২০৩০ সাল নাগাদ ঢাকায় যানজট কমাতে বৃত্তাকার নৌপথের নতুন পরিকল্পনা
রাজধানীর সড়কে যানবাহনের চাপ কমাতে ২০০৪ সালে আশুলিয়া থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ওয়াটার বাসের যাত্রা উদ্বোধন করার কয়েক দিনের মাথায় বন্ধ হয়ে যায় সেবা। এপর্যন্ত চারবার এ নৌপথটি উদ্বেধান করা হলেও অব্যবস্থাপনা, নিম্নমানের ওয়াটার বাস আর যাত্রীর অভাবে এ পথটি কার্যকর না হওয়ায় এতে সরকারের ব্যয় করা ৯৪ কোটি টাকাই জলে গেছে।
লম্বা সময় আলোচনার বাইরে থাকা বৃত্তাকার নৌপথ আবার চালু করতে পাঁচ প্রধান নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা এবং টঙ্গী খালের নাব্যতা বাড়িয়ে আবার নৌপথ চালু করতে চাইছে সরকার।
ড্রেজিং, খনন, সীমানা পুনঃনির্ধারণ ও পানি শোধনের মাধ্যমে পরিবহন চালু করতে বিশ্বব্যাংক যে পরিকল্পনা দিয়েছে- তা বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ২৯০ কোটি ডলার। আর এতে প্রথম দফায় ৩০ কোটি ডলার দেবে সংস্থাটি।
এছাড়া নদী তীর ধরে ৯১ কিলোমিটার ইনার সর্কুলার রোড নির্মাণে দুইশ কোটি ডলারের বেশি ব্যয়ের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে সরকার। প্রায় একই পথে ৮১ কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণে ৮৩৭ কোটি ডলারের অর্থায়ন খুজছে সরকারের সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব কর্তৃপক্ষ (পিপিপি)।
এক এলাইনমেন্ট ধরে তিন প্রকল্পে ১৩.২৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সড়কে যানবাহন ও যাত্রীর চাপ বিবেচনায় বিকল্প পথের দরকার হলেও; একই এলাইনমেন্টে একাধিক পথ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে কখনই লাভবান হবে না। তাছাড়া একাধিক প্রকল্প হাতে নেোয়ার কারণে কোনটাই আলোর মুখ দেখছে না বলেও তারা মন্তব্য করেন।
রাজধানীর পূর্ব থেকে পশ্চিম ও উত্তর থেকে দক্ষিণে বিকল্প যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিভিন্ন সংস্থার চলমান সাত প্রকল্পের ব্যয় ধরা আছে আছে ১৬.৮১ বিলিয়ন ডলার।
এরই মধ্যে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের হেমায়েতপুর থেকে ঢাকা-মাওয়া রোডের কালাকান্দি হয়ে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু পর্যন্ত পৃথক একটি সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছে সওজ। ২৭০৫ মিলিয়ন ডলার প্রাথমিক ব্যয়ের প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা গবেষণা পরিচালনা করতে পরামর্শক নিয়োগের দরপত্রও প্রকাশ করেছে পিপিপি অফিস।
বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবিত বৃত্তাকার নৌপথ আর সওজের প্রস্তাবিত এ আউটার সার্কুলার রোডের ব্যয় ধরলে ঢাকার বিকল্প সড়ক নির্মাণে বিনিয়োগ দাঁড়ায় ২২.৪১ বিলিয়ন ডলার। দেশীয় মূদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার ৯৬ কোটি টাকা কোটি টাকা।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার তুলনায় ঢাকায় সড়কের পরিমাণ কম থাকায় এখানে যানবাহনের গতি পায়ে হাঁটা গতির প্রায় কাছাকাছি নেমে এসেছে বলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) ও বিশ্বব্যাংকের পৃথক গবেষণায় উঠে এসেছে।
দুই সংস্থার হিসাবে ঢাকায় যানজটে বছরে লোকসান হয় ৩-৫ শতকোটি ডলার। আর সরকারের হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৭.০৫ বিলিয়ন ডলার বা জিডিপির প্রায় দুই শতাংশ।
এ ক্ষতি এড়াতে প্রয়োজনের চাইতে বেশি প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক। আর বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ের অভাবে এমনটা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রাজধানীর একবারেই নিকটবর্তী একই এলাইনমেন্ট বরাবর পরিবহন খাতের তিনটি প্রকল্প নেয়ার যৌক্তিকতার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, "একই পথে সড়কে যাত্রী পাওয়া গেলে রেলে হয়ত যাত্রী পাওয়া যাবে না। আবার রেলে যাত্রী পাওয়া গেলে- সঙ্কটে থাকবে নৌপরিবহন।"
তিনি বলেন, পরিবহন খাতে সরকারের প্রতিটি সংস্থাই প্রকল্প প্রণয়নে ব্যস্ত। একই পরিমাণ যাত্রী দেখিয়ে একাধিক প্রকল্প নিচ্ছে সংস্থাগুলো। এর ফলে কোনটাই আর লাভজনক হবে না।
উদাহারণ দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকার দক্ষিণ থেকে উত্তরে যানজট এড়াতে বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। প্রায় একই উদ্যেশ্যে বাস্তবায়ন হচ্ছে, মদনপুর- দেবগ্রাম- ভুলতা- জয়দেবপুর চার লেন প্রকল্প। হাতে নেয়া হচ্ছে হাতিরঝিল (রামপুরা ব্রিজ) - শেখেরজায়গা, আমুলিয়া, ডেমরা সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প।
তিনি বলেন, তিনটি প্রকল্পই পিপিপি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। টোলের ভিত্তিতে পরিবহন চলাচলের কারণে গরীব মানুষের তেমন কাজে লাগবে না এসব সড়ক। আর পরিবহনগুলো বিভিন্ন পথে ভাগ হয়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীদেরও তেমন লাভ হবে না।
ইনার রিং রোডে ব্যয় হবে ১৪ হাজার কোটি টাকা:
ঢাকা শহরের চার পাশে ৯১ কিলোমিটার বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করবে সরকার। এর অংশ হিসেবে রাজধানীর পূর্ব দিকে বেড়িবাঁধ ও এলিভেটেডে সড়ক মিলে ২৪ কিলোমিটার কাজ করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বাকি ৬৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করবে সওজ।
সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সবুজ উদ্দিন খান জানান, সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইনার রিং রোড বাস্তবায়নে দায়িত্ব পেয়েছে সওজ এবং পাউবো। এ প্রকল্পে এশিয়ান অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) কাছে ঋণ চাওয়া হয়েছে। তাছাড়া এ সড়কের একটি অংশ পিপিপি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে জাপানের বিনিয়োগ চাওয়া হয়েছে।
সওজ সূত্র জানায়, ঢাকার তেরমুখ থেকে ধৌর-গাবতলী-সদরঘাট-পোস্তগোলা-চাষাড়া হয়ে ডেমরা পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করা হবে। ডেমরা নদী থেকে রাজধানীর পূর্ব পাশে তেরমুখ পর্যন্ত বেড়িবাঁধ ও এলিভেটেড সড়ক নির্মাণ করবে পাওবো।
একই এলাইনমেন্টে বৃত্তাকার রেল লাইন:
টঙ্গী থেকে ধৌর, বিরোলিয়া, জাতীয় চিড়িয়াখানা, গাবতলী, সদরঘাট, পোস্তগোলা হয়ে ইনার সার্কুলার রোডের প্রায় সমান্তরাল রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প পিপিপি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে ২০১৮ সালে নীতিগত অনুমোদন দেয় অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।
এর ধারবাহিকতায় সম্পন্ন প্রাক-সম্ভাব্যতা স্টাডির আওতায় প্রায় ৮০ কিলোমিটার রেলপথ চিহ্নিত করা হয়েছে। যা বস্তবায়ন করতে ব্যয় হবে ৮৩৭ কোটি ডলার। এ পথে মোট ২০টি স্টেশন থাকবে।
সূত্র জানায়, নীতিগত অনুমোদনের পরপরই এতে জি-টু-জি পদ্ধতিতে অর্থায়ন করতে জাপানের একাধিক কোম্পানি প্রস্তাব দিয়েছে। দ.কোরিয়া থেকেও এ প্রকল্পে বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে।
প্রকল্প পরিচালক মনিরুল ইসলাম ফিরোজি এ বিষয়ে জানান, সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার প্রতিবেদন বিভিন্ন দফতরে পাঠানো হয়েছে। এর আলোকে প্রকল্পের প্রস্তাবনা তৈরিরও কাজ চলছে।
নদীপথ উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব:
ঢাকার চার পাশের পাঁচ নদীতে আবার নৌপরিবহন চালু করতে ৬৩৬ মিলিয়ন ডলার ব্যয় ধরে ঢাকা রিভারস ইকোলজিক্যাল রেস্টোরেশন প্রজেক্ট বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এতে সংস্থাটি ৩০ কোটি ডলার ঋণ দেবে। অর্থ পাওয়া যাবে চীনভিত্তিক এআইআইবি থেকেও।
সূত্র জানায়, এ প্রকল্পটি সরকারের শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যানে ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। বেশ কয়েকটি পর্যায়ে এর কাজ শেষ করতে ব্যয় হবে ২৯০০ মিলিয়ন ডলার।
উত্তর-দক্ষিণে চালু হচ্ছে তিন বিকল্প:
যানযট এড়িয়ে দেশের দক্ষিণ ও পূর্ব দিকের যানবাহনগুলোকে রাজধানীর উত্তর দিকে দ্রুত পারাপারের ব্যবস্থা করে দিতে র্যাম্পসহ ৪৬.৭৩ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রস্ওয়ে নির্মাণে ২০১১ সালে নেওয়া প্রকল্পে এপর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ২৬ শতাংশ।
সহায়ক প্রকল্পসহ মোট ১৩ হাজার ৮৫৭.৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি পিপিপি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন হলেও এ ব্যয়ের বয়ের বড় একটা অংশ যাচ্ছে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকেই।
নানা জটিলতায় আটকে থাকা প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগেই উত্তর দক্ষিণের পরিবহনের জন্য ৩৫৮৭.৭৪কোটি টাকা ব্যয় করে চার লেনে উন্নীত করা হচ্ছে মদনপুর- দেবগ্রাম- ভুলতা, জয়দেবপুর সড়ক।
এর পাশাপাশি ডেমরা ও চিটাগাং রোড থেকে আমুলিয়া ও শেখেরজায়গা হয়ে হাতিরঝিল পর্যন্ত সড়কটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উন্নীত করতে ৩৮৯৫.৩০ কোটি টাকা ব্যয় করার পরিকল্পনা করছে সরকার। এর অংশ হিসেবে একনেকে ইতোমধ্যেই ১২০৯.৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সহায়ক প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পিপিপি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে একটি প্রস্তাব সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কেবিনেট কমিটির অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
দুই বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে হবে ঢাকা পূর্বপশ্চিম এলিভেটেড সড়ক:
রাজধানীর পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকের পরিবহণ ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন করতে দুই বিলিয়ন ডলার ব্যয় ধরে ঢাকা পূর্ব-পশ্চিম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প হাতে নিতে চাইছে সেতু বিভাগ।
সাভারের হেমায়েতপুর থেকে নারায়ণগঞ্জের মদনপুর পর্যন্ত এ সড়ক নির্মাণ করা হলে ঢাকা আরিচা মহাসড়কের পরিবহন ঢাকা এড়িয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম বা সিলেট মহাসড়কে যেতে পারবে। একইভাবে চট্টগ্রাম, সিলেট বা আরিচা মহাসড়কের গাড়ি মাওয়ার দিকেও যেতে পারবে এ পথ ধরে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ইতোমধ্যেই চীনের একাধিক কোম্পানি আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে বলে ইআরডি সূত্র জানিয়েছে। তবে পিপিপি ভিত্তিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে বলে সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানান।
একই সমান্তরালে আউটার সর্কুলার রোড:
সাভারের হেমায়েতপুর থেকে ঢাকা-মাওয়া রোডের কালাকান্দি পর্যন্ত সড়কটি আধুনিকায়নে পৃথক প্রকল্প নিচ্ছে সওজ। পর্যায়ক্রমে এ সড়ক ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়ক পর্যন্ত সম্প্রসারণ করতে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭০৫ মিলিয়ন ডলার।
এ সড়কটির সম্ভাব্যতা যাচাই করতে সম্প্রতি পরামর্শক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে পিপিপি অফিস।
জানতে চাইলে পিপিপি অফিসের মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ জানান, জি-টু-জি মডালিটিতে পিপিপি ভিত্তিতে জাপানের একটি প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন হলে প্রকল্পের চূড়ান্ত ব্যয় জানা যাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এতোগুলো প্রকল্প এক সাথে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা তার চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন- এত প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা আছে কিনা?
তিনি বলেন, বর্তমানে ঢাকা ও এর চারপাশের যানজট নিরসনে বাস্তবায়ন সক্ষমতার চাইতে বেশি প্রকল্প নেওয়ায় কোনটাই সঠিক বাস্তবায়নের মুখ দেখছে না। এর ফলে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে, যানজট ও জনভোগান্তিও কমছে না।
তিনি আরও বলেন, অগ্রাধিকার বিবেচনা করে প্রয়োজনের শীর্ষে থাকা কাজগুলোতে প্রথম হাত দেওয়া উচিত। এর ফলে অর্থ ও মানব সম্পদের ঘাটতি খুব একটা থাকবে না। দ্রুত প্রকল্পের কাজও শেষ হবে।