দশ হাজার বহুতল ভবনের মধ্যে চট্টগ্রামে পরিবেশ ছাড়পত্র আছে মাত্র ১০২টির!
চট্টগ্রামে ভবনের সংখ্যা ১ লাখ ৮৪ হাজার। এর মধ্যে বহুতল ভবনের সংখ্যা দশ হাজারের বেশি। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুসারে রাজধানীর বাইরে ছয়তলার অধিক উচ্চতার বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়েছে এমন বহুতল ভবনের সংখ্যা মাত্র ১০২টি।
চট্টগ্রাম শহরে কোনো ভবন নির্মাণ করতে হলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) থেকে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্রসহ নকশার অনুমোদন নিতে হয়। এক্ষেত্রে নকশা অনুমোদনের আগে সিভিল এভিয়েশনের ছাড়পত্র, জমির শ্রেণী যাচাই, অগ্নিনিরাপত্তা-সংক্রান্ত ছাড়পত্র ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র যাচাই করে।
কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেয়ার বিধানটি ভবন মালিক বা ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলো কখনেই আমলে নেন না। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও বিষয়টি তেমনভাবে তদারক করা হয় না। ফলে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হওয়ার পরেও পরিবেশ ছাড়পত্রের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি মানা হচ্ছে না।
চট্টগ্রামে বহুতল ভবনের প্রকৃত হিসাব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে নেই (সিডিএ)। সংস্থাটির উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ঈসা আনসারী জানান, তারা প্রতিবছর প্রায় ২৫০০ ভবনের অনুমোদন দিয়ে থাকেন। এর মধ্যে ৩০ শতাংশই বহুতল ভবন। সে হিসেবে বর্তমানে চট্টগ্রামে বহুতল ভবনের সংখ্যা দশ হাজারের বেশি।
অপরদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরের কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে এমন বহুতল ভবনের সংখ্যা মাত্র ১০২টি। এর মধ্যে মহানগরে ১০০ ভবন মালিক পরিবেশ ছাড়পত্র নিয়েছেন; এছাড়া হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলায় দুটি ভবনের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের উপ-পরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ভবন নির্মাণের সময় পাহাড় কাটা বা পুকুর ভরাট হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত হতে হয়, যাতে এ কারণে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ভবন নির্মাণে বিনিয়োগের ভিত্তিতে একটি ফি পরিবেশ অধিদপ্তরে জমা দিয়ে ছাড়পত্র নিতে হয়। প্রথমবার ছাড়পত্র নেয়ার পর পরবর্তী বছর থেকে চারভাগের একভাগ ফি জমা দিয়ে নবায়ন করতে হয়।'
চট্টগ্রামের পরিচালক (উপসচিব) হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, 'পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী ভবন নির্মাণের জমির খতিয়ান ও শ্রেণী যাচাই, ভবনের লে-আউট, পরিবেশগত প্রভাব, ড্রেনেজ ও পয়ঃনিষ্কাসন পরিকল্পনা এবং ভার বহন সনদ যাচাই করে। এছাড়া তৈরী হতে যাওয়া বহুতল ভবনের পাশে নির্ধারিত চওড়া রাস্তা আছে কিনা, ভবনটি কোন স্থানে গড়ে তোলা হচ্ছে, ভবনের চারপাশে পর্যাপ্ত জায়গা খালি রেখে গড়ে তোলা হচ্ছে কি-না এমন অনেক বিষয় বিবেচনা করা হয়', বলেন হিল্লোল বিশ্বাস।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, বহুতল ভবন তৈরীতে পরিবেশগত সুরক্ষার জন্য এতসব বিধিমালা থাকলেও তার কোনোটাই মানছেন না ভবন মালিক ও ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষ করে বড় বড় ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলো অধিদপ্তরের অনুমোদন না নিয়ে ভবন তৈরী করে গ্রাহকদের বিপদে ফেলে দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে সিডিএ কেন পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই ভবন তৈরীর অনুমোদন দিচ্ছে সেটা জানতে চেয়ে আমরা তাদের চিঠি দিয়েছি।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ঈসা আনসারী বলেন, 'ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী ১০ তলার অধিক উচ্চতার ভবনগুলো বহুতল ভবন হিসেবে বিবেচিত। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসেবে সে উচ্চতা হবে ছয় তলা।'
তিনি বলেন, 'নিয়ম অনুযায়ী একটি ভবনের অনুমোদনের জন্য ১২টি সংস্থার অনুমোদন যাচাইয়ের বিষয় রয়েছে। তবে ভবন অনুমোদনের ক্ষেত্রে আমরা শুধু সিভিল এভিয়েশনের অনাপত্তির বিষয়টি বিবেচনা করি। আমাদের কাছ থেকে অনুমোদনের পর পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে ছাড়পত্র নেয়ার বিধান রয়েছে। কেউ যদি ছাড়পত্র না নেয় তাকে জরিমানা করা যেতে পারে।'
তবে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, 'শুধু জানুয়ারি মাসেই চট্টগ্রাম নগরে অভিযান চালিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকায় ১৪টি ভবনকে ৩৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। কিন্তু শুধু জরিমানা করে এত বিশাল বিষয় সামলানো সম্ভব নয়। এছাড়া জরিমানা দিয়ে পরিবেশের ক্ষতি মেটানো যায় না। তাই সিডিএকে নকশা অনুমোদনের আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন যাচাই করা উচিত।'
নগরীর এয়াকুব ফিউচার পার্ক আবাসিক এলাকার এস এম হেরিটেজের বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন বলেন, 'সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে আমরা ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান থেকে ফ্লাট ক্রয় করেছি। ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান বলেছিলো সব ধরনের ক্লিয়ারেন্স নেওয়া আছে। কিন্তু এখন পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে তাদের ছাড়পত্র নেয়নি। এ কারণে ভবনের সবাইকে জরিমানা গুনতে হচ্ছে।'
বিষয়টি স্বীকার করে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহ-সভাপতি মো. আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, 'ছাড়পত্র যদি নিতেই হয়, তাহলে সিডিএ অনুমোদন দেওয়ার আগেই নেওয়া উচিত। ভবন তৈরীর তিন বা পাঁচ বছর পর যদি পরিবেশের ছাড়পত্র চাওয়া হয় তা ভবন বা ফ্লাট মালিকদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়; অন্যের দায়ে জরিমানাটাও তাদেরই গুনতে হচ্ছে। আমরা রিহ্যাবের সকল সদস্যকে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়েই ভবনের কাজ করার জন্য বিশেষ নির্দেশনা দেবো।'
চুয়েট ইনস্টিটিউট অব আর্থকোয়েক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চের (ইইআরসি) পরিচালক ড. মুহাম্মদ আবদুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, 'চট্টগ্রামের অধিকাংশ বহুতল ভবন বেলে মাটির ওপর নির্মিত। তাই ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামে বহুতল ভবন নির্মাণে ঝুঁকি বেশি। এছাড়া বার্মা সাব-প্লেটের সংযোগস্থলে চট্টগ্রামের অবস্থান হওয়ায় ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতেও রয়েছে চট্টগ্রাম। এ অবস্থায় পরিবেশগত সমীক্ষা ব্যতীত ভবন তৈরী করা হলে তা হবে আত্মঘাতী।'