সিসা-মেশানো হলুদ: বাংলাদেশ যেভাবে মশলায় ঘাপটি মেরে থাকা নীরব ঘাতককে নির্মূল করল
হরেক পদের রঙিন, মসলাযুক্ত খাবারের জন্য বাংলাদেশের সুনাম আছে। রঙিন খাবার তৈরির মূল উপাদান শুকনো বা গুঁড়া হলুদের উজ্জ্বলতা বাড়াতে একসময় হলুদে নিয়মিত সিসা [লেড ক্রোমেট] মেশাতেন ব্যবসায়ীরা। এতে হলুদের রঙের উজ্জ্বলতা ও বিক্রি বাড়লেও এই বিষাক্ত সিসা মেশানো হলুদ ছিল স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
তবে অত্যন্ত কার্যকরী এক কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশ মাত্র দুই বছরের মধ্যে সফলভাবে হলুদের ব্যবসা থেকে সিসা দূর করতে পেরেছে।
কর্তৃপক্ষ বলছে, সিরিজ মিটিংয়ের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি, নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে অবৈধভাবে হলুদে রং মেশানো ব্যবসায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা ও হলুদ গুঁড়া করার মিলগুলোর মালিকদের প্রশিক্ষিত করা এবং সারা দেশের মানুষের মধ্যে গণসচেতনতা তৈরির মধ্য দিয়ে হলুদকে সিসামুক্ত করার উদ্যোগে সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে মাত্র দুই বছরের মাথায় বাংলাদেশের বাজারে সিসাযুক্ত হলুদের পরিমাণ ৪৭ শতাংশ থেকে কমে ০ (শূন্য) শতাংশে নেমে আসে। আর দেশের জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব পড়ে প্রায় তাৎক্ষণিকই।
এর ফলে হলুদ কারখানার শ্রমিকদের রক্তে সিসার পরিমাণ গড়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায় বলে উঠে এসেছে এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণায়।
নিউইয়র্কভিত্তিক পরিবেশবিষয়ক এনজিও পিউর আর্থ-এর এক প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে মাত্র ১ ডলার খরচে স্বাস্থ্যকর জীবনে বাড়তি এক বছর যোগ করা গেছে। অন্যদিকে সরাসরি আর্থিকভাবে একই সাফল্য পেতে হলে আনুমানিক ৮৩৬ ডলার খরচ করতে হতো।
বাংলাদেশ সরকারের এই উদ্যোগ ও সাফল্য এখন সারা বিশ্বে প্রশংসিত, বিশেষ করে সিসা দূষণে জর্জরিত প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রশংসা পেয়েছে বেশি।
ব্রিটিশ সাপ্তাহিকী 'দি ইকোনমিস্ট'-এ নভেম্বরে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অধিকতর উন্মুক্ত ও বাস্তবধর্মী উদ্যোগ থেকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের অনেককিছু শেখার আছে।
ওই নিবন্ধে বলা হয়, 'উন্নয়নশীল দেশগুলোর অজস্র স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত সমস্যা আছে, যার সমাধানে সাহায্য করতে পারে এটি। এসব অনেকগুলো কারণে এই উদ্যোগকে টিকিয়ে রাখা এবং ব্যাপকভাবে অনুকরণ করা উচিত।'
মার্কিন সংবাদ ওয়েবসাইট সেপ্টেম্বরের এক প্রতিবেদনে বলেছে, 'কোনো বড় স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধে এমন দ্রুত, বিচক্ষণ পদক্ষেপ গ্রহণের ঘটনা বিরল।'
মানবদেহের যেসব ক্ষতি করে সিসা
শুকনো বা গুঁড়া হলুদের উজ্জ্বলতা বাড়াতে পণ্যটির প্রসেসিংয়ের সময় ব্যবহার করা হতো লেড ক্রোমেট, যা স্থানীয়ভাবে পিউরি, পিপড়ি, বাসন্তি রং, কাঠালি বা সরষে ফুল রং নামে পরিচিত। এই চর্চাকে হলুদ পলিশিং বলা হয়।
এই পলিশড হলুদ খাওয়ায় মানুষের রক্তে উচ্চ মাত্রার সিসার উপস্থিতি পাওয়া যায়, যা বিশেষ করে শিশুদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এতে শিশুদের বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক-ট্যাংক সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত দেশগুলোর শিশুদের তুলনায় দরিদ্র দেশগুলোর শিশুদের ২০ শতাংশ শিক্ষণ ঘাটতির (লার্নিং গ্যাপ) পেছনে শিশুদের বিষাক্ত সিসার সংস্পর্শে আসার সম্পর্ক রয়েছে।
সিসা মেশানো হলুদের সন্ধান যেভাবে পাওয়া গেল
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ-এর (আইসিডিডিআরবি) প্রকল্প সমন্বয়কারী ড. মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ২০১৪-২০১৫ সালের দিকে তারা ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুরসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় একটি গবেষণা করতে গিয়ে প্রায় ৫০০ গর্ভবতী মায়ের রক্তে সিসার হার কীরকম, তা মেপে দেখে। এতে ৩১ শতাংশ গর্ভবতী মায়ের রক্তে সিসার পরিমাণ বেশি পাওয়া যায়, যা রেফারেন্স ভ্যালুর চেয়ে অনেক বেশি।
'তখন আমরা গ্রাম এলাকায় সিসা কোত্থেকে এলো, তা ভেবে অবাক হয়ে গেলাম। তখন আমরা এক্সপ্লোর শুরু করি, অনেক কিছু টেস্ট করি; যেমন মসলা, ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন, সয়েল। টেস্ট করার পর আমরা হলুদে সিসা পাই, যে হলুদটা তারা খায়।'
২০১৯ সালে বাংলাদেশি শিশু এবং নিউইয়র্কে বসবাসকারী প্রাপ্তবয়স্কদের রক্তে উচ্চমাত্রার সিসার উপস্থিতি পাওয়া যাওয়ার পর এই সমস্যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মনোযোগ পায়। নিউ ইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অভ হেলথ অ্যান্ড মেন্টাল হাইজিন (ডিওএইচএমএইচ) দীর্ঘ ১০ বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাদের রক্তে উচ্চমাত্রার এই সিসার উপস্থিতির জন্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা মশলাকেই চিহ্নিত করেছে।
এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ডিওএইচএমএইচ কর্তৃপক্ষ নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেট দপ্তরে ২০১৯ সালের মার্চে একটি চিঠি পাঠায়। ওই চিঠির সূত্র ধরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একই বছরের ১৭ জুন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে (বিএফএসএ) তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে দেখতে পায়, হলুদে সিসার উপস্থিতির জন্য দায়ী মূলত রঙের ব্যবহার। পরবর্তীতে সংস্থাটি গণবিজ্ঞপ্তি জারির মধ্য দিয়ে হলুদে রঙের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশে হলুদে বিষাক্ত সিসা মেশানো নিয়ে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও আইসিডিডিআরবি একই সময়ে গবেষণা শুরু করে।
সরকারের সর্বাত্মক পদক্ষেপ
ড. মাহবুবুর জানান, তারা বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিলে যৌথভাবে কাজ করেন।
তারা একসঙ্গে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক, মনিটরিং ভিজিট, রেগুলেটরি পদক্ষেপ, সংবাদমাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তার বিজ্ঞাপন দেন। 'আমরা ঢাকা ও ঢাকার বাইরের পাইকারি বাজার পরিদর্শন করে সিসাযুক্ত হলুদ ধ্বংস করে সেটি মিডিয়াতে ভালোভাবে প্রচার করি। মিডিয়া, স্থানীয় প্রশাসন সবাই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।'
এছাড়া নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ দেশে হলুদে ভেজাল মেশানোকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে বলেও জানান ড. মাহবুবুর। বড় একটি হলুদ প্রক্রিয়াজাত কারখানায় সরকারি অভিযান টেলিভিশনে প্রচার করা হয়। মৌলভীবাজারে রংমিশ্রিত হলুদ বিক্রির দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে দুই পাইকারি ব্যবসায়ীর দণ্ড দেওয়া হয়।
এছাড়া গণমাধ্যমে চালানো প্রচারণায় সিসা মেশানো হলুদের ভয়াবহতা নিয়ে গ্রাফিক কনটেন্টের মাধ্যমে দর্শকদের সতর্ক করা হয়। এ সমস্যার বিষয়ে জাতীয় টেলিভিশনে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাজার ও পাবলিক এরিয়াগুলোতে হলুদে সিসা-বিষ নিয়ে প্রায় ৫০ হাজার বিজ্ঞপ্তি লাগানো হয়। কারখানা থেকে শ্রমিকদের রক্ত সংগ্রহ করে গবেষকেরা শ্রমিকদের দেহের বিভিন্ন রোগের সঙ্গে সিসার সম্পর্ক দেখিয়ে গবেষণার ফল প্রকাশ করেন।
সরকারের উদ্যোগের প্রশংসা করে ইকোনমিস্ট-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমস্যা সমাধানের এই স্বল্প ব্যয়ের সমন্বিত ও নিরলস পদ্ধতিটি গত দুই দশকে বাংলাদেশের অসামান্য উন্নয়ন সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে এসে। 'আর এর কৃতিত্ব শেখ হাসিনার প্রাপ্য।'