বিদেশে কর্মী নিয়োগ বাড়ছে, গত বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে
চলতি বছরের প্রথম তিনমাসে বিদেশে বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েছে। নিয়োগকারীদের আশা, এই ধারা অব্যাহত থাকলে এ বছর বিদেশে কর্মী পাঠানোর সংখ্যা গত বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।
চলতি বছরের প্রতিমাসেই বিদেশে কর্মী পাঠানোর সংখ্যা বেড়েছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে মাসিক রেমিট্যান্স আয়ের পরিমাণও। ছয় মাস পর চলতি বছরের মার্চে দেশের রেমিট্যান্স আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ বিলিয়ন ডলারে।
এ বছরের প্রথম তিন মাসে দেশ থেকে প্রায় ৩.২৩ লাখ কর্মী বিদেশে গিয়েছেন। এরমধ্যে জানুয়ারিতে গিয়েছেন প্রায় ১.০৪ লাখ, ফেব্রুয়ারিতে ১.০৯ এবং মার্চে গিয়েছেন ১.০৯ লাখ। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুসারে, মাসভিত্তিতে অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার জানুয়ারিতে ছিল ৬.২০ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ৪.৩৫ শতাংশ এবং মার্চে ছিল ০.৩৫ শতাংশ।
গত বছর বাংলাদেশ রেকর্ড ১১.৩৫ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে। কর্মী পাঠানোর বর্তমান ক্রমবর্ধমান ধারা অব্যাহত থাকলে এ বছর বাংলাদেশ গেল বছরের রেকর্ড ভাঙতে সক্ষম হবে বলে আশা করছেন জনশক্তি রপ্তানিকারকরা।
মালয়েশিয়ার বাজার পুনরায় খুলে দেওয়ায় সম্প্রতি বিদেশে কর্মী পাঠানোর সংখ্যা বেড়েছে। সৌদি আরবের পর একমাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ দিয়েছে মালয়েশিয়া।
চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছেন প্রায় ১.২২ লাখ (৩৮ শতাংশ) কর্মী; আর মালয়েশিয়াতে গিয়েছেন ৮২,৯৮৩ জন (২৬ শতাংশ)।
এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ইতালি এবং যুক্তরাজ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধিও চলতি বছরে অভিবাসী শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
বিএমইটির তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালের প্রতিমাসে ৯৩,৭৫০ জন কর্মী বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, যেখানে কোভিড পূর্ববর্তী সময়ে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০,০০০।
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মতে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশি কর্মীরা মালয়েশিয়ায় যেতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কারণ এই দেশের আবহাওয়া প্রায় বাংলাদেশের মতোই এবং বেতনও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যদেশের তুলনায় বেশি।
মালয়েশিয়া সরকারের নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী, দেশটিতে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত একজন কর্মী মাসিক কমপক্ষে ১,৫০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭,০০০ টাকা) বেতন পাবেন। অন্যদিকে, সৌদি আরবে স্বল্প-দক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিকরা বেতন পান ২৫,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকা।
বর্তমানে মালয়েশিয়ায় কৃষি, উত্পাদন, পরিষেবা, খনি, নির্মাণ ও গৃহস্থালি পরিষেবাসহ সব সেক্টরেই বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
"সৌদি আরবে অভিবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকরা মূলত নির্মাণ ও পরিচ্ছন্নতা খাতে এবং হোটেল ও রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। এছাড়া, কিছু সংখ্যক স্বল্পদক্ষ কর্মী যেমন- প্লাম্বার, ইলেকট্রিশিয়ান এবং ড্রাইভারও সেখানে নিয়োগ পাচ্ছেন," বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা)-এর সেক্রেটারি-জেনারেল আলী হায়দার চৌধুরী টিবিএসকে এ কথা বলেন।
সৌদি আরবে অভিবাসী অনেক শ্রমিক চুক্তি অনুযায়ী কাজ পাচ্ছেন না এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, "এই সংখ্যাটা সেখানে মোট বাংলাদেশি শ্রমিকের ০.১%-এর বেশি হবে না। মূলত, যারা আত্মীয়-স্বজনদের সহায়তায় তথাকথিত 'ফ্রি ভিসায়' যাচ্ছেন, তারাই এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।"
মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও বাড়ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ
মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, যুক্তরাজ্য ও ইতালিসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে বিগত বছরের তুলনায় এ বছর বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে।
বাংলাদেশ থেকে গত তিনমাসে দক্ষিণ কোরিয়া ১,৬৯৮ জন কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। গত বছর মোট নিয়োগ পেয়েছিল ৫,৯১০ জন কর্মী।
এদিকে, যুক্তরাজ্যে গত বছর পাড়ি দিয়েছিলেন ৯৪২ বাংলাদেশি কর্মী; আর এ বছরের প্রথম তিন মাসেই সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৭১ জনে।
ইউরোপে কর্মী প্রেরণকারী সংস্থা ইনফিনিটি এইচসিএম-এর সিইও সিরাজুল আমিন বলেন, যুক্তরাজ্যে প্রধানত বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পেশাজীবী যেমন- ডাক্তার, প্রকৌশলী এবং আইটি পেশাদারদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, ইতালি নিয়োগ দিচ্ছে মৌসুমী কৃষি শ্রমিক।
এই দুই দেশ ছাড়াও প্রতিমাসে কিছু সংখ্যক কর্মী রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, পোল্যান্ড, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি, মাল্টা ও আলবেনিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছেন।
এশিয়ার দেশ জাপানে দক্ষ কর্মীর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এ বছরের প্রথম তিনমাসে বাংলাদেশ থেকে ১৯৩ জন কর্মী জাপানে গিয়েছেন। বিএমইটির আশা, চলতি বছরে এই সংখ্যা হাজার ছাড়াবে।
সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০২২ সালে ৫০৮ জন কর্মী নিয়োগ পেয়েছিলেন জাপানে, যা ছিল এক বছরে সর্বোচ্চ।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জাপানে নার্সিং, কৃষি, পরিচ্ছন্নতা এবং নির্মাণখাতে 'স্পেসিফাইড স্কিল্ড ওয়ার্কার্স' (এসএসডব্লিউ) নিয়োগের জন্য এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দক্ষতা যাচাই পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণা করেছে।
জাপানে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে ও এক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা আনতে গতমাসে সরকার জাপানে অভিবাসনের খরচ নির্ধারণ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে জাপানে যেতে এখন অভিবাসন খরচ হবে প্রায় ১ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।
বাড়ছে রেমিট্যান্স প্রবাহ
অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়লেও গত বছর কিছু সময়ের জন্য দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ তুলনামূলকভাবে কম ছিল। বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) রেমিট্যান্স রেট ১০৭ টাকায় কমিয়ে আনার পর, গেল বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ৬ মাস পর্যন্ত মাসিক রেমিট্যান্স প্রবাহ নেমে গিয়েছিল ২ বিলিয়ন ডলারের নিচে।
তবে চলতি বছরের মার্চে মাসিক রেমিট্যান্স প্রবাহ আবারও বেড়ে ২ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ব্যাংকগুলো এখন ডলারপ্রতি ১১৭ টাকা করে দেওয়া শুরু করায় রেমিট্যান্স প্রবাহ পুনরায় বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, মার্চে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে ২৯.২৯ শতাংশ, যা আগের মাসে ছিল ১.৫ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে, গত ১০ এপ্রিল পাকিস্তনের গণমাধ্যম জিও নিউজের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রমজান এবং ঈদ উপলক্ষে এ বছরের মার্চে পাকিস্তানে রেমিট্যান্স প্রবাহ বিগত সাত মাসের সর্বোচ্চ হয়েছে। আড়াই বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে রেমিট্যান্স।
এছাড়া প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিদেশে অবস্থানরত নন-রেসিডেন্ট পাকিস্তানীরা এবার বৈধ চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। আন্তঃব্যাংক ও খোলা বাজারে হারের মধ্যে তারতম্যের কারণে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোয় দেশটিতে তুলনামূলকভাবে এবার রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল বেশি।