দৈন্যদশা ও ভোগান্তির আরেক নাম ‘ঢাকার আদালত পাড়া’
রাজধানীর পুরান ঢাকা এলাকায় অবস্থিত 'ঢাকার আদালত পাড়া'। দেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আদালত রয়েছে এখানে। আর সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মামলাও বিচারাধীন রয়েছে ঢাকার আদালতে। কিন্তু এসব আদালতে ব্যবস্থাপনা ও বিচারপ্রার্থী বান্ধব হয়ে ওঠেনি এখন পর্যন্ত। আদালতের দৈন্যদশা ও বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকার আদালত পাড়ায় মোট ১১৮ টি আদালত রয়েছে। এসব আদালতে প্রায় সাড়ে চার লাখ ফৌজদারি ও দেড় লাখ দেওয়ানী মামলা বিচারধীন রয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় আদালত চলার দিনগুলোতে প্রতিদিন অর্ধ লক্ষাধিক বিচারপ্রার্থী বিচরণ করে এই আদালত পাড়ায়।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সকল আদালতের জন্য পৃথক এজলাস ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হয়নি এখন পর্যন্ত। এখনো বেশ কয়েকটি আদালতের এজলাস ভাগাভাগি করে চলে মামলার বিচারের কাজ। মামলা ব্যবস্থাপনার জন্য সেরেস্তা, নকলখানা, রেকর্ডরুম পর্যাপ্ত নয়। এছাড়াও বিচারপ্রার্থীদের জন্য বসা বা রেস্ট নেওয়ার জন্য নেই কোনো ব্যবস্থা।
এছাড়াও পর্যাপ্ত ও উপযুক্ত টয়লেট ব্যবস্থাও নেই। সুউচ্চ ভবনে উঠার জন্য পর্যাপ্ত লিফটও নেই। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য নেই কোনো জায়গা।
এজলাস সংকট
এই আদালতে বিচারিক আদালতে এজলাস সংকট দীর্ঘ দিনের। ফলে এক এজলাসে গাদাগাদিভাবে একাধিক বিচারকাজ পরিচালনা করতে হচ্ছে। এতে অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়ছেন বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের ছয় তলার বিশেষ জজ আদালত-১ এর বিচারকক্ষ ভাগাভাগি করে চলছে সাইবার ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম। এখানে সকালে বিশেষ জজ আদালত-১ এর বিচারিক কাজ চলে। আবার দুপুরের পর একই এজলাসে চলে সাইবার ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ এর ভেতরে সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ পরিচালনা করা হয়।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির পাশের রেবতী ম্যানশনের তৃতীয় তলায় সকালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর কার্যক্রম হয়। আর দুপুরের পর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচার কাজ শুরু হয়। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পঞ্চম তলায় বর্তমানে সকালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৬ আর দুপুরের পর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৯ এর বিচার কাজ পরিচালিত হয়।
এদিকে, জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পুরনো ভবনের পঞ্চম তলায় সকালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর কার্যক্রম শেষে দুপুরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এর কার্যক্রম শুরু হয়। একই ভবনের পঞ্চম তলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর কার্যক্রম শেষে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫ এর কার্যক্রম শুরু হয়।
এছাড়া ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতেরও এজলাস ভাগাভাগি করে মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। এখানে ৩৪ টি কোর্ট থাকলেও এজলাস রয়েছে মাত্র ২২ টি।
এ বিষয়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আবদুল বাতেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আদালতের এজলাস ভাগাভাগি করে বিচারকাজ চালাতে হয়। এতে অনেক সমস্যা তৈরি হয়। একটি আদালত পূর্ণাঙ্গ দিনে বিচারকাজ চালাতে পারছে না। ফলে মামলার বিচারে বেশি সময় ব্যয় হচ্ছে।
রেকর্ড রুম সংকট
এজলাস সংকটের পাশাপাশি ও আধুনিক রেকর্ডরুমের সংকটও প্রকট। বিভিন্ন এজলাসের পেছনে বিচারকদের চলাচলের বারান্দার দিকে ছোট ছোট স্টোর রুম রয়েছে। সেখানে অনেক সময় রেকর্ড রুম হিসেবে নিষ্পত্তি মামলার নথিপত্র রাখা হচ্ছে। এসব নথি সংরক্ষণের ব্যবস্থা খুবই দুর্বল।
বিশুদ্ধ পানি ও টয়লেট সংকট
আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের জন্য আদালত প্রাঙ্গণে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধা নেই। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের ষষ্ঠ তলার ভবনে বিচার প্রার্থীদের জন্য তৃতীয় চতুর্থ ও ষষ্ঠ তলায় তিনটি টয়লেট রয়েছে। এছাড়া আরও দুটি টয়লেট থাকলেও তা তালাবদ্ধ দেখা গেছে।
অধিকাংশ টয়লেট ব্যবহারে টাকা দিতে হয়। ঢাকা জেলা জজ আদালতের পাশে মসজিদের সামনে নতুন করে একটি গণ-টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে। তবে সেখানে এমনই দুর্গন্ধ যে প্রবেশ করাই দুরূহ। এছাড়া পুরুষদের জন্য তৈরি টয়লেটের দরজা খুবই সরু। সেখানে প্রবেশ করাই দুরূহ হয়ে পড়ে। বিচার প্রার্থীদের জন্য বিশ্রামাগার নেই বললেই চলে। নারী ও শিশু বিচার প্রার্থীদের জন্য রেবতী ম্যানশনে একটি বিশ্রামাগার থাকলেও সেখানে তেমন লোকজন যান না।
বিচারপ্রার্থীদের বসার ব্যবস্থা
জেলা জজ আদালত, মহানগর দায়রা জজ আদালত, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রতিদিন হাজারো বিচারপ্রার্থী আসলেও তাদের বসার কোনো জায়গা নেই।
নিম্ম আদালতে দূর-দুরান্ত থেকে প্রতিদিন ছুটে আসে বিচার প্রত্যাশীরা। আদালত পাড়ায় তাদের ভোগান্তির অন্ত নেই। গত ২৪ জুন একজন বিচারপ্রার্থীরা টিবিএসের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'এজলাসে আইনজীবীদের বসার ব্যবস্থা থাকলেও বিচারপ্রার্থীদের বসার কোনো জায়গা নেই। ফলে আদালতের বারান্দাতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়।'
কথা হয় সাভার-আশুলিয়া থেকে ঢাকার নিম্ন আদালতে মামলার হাজিরা দিতে আসা মতিন চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, 'এতো নিম্ন মানের ব্যবস্থাপনা আদালতে যা নজিরহীন। অনেক দিন গেছে সারাদিন একটুও বসার সুযোগ হয়নি, স্থান সংকটের কারণে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে।'
দিনে ফেরিওয়ালা, রাতে মাদকসেবীদের দৌরাত্ম্য
আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী ছাড়াও বহিরাগত লোকজনের আনাগোনা রয়েছে। অনেকে দালালদের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হন। নানা মানুষের ভিড়ে আদালত প্রাঙ্গণে পকেটমারের দৌরাত্ম্যও রয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে হকারদের রাজত্ব চলছে। শতাধিক হকার অবাধে বিচারণ করছে। তাদের কেউ কেউ আবার স্থায়ী আসন গেড়েছেন। এছাড়া চত্বরে পাগলবেশী মাদকসেবীদের আনাগোনা রয়েছে।
ময়লা, মশার অভয়ারণ্য
আদালত প্রাঙ্গণে বিভিন্ন আবর্জনার স্তুপে দুর্গন্ধের পাশাপাশি মশার অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে প্রবেশের প্রধান ফটকের দু'পাশেই আবর্জনার স্তুপ রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই এসব স্থানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে আসামি এনে আবর্জনার পাশেই রাখা হয়।
সেখানে তাদের সঙ্গে আত্মীয়-স্বজনরা একটু দেখা ও কথা বলার সুযোগ পান। প্রিজন ভ্যানগুলো ঘিরে তারা ময়লা-আবর্জনার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকেন। এছাড়া আদালত ভবনগুলোর নিচের চারপাশে রয়েছে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। এসব দ্রুত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে দাবি জানিয়েছেন আইনজীবী ও বিচার প্রার্থীরা।
লিফট সমস্যা
১০ তলা ভবন বিশিষ্ট ঢাকার সিএমএম আদালতে মাত্র দুইটি লিফট রয়েছে, যার প্রত্যেকটিতে মাত্র ৮ জন করে লোক একসাথে উঠা-নামা করতে পারে। কিন্তু এই ভবনে মোট ৩৪ টি আদালত রয়েছে। প্রতিদিন কয়েক হাজার আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী আসে এই ভবনে। যাদের উঠানামার জন্য মাত্র দুইটি লিফট পর্যাপ্ত নয়।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আশরাফ-উল আলম টিবিএসকে বলেন বিচারক ও আইনজীবীরা লিফটে ওঠার সুযোগ পেলেও সাধারণ বিচারপ্রার্থী এমনকি অসুস্থ কোনো মানুষও লিফটে ওঠার সুযোগ পায় না। ফলে বেশিরভাগ বিচারপ্রার্থীকে ১০ তলা পর্যন্ত সিড়ি বয়ে উঠতে হয়।
একই অবস্থা মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনে। ৫ তলা এই ভবনে ২৯ টি আদালতে বিচারকাজ চলে। যেখানে লিফট মাত্র দুইটি। প্রতিটি লিফটে একসাথে ৬ জন করে একসঙ্গে উঠতে পারে। ৬ তলা বিশিষ্ট ঢাকা জেলা জজ আদালতে রয়েছে ২০ টি কোর্ট। সেখানে দুইটি লিফট থাকলেও মাত্র একটি চালু থাকে। যেটিতে একসঙে মাত্র ৬ জন উঠতে পারে।
ঢাকার আদালত পড়ায় ১১৮ টি কোর্টের মধ্যে ঢাকা জেলা ও দায়রা আদালত এবং ঢাকা জুডিশিয়াল মেজিস্ট্রেট আদালতে ৪০ টি কোর্ট। ঢাকা মহানগর ও দায়রা জজ আদালতে মোট ১৬ টি কোর্ট। মহানগর হাকিম আদালতের মোট ৩৪ কোর্ট। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৯টি। সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনাল-১টি। সাইবার আদালত ১টি। জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল ১ টি। বিশেষ জজ আদালত ১০টি। পরিবেশ আদালত-২টি। এছাড়াও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল রয়েছে ৪টি।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জাজী শাহ আলম টিবিএসকে বলেন, এসব সমস্যার কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে। আবার ভোগান্তিতে পড়ছে সাধারণ বিচারপ্রার্থীরা। সমস্যা সমাধানে দ্রুত উদ্যোগ না নিলে এই আদালত পাড়া অনুপযুক্ত বলে পরিচিতি পাবে।
আইন মন্ত্রী আনিসুল হক টিবিএসকে বলেন, ঢাকার আরও একটি নতুন মহানগর মেজিস্ট্রেট আদালত ভবনের কাজ চলছে। এছাড়াও আরও নতুন ভবন স্থাপনের পরিকল্পনা হয়েছে। নতুন ভবন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এসব ভোগান্তির অবসান হবে। সকল সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানে কাজ চলমান বলে জানান তিনি।