রাজধানীর বাইরে কোভিড ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ছে
পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও যন্ত্রপাতি না থাকায় রাজধানীর বাইরে দেশের বিভিন্ন জেলায় কোভিড ব্যবস্থাপনার উদ্বেগজনক অবনতি ঘটছে।
সংক্রমণের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন জেলার কোভিড বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বাড়ছে। অনেক হাসপাতালেই সামর্থ্যের চেয়ে বেশি রোগীকে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। বেড এবং আইসিইউ সংকটের কারণে রোগীদের পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগেই হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হচ্ছে।
রাজধানীর তুলনায় বিভিন্ন জেলার হাসপাতালগুলোতে সুবিধা কম থাকায় রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
১০ দিন আগে করোনায় আক্রান্ত হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক কাজী অবন্তি রানী। সংক্রমিত হয়ে তার ফুসফুসের ৩৫ শতাংশ আক্রান্ত হয়, অনুভূত হয় তীব্র শ্বাসকষ্ট। কিন্তু কুমিল্লার কোভিড বিশেষায়িত কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিট মেলেনি এই শিক্ষকের।
বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালীর কোভিড রোগীদের চাপ থাকায় এই হাসপাতাল এখন ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত রোগীদের সেবা দিতে হচ্ছে।
হাসপাতাল সূত্র বলছে, এই হাসপাতালের ১৮টি আইসিইউ বেডের একটিও খালি নেই। এছাড়া করোনা ইউনিটের ১৩৪ টি বেডে সেবা নিচ্ছেন ১৪৯ জন রোগী। ফলে অধিক রোগী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন নার্স ও চিকিৎসকরা। গত এক সপ্তাহে মৃদু সংক্রমণের রোগীদের ভর্তি না করিয়ে ফেরত পাঠাতে বাধ্য হয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. মহিউদ্দিন জানান, "আসন সংখ্যার চেয়েও বেশি রোগীর সেবা দিচ্ছি আমরা। তবে যে হারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন আছি। কতোদিন এভাবে সেবা দেওয়া যাবে বুঝতে পারছি না।"
শুধু কুমিল্লাই নয়, দেশের অন্য জেলাগুলোর অবস্থাও এখন ক্রমেই অবনতির দিকে।
বিভাগীয় শহর চট্টগ্রামের করোনা পরিস্থিতিও দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকতা ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির জানান, "পরিস্থিতির উত্তরণের জন্য আমরা বন্ধ হওয়া আইসোলেশন সেন্টারগুলো খোলার উদ্যোগ নিয়েছি। মানুষ যাতে চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত না হয় সেজন্য আমরা সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছি।"
বগুড়ার সিভিল সার্জন কার্যালয় বলছে, চলতি মাসে সংক্রমণের হার ২৫ শতাংশের বেশি। গত বছর এই সময়ে যা ছিল ২ শতাংশ। সচেতনতার অভাবে বগুড়ায় ক্রমাগত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পরিমাণ বাড়ছে বলে মনে করছেন তারা।
জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন মোস্তাফিজুর রহমান তুহীন বলেন, সারা দেশের মতোই বগুড়াতেও সংক্রমণ গতবছরের তুলনায় কয়েকগুন বেশি।
এ জেলার একমাত্র কোভিড বিশেষায়িত হাসপাতাল হলো ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল। তবে এখানে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা নেই।রোগীদের সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া হয়।
পাবনায় পিসিআর ল্যাব, র্যাপিড অ্যান্টিজেন, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা, ভেন্টিলেটর না থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে কোভিড রোগীদের। এ জেলার চিকিৎসা ব্যবস্থার ভগ্নদশায় মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।
চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতাল পরিচালনায় মানসম্মত ও দক্ষ জনবল না থাকায় চিকিৎসা দিতে পারছেন না তারা।
পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আইয়ুব হোসেন বলেন, "আইসিইউ চালাতে সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষিত নার্সসহ দক্ষ জনবলের প্রয়োজন। যা আমাদের এখানে পর্যাপ্ত নয়। তবে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনের কাজ চলছে। এটি চালু হলে করোনা চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।"
নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালের অবস্থা আরও বেহাল। নামে আধুনিক হলেও ১০০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা সদরের এ হাসপাতালটিতে আজও চালু করা হয়নি সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা। আইসিইউ স্থাপনও হয়নি, নেই কোন ভেন্টিলেটরও। রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ঘাটতিও।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালটি জেলা সদরের একমাত্র সরকারি হাসপাতাল। জেলা সদর ছাড়াও ৯টি উপজেলার রোগীরা জরুরী ও উন্নত চিকিৎসার জন্য এ হাসপাতালটির ওপর নির্ভরশীল। ইতোমধ্যে হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও এখনও এর কার্যক্রম চলছে ৫০ শয্যার জনবল দিয়ে।
গত বছর করোনা পরিস্থিতির শুরুতে হাসপাতালটিতে ৩৬টি শয্যা নিয়ে করোনা ওয়ার্ড চালু করা হয়। মাত্র তিনটি পালস্ অক্সিমিটার আর ১১টি অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর ছাড়া আর কিছুই নেই এই ওয়ার্ডে।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এএসএম মাহবুবুর রহমান বলেন, সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা চালু করতে আরও সময় লাগবে। অন্যদিকে ভেন্টিলেটর দুটো চালু করতেও কমপক্ষে তিনজন এনেসথেটিস্ট এবং অন্তত একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজন।
সিভিল সার্জন ডা. সেলিম মিয়া বলেন, করোনায় আক্রান্ত সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার জন্য সব প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। তবে জটিল রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠাতে হয়। সব ধরনের সরঞ্জাম চেয়ে বিভাগীয় পরিচালকের কাছে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে।
সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও গত সপ্তাহে রোগীর চাপ বেড়েছে চার- পাঁচ গুন। হাসপাতালের দায়িত্বরত কর্মকর্তা ডা. মহিউদ্দিন খান মুন বলেন, কোভিড ডেডিকেটেড ইউনিটে ১০ টি আইসিইউ বেড রয়েছে, যার সবগুলোতেই রোগী আছে।
দ্বিতীয় দফায় দেশে করোনা সংক্রমণের সম্ভাব্য উচ্চ হারের যে ২৯টি জেলার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে মৌলভীবাজার। প্রথম ওয়েভের সংক্রমণের হার ৫ শতাংশ থাকলেও বর্তমানে তা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এদিকে এই জেলায় নেই করোনা পরীক্ষার ল্যাব। নমুনা পাঠাতে হয় ঢাকা বা সিলেটে।
সিভিল সার্জন চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ জানান, স্থানীয় হাসপাতালে যে জিন এক্সপার্ট মেশিন আছে সেটা ব্যবহার করে আমরা আপাতত করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করব।
জেলার ২৫০ শয্যার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার আহমদ ফয়জন জামান জানান, হাসপাতালে মোট ৫টি আইসিইউ বেড রয়েছে। সংক্রমণের শীর্ষে থাকলেও এ জেলায় হাসপাতালে করোনা রোগীর চাপ কম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে করোনা শনাক্তকরণ ও করোনা রোগীদের চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।
এখন শুধু রাজশাহী মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার করোনা পরীক্ষা করা হয় একমাত্র রাজশাহীতেই, ফলে বেড়েছে করোনা পরীক্ষার চাপও ।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবের ইনচার্জ ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. সাবেরা গুলনাহার বলেন, "আমাদের ল্যাবে প্রতিদিন যে পরিমাণ নমুনা আসে তাতে চারটি শিফট চালু করেও আমরা সব নমুনা পরীক্ষা করতে পারছি না। এছাড়া লোকবলের অভাব তো আছেই। পরিস্থিতি সামলাতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।"
এদিকে সিলেটে গত এক সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রতিদিনই শতাধিক ব্যক্তির করোনা শনাক্ত হচ্ছে। রোগীরা শহীদ ডা. শামসুদ্দিন হাসপাতালে ভীড় করছেন। এখানে সর্বসাকুল্যে বেড রয়েছে মাত্র ১০০টি।
সিলেট বিভাগে আইসিইউ রয়েছে মাত্র ২১টি। এর মধ্যে শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে ১৬টি ও মৌলভীবাজার হাসপাতালে পাঁচটি। সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর ব্যবস্থা নেই। শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে ১৬টি আইসিইউ থাকলেও দুটি বেড অকার্যকর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিদিনই অনেক রোগীকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।অনেকে আইসিইউ চেয়েও পাচ্ছেন না। তাদের মধ্যে সামর্থবানরা বেসরকারি হাসপাতালে যেতে পারছেন, বাকিরা পড়ছেন বিপাকে।
শামসুদ্দিন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালের ১৪ টি আইসিইউ বেডের মধ্যে সবগুলোই রোগীতে পূর্ণ। কোনো বেড খালি নেই।
হাসপাতালে বেড খালি না থাকার কথা স্বীকার করেছেন শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. সুশান্ত কুমার মহাপাত্র।
"করোনা নিশ্চিত না হলে কোনো রোগীকেই আইসিইউতে ভর্তি করা হচ্ছে না। অনেক সময় আক্রান্তদেরও আইসিইউ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না," বলেন তিনি।
সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. প্রেমানন্দ মন্ডল বলেন, শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল ছাড়াও শাহপরাণ হাসপাতাল ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও আইসোলেশন সেন্টার চালু করা হয়েছে। তবে এসব হাসপাতালে ভর্তি হতে রোগীদের আগ্রহ কম। এছাড়া ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার চালু করা হচ্ছে।
তবে দেশের কিছু জেলার করোনা পরিস্থিতি এখনো অনেকটাই ভালো। তারমধ্যে অন্যতম সাতক্ষীরা। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগী রয়েছে ছয় জন। উপসর্গ নিয়ে ভর্তি রয়েছে ৩৮ জন রোগী।
এখানকার করোনা ইউনিটের প্রধান ডা. মানস কুমার মন্ডল জানান, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য ১০০টি বেড রয়েছে। আইসিইউ রয়েছে আটটি। গত দুই সপ্তাহ যাবৎ করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও এখানকার পরিস্থিতি অনুযায়ী তা উল্লেখযোগ্য কিছু নয়।
সারা দেশে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার রোধে কয়েক মাস আন্তজেলা চলাচল সীমিতকরণ এবং শনাক্ত রোগীদের আইসোলেট করে ফিল্ড হাসপাতালের মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মোহাম্মদ মুশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, "আমাদের চিকিৎসার সক্ষমতা কিন্তু বেড়েছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশ কয়েকগুন গতিতে সংক্রমণ বেড়ে চলেছে। সুতরাং যতোই চিকিৎসা সক্ষমত থাকুক না কেন, সংক্রমণ কমাতে না পারলে তা কোন কাজে আসবে না।"
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সংশ্লিষ্ট জেলা প্রতিনিধিরা প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন।