রহণ করি। ২৬ জুন কন্ট্রাক্ট সাইন হয়েছে। কে সই করিয়েছে? সেনাসদর না। ডিজিডিপি করেছে। তারা এটি করেছে কন্ট্রাক্টরের সাথে। মিলিটারি হার্ডওয়্যার কেনার জন্য যে কন্ট্রাক্ট হয়, সেটার টেন্ডার বা অন্য কিছু ডিজিডিপি করে থাকে। ডিজিডিপি আর্মি হেডকোয়ার্টারের অধীনে নয়, মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্সের অধীনে। তো তারা কন্ট্রাক্ট করেছে ২৬ তারিখ, সেটি তো আমার জানার কথা নয়। আমি ২৫ তারিখে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি।
এখন ওই ইকুইপমেন্টের কথায় আসি- ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ডিপিকেও থেকে আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের কাছে জানতে চাওয়া হয় যে আমাদের একটা স্পেশাল সিগন্যাল কোম্পানি ডি আর কঙ্গোতে মোতায়েন করা হবে। আপনারা সেখানে ইকুইপমেন্ট দিতে পারবেন কি না? এই মিশনের সংক্ষিপ্ত নাম মনোস্ক। ওইটার সাথে যে ইকুইপমেন্ট রিকয়্যারমেন্ট ছিল সেটি স্বাক্ষর করেছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাকসুদ আহমেদ। তিনি ছিলেন তখন মিলিটারি অ্যাডভাইজর ফর পিস অপারেশন।
সাবেক সেনাপ্রধান আরও বলেন, ২০১৭ সালের মার্চে একটি অফিসার পর্ষদ গঠন করা হয়। তাদের এই ইকুইপমেন্ট কোথায় পাওয়া যাবে, সেটি খুঁজে দেখতে বলা হয়। ২১ সেপ্টেম্বর তারা এই ইকুইপমেন্ট কোন দেশে পাওয়া যাবে, দাম কেমন পড়বে তার সবকিছু জিএসপিসিতে উপস্থাপন করে অনুমোদনের জন্য পাঠায়। ২০১৮ সালের ৪ জুন এফডি থেকে এর অনুমোদন আসে। ২৬ জুন ডিজিডিপি কন্ট্রাক্ট সাইন করে।
এই যে প্রসেসটা বললাম, সেখানে কোথায় আমি ছিলাম বা আমার এখানে ইনফ্লুয়েন্স করার মতো কোনো কিছু ছিল? এই পুরো প্রসেসের কোথাও তো আমি ছিলাম না।
আমি ২৫ তারিখে দায়িত্ব নিলাম, ২৬ তারিখে কন্ট্রাক্ট সাইন হয়েছে। তো কীভাবে আমি আমার ভাইকে কন্ট্রাক্ট দিলাম? কীভাবে আমি সেখান থেকে ঘুষ নিয়ে দুর্নীতি করলাম?
আপনার নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বিষয়টি সেনাবাহিনীর, তারাই বিষয়টি দেখবে- পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোন প্রেক্ষাপটে কি বলেছে, সেটি তাদের বিষয়। আর সেনাবাহিনীর বিষয়গুলো সেনাবাহিনী দেখবে। এখানে আমার মন্তব্য করার কিছু নাই।
তিনি বলেন, আমি ডিজি বিজিবি ও সেনাপ্রধান থাকার সময়, এমনকি এখনও আমি একটি বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকি। সেটি হলো- আমি দুটি প্রেস্টিজিয়াস ইনস্টিটিউশনকে নেতৃত্ব দিয়েছি। আর্মি, বিজিবি। অবসর নেওয়ার পর অনেকে আমাকে চাকরির অফার করেছে। আমি যাইনি। কারণ, আমি এখনও এই দুটো ইনস্টিটিউশনের প্রতিনিধিত্ব করি। আমি যদি এখন কোথাও চাকরির জন্য যাই, তাহলে ওই ইনস্টিটিউশনকে হেয় করা হবে। কারণ ওই রকম অ্যাপ্রোপ্রিয়েট জব আমি পাবো না।
আমি সবসময়ই সতর্ক থেকেছি, আমার কোনো কর্মকাণ্ডে যাতে এ দুটো বাহিনীর কোনো ধরনের সুনাম ক্ষুণ্ন না হয়। আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে চাই, আমি এমন কিছু করিনি, যাতে বিজিবি বা সেনাবাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন হয়।
আপনি সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনী নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি আমি মানতে নারাজ। কারণ একেক সেনাপ্রধানের সময় দেশের পরিস্থিতি, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি একেক ধরেনের ছিল। একেকজন একেক ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন।
বিরোধী দলের প্ররোচনা বা লবিংয়ের কারণে এই নিষেধাজ্ঞা হতে পারে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেখেন, প্রথম কথা হলো আমি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি নই। রাজনীতিবিদরা কি চিন্তা করেন, কোন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কি মন্তব্য করেন, সেটির সাথে আমি পরিচিত না। এটি উনারাই ভালো জানেন। আর এটি নিয়ে কেউ পলিটিক্স করে কি না, সে বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না।
তবে আমি একটি কথা বলব, এটি আমার ব্যক্তিগত মতামত- আমি বর্তমান সরকারের সেনাপ্রধান ছিলাম। সেই সরকারের সেনাপ্রধান অবসরে আসার পর যখন এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা পায়, আমি তো মনে করি এখানে সরকারকে কিছুটা হলেও বিব্রত করার জন্য বা হেয় করার জন্য এই রেস্ট্রিকশনটা হতে পারে।
তিনি বলেন, আমি যেটা মনে করি- দুটি অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা আমার দৃষ্টিতে অবিচার করা হয়েছে। আমি এতটুকুই বলব।