আক্রান্ত বাড়ছে, সক্ষমতা সীমিত: সরকারের ডেঙ্গু প্রতিরোধ কৌশলে যা আছে
মৌসুমি ডেঙ্গু এখন বছরব্যপী রোগে পরিণত হয়েছে। আগে এ রোগটি শুধু ঢাকা শহরকেন্দ্রিক হলেও এখন প্রত্যন্ত গ্রামসহ সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
২০২৩ সালে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ২৩ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ডেঙ্গুতে মারা যাওয়াদের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সি ছিল ১৬৬ জন।
প্রিয়জন হারানো এবং চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে পরিবারগুলি মানসিক ও আর্থিক চাপের মুখে পরে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি সংস্থাগুলোর একের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানোর প্রবণতার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, মশা মারার কাজ তাদের নয়, রোগী সামলানো আমাদের কাজ। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মশা জরিপের বা রোগীর তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশই তাদের এলাকায় রোগী কম দেখানোর চেষ্টা করে।
এছাড়া ডেঙ্গু মোকাবিলাবিষয়ক আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকেন না স্থানীয় সরকারের কোনো প্রতিনিধি। এতে সমন্বয়হীনতা আরও বাড়ে বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে এসবের মধ্যে একটি ইতিবাচক খবর হলো, এবারই প্রথমবারের মতো জাতীয় ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কৌশলপত্রের (২০২৪-২০৩০) খসড়া করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
তবে এই কৌশলপত্র ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কৌশলপত্র করা হয়েছে অনেকটাই নিরাময়ের দিককে টার্গেট করে, প্রতিরোধে গুরুত্ব কম। ডেঙ্গু যেহেতু ভেক্টরবাহিত রোগ, তাই ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের ওপর জোর না দিলে এই পরিকল্পনা খুব বেশি কাযর্কর হবে না বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাদের মূল সমস্যা হলো আমরা প্রিভেন্ট [প্রতিরোধ] করতে পারছি না। যারা রোগী হচ্ছে, তাদের চিকিৎসা দিতে কিন্তু অত সমস্যা হচ্ছে না। রোগী অনেক বেশি হচ্ছে। প্রতিরোধের জায়গায় বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।'
বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ২০২৩ সালে কালাজ্বর নির্মূল করেছে বাংলাদেশ। কালাজ্বর নির্মূলে একক মন্ত্রণালয় হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাজ করেছে। তাহলে ডেঙ্গু মোকাবিলায় কেন সফল হতে পারছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়?
এ বিষয়ে অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, 'বাংলাদেশে অনেক রোগ আছে যা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একা কাজ করে—যেমন, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া। সেরকম যদি ডেঙ্গু মোকাবিলায়ও হয়, তাহলে সেটিও বলতে হবে যে স্বাস্থ্য বিভাগ এটি একাই করতে চায়। আর সেটি করতে হলে ব্যাপক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বরাদ্দ বাড়াতে হবে, জনবল নিয়োগ দিতে হবে।
'কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণে আমরা হাজার হাজার স্প্রে-ম্যান নিয়োগ দিয়েছিলাম। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে কোটি কোটি মশারি বিতরণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থায়নের মাধ্যমে বিপুল বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু ডেঙ্গুতে তো সেই বরাদ্ধ নেই। তার মানে এটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।'
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৯৬০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এটি তখন 'ঢাকা ফিভার' নামে পরিচিত ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটে ২০০০ সালের জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যে।
২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রতি বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হচ্ছে। দেশে ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপই ধরা পড়েছে। ২০১০ সাল থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটতে থাকে মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষাকাল এবং উচ্চ তাপমাত্রার সময়।
এরপর ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে ভয়াবহ পরিস্থিতি অতিক্রম করে দেশ। আর ২০২২ ও ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ১ হাজার ৭০৫ জন, আক্রান্ত হয় ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ২৮১ জন, আক্রান্ত হয় ৬২ হাজার ৩৮২ জন।
শীতকালে সাধারণত ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে। সে কারণে এখন রোগী বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় কিছুটা কমে এসেছে। তবে এখনও প্রতিদিন গড়ে একজন করে ডেঙ্গুতে মারা যাচ্ছে।
এর আগে জানুয়ারিতে ডেঙ্গুতে মৃত্যু কম ছিলো। চলতি বছরের প্রথম ৪ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছ ২৯০ জন ও মারা গেছে ৩ জন।
বিশেষজ্ঞরা গত বছর থেকেই বলে আসছেন, চলতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। এরইমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্ষা-পরবর্তী সর্বশেষ মশা জরিপের ফলাফলও সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গত ৮ থেকে ১৮ ডিসেম্বর পরিচালিত মশা জরিপে উঠে এসেছে, ঢাকার দুই সিটিতে এডিসের লার্ভার উপস্থিতি গত বছরের বর্ষা-পরবর্তী সময়ের চেয়ে তিনগুণ বেড়েছে।
টিকার জন্য অপেক্ষা?
বাংলাদেশের মতো বিশ্বের যেসব দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি, ওই সব দেশ এরই মধ্যে ডেঙ্গুর টিকা প্রয়োগ শুরু করেছে। তবে ব্যাপক ব্যবহারের উপযোগী টিকার জন্য নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর অপেক্ষা কিছুটা দীর্ঘ হতে পারে।
খরচ অন্যতম মূল উদ্বেগের বিষয় হলেও টিকার ট্রায়াল এখনও শেষ হয়নি।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক বসবাসকারী দেশগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ রয়েছে। তবে এশিয়ার দেশগুলো বিশ্বের মোট ডেঙ্গুর ৭০ শতাংশের জন্য দায়ী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুর মাত্র দুটি টিকার অনুমোদন দিয়েছে—ফরাসি ওষুধ উৎপাদনকারী সানোফি পাস্তুরের ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া এবং জাপানের তাকেদা ফার্মার কিউডেঙ্গা। দুটি টিকাই আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তিদের জন্য।
ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রায় ২০টি দেশে অনুমোদিত। আর কিউডেঙ্গা ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল ও যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে অনুমোদন পেয়েছে।
ব্রাজিলের ডোরাডোস শহর ৩ জানুয়ারি একটি গণ ডেঙ্গু টিকাদান কর্মসূচি শুরু করেছে। এ কর্মসূচির আওতায় ৪ থেকে ৫৯ বছর বয়সি দেড় লাখ মানুষকে ৩ মাসের ব্যবধানে ডেঙ্গু টিকার দুটি ডোজে দেওয়া হবে।
গ্লোবালডেটার প্রাইস ইন্টেলিজেন্স বলছে, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ায় কিউডেঙ্গার দাম ৯৫ ডলার থেকে ১৫৮ ডলার।
ফার্মাসিউটিক্যাল টেকনোলজির একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, জাপানের তাকেদার প্রধান নির্বাহী উদীয়মান বাজারগুলোর জন্য কিউডেঙ্গার দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। ব্রাজিলে কম দামে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হচ্ছে। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া ইউরোপের দামের তিন ভাগের এক ভাগ দামে টিকাটি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। নিবন্ধে বলা হয়েছে, কোভিড টিকা টিকা দেওয়ার জন্য গাভি-র মতো আন্তর্জাতিক সহায়তা উদ্যোগগুলো বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে জাতীয় টিকাদান ব্যবস্থায় ডেঙ্গু টিকা অন্তর্ভুক্ত করতে সহায়তা করতে পারে।
বিভিন্ন দেশ নিজেদের উদ্যোগেও টিকা তৈরির চেষ্টা করছে।
ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট অভ ইন্ডিয়া তাদের ডেঙ্গু টিকা ডেঙ্গুসিল নিয়ে কাজ করছে। এছাড়া ইন্ডিয়ান ইমিউনোলজিক্যালস লিমিটেড ২০২৬ সালের প্রথমদিকে বাণিজ্যিকভাবে তাদের ডেঙ্গু টিকা বাজারে আনবে বলে আশা প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআরবি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অভ ভার্মন্ট-এর লার্নার কলেজ অভ মেডিসিনের সঙ্গে এক ডোজের টেট্রাভ্যালেন্ট ডেঙ্গু টিকা টিভি০০৫ তৈরি করতে কাজ করছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু রোগের টিকার সফল পরীক্ষা হয়। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরনের বিরুদ্ধেই—ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪—এই টিকা অ্যান্টিবডি তৈরিতে সাফল্য দেখিয়েছে। টিকার
গবেষকরা তখন বলেছিলেন, টিভি০০৫-এর তাৎপর্য হচ্ছে, এই টিকার একটি ডোজই সুরক্ষা দিতে পারে এবং ডেঙ্গুর চারটি ধরনের বিপরীতেই ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যথেষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া তিন ডোজের এবং কিউডেঙ্গা দুই ডোজের টিকা।
আইসিডিডিআরবি এবং ইউনিভার্সিটি অভ ভার্মন্টের গবেষকরা আশা প্রকাশ করেছেন যে তাদের টিকা বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে অবদান রাখবে।
তবে টিকাটি কবে নাগাদ বাজারে আসতে পারবে, তা এখনও জানা যায়নি।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কৌশলপত্র
জাতীয় ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কৌশলপত্রের খসড়ায় বলা হয়েছে, পূর্বাভাস ও প্রস্তুতির জন্য প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কৌশলে টিকাকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
খসড়ায় ছয়টি কৌশল বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে।
কৌশলগুলোর এসবের মধ্যে আছে চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, ডেঙ্গু পর্যবেক্ষণব্যবস্থা ও বাস্তব সময়ে তথ্য দেওয়ার পদ্ধতি শক্তিশালীকরণ, টাস্কফোর্স গঠনসহ বহুপক্ষের কাজের সমন্বয়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কাজের সমন্বয়, সমন্বিত কীট ব্যবস্থাপনাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং টিকা উদ্ভাবনসহ গবেষণাকাজ বাড়ানো।
চিকিৎসা কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক খবিরুল বাশার টিবিএসকে বলেন, কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করাই যথেষ্ট নয়, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নও করতে হবে।
'স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় হচ্ছে কৌশলটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্যতম মূল স্টেকহোল্ডার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে এটি বাস্তবায়ন করলে ফল পাওয়া যাবে। অন্যথায় ফল পাওয়া কষ্টসাধ্য,' বলেন তিনি।
খবিরুল বাশা আরও বলেন, 'আমাদের পর্যাপ্ত জনবল নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় জনবল, কীটনাশক, কীটনাশক ব্যবহারের যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে।'