চাহিদা কমছে ঐতিহ্যবাহী বেলা বিস্কুটের
মেজবানের মতো বেলা বিস্কুট চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক একটি খাবার। চট্টগ্রামবাসীর কাছে সকালে ঘুম থেকে উঠে চায়ে ডুবিয়ে কিংবা বিকেলের আড্ডায় বেলা বিস্কুটের কোনো বিকল্প নেই। তবে ঐতিহ্যবাহী এই বিস্কুটটির চাহিদা দিন দিন কমছে। ফলে হুমকির মুখে পড়ছে শিল্পটি।
বেলা বিস্কুটের নাম আসলে সবার আগে আসে গণি বেকারির কথা। কারণ গণি বেকারির হাত ধরেই এই জনপদে বিস্কুটটি জনপ্রিয় হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির মালিক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশাম বলেন, ১০ বছর আগেও প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজার পিস বেলা বিস্কুট বিক্রি হতো। তবে তা এখন অনেক কমে গেছে। এখন প্রতিদিন গড়ে ৬ হাজার পিস বেলা বিস্কুট বিক্রি হয়। সে হিসাবে মাসে বিক্রি হয় ৪০ লাখ টাকার। প্রতি পিস বেলা বিস্কুটের দাম সোয়া দুই টাকা।
তিনি আরও বলেন, ‘‘কানাডার একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছ থেকে বেলা বিস্কুট আমদানি করতো। তবে শিপিংসহ নানা জটিলতার কারণে এখন তারা আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে।’’
চাহিদা কমার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এখন বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট বাজারে এসেছে। বিকল্প হিসেবে অনেক খাবার তৈরি হচ্ছে বেকারিগুলোতে। তাই চাহিদা কমে যাচ্ছে। আমরা ঐতিহ্যে ধরে রাখতে এ ব্যবসা এখনও টিকিয়ে রেখেছি।’’
প্রায় ২০০ বছর ধরে চট্টগ্রামের গণি বেকারিতে তৈরি হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বেলা বিস্কুট। প্রথমে ময়দা, ডালডা, গুঁড়া দুধ, চিনি, লবণ ও তেল মিশিয়ে তৈরি করা হয় খামি। সঙ্গে দেওয়া হয় বিশেষ ধরনের মাওয়া। মাটির তন্দুরে একদিন রাখার পর প্রথম দফায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সেঁকা হয়। দ্বিতীয় দফা সেঁকে তৈরি করা হয় বেলা বিস্কুট।
গবেষকরা জানিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের ঘাঁটি ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলে। গণি বেকারি থেকে নেওয়া হতো সৈনিকদের জন্য নাস্তা। নাস্তার তালিকায় রুটির পাশাপাশি ছিল এই বেলা বিস্কুট।
গণি বেকারি ও বেলা বিস্কুট নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলা একাডেমির সহ-পরিচালক আহমদ মমতাজ। তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম থেকে আরাকান পর্যন্ত সৈনিকদের তাবু স্থাপন করা হয়েছিল। সৈনিকদের নাস্তা সরবরাহের ঠিকাদারি পেয়েছিলেন আবদুল গণি সওদাগর। গণি বেকারি থেকে সৈনিকসহ অন্যান্যদের নাস্তার সরবরাহ করা হতো। তালিকায় রুটির পাশাপাশি বেলা বিস্কুটও ছিলো। তবে বিস্কুটির নাম কীভাবে ‘বেলা’ হলো সে তথ্য জানা যায়নি।
গবেষক আহমদ মমতাজ আরও বলেন, মোগল ও পর্তুগিজদের খাদ্যাভ্যাসে ছিল রুটি, পাউরুটি, বিস্কুটসহ বেকারি পণ্য। ব্রিটিশ শাসন আমলে অনেক পর্তুগিজ এখানে বসতি গড়েছিল। তাদের খাদ্যাভ্যাসের কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেকারিশিল্পের যাত্রা শুরু হয়।
মুখরোচক বেলা বিস্কুটের কথা কবি, সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদদের লেখায়ও উঠে এসেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সাহিত্যিক আবুল ফজলের আত্মজীবনী ‘রেখা চিত্রে’ বেলা বিস্কুট নিয়ে একটা লাইন রয়েছে। সেখানে লেখা ছিল, ‘‘ঘুম থেকে উঠে পান্তা ভাতের বদলে খাচ্ছি গরম-গরম চা বেলা কি কুকিজ নামক বিস্কুট দিয়ে। কুকিজ ইংরেজি নাম বেলা কিন্তু খাস চাটগেঁয়ে।’
চট্টগ্রামের চন্দনপুরা কলেজ রোডে ঐতিহ্যবাহী গণি বেকারি শপিং কর্নার নামে দোকানটিতে পাওয়া যায় প্রসিদ্ধ এই বিস্কুট। খ্যাতির কারণে জায়গাটির নাম এখন গণি বেকারি মোড়।
দোকানের সামনে গিয়ে দেখা যায়, বেকারিতে ৩০ ধরনের পণ্য বানানো হলেও বেশির ভাগ কাস্টমার সেখানে আসেন বেলা বিস্কুট কিনতে। শোরুমের সঙ্গে লাগানো বিস্কুট তৈরির কারখানা। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দুইটি মাটির তন্দুরে বিস্কুটটি তৈরি হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী প্রতিদিন ৬ থেকে ৮ হাজার পিস বেলা বিস্কুট তৈরি হয় বলে কারিগররা জানিয়েছেন।
আবদুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশাম বলেন, আমরা বেলা বিস্কুটকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যবসা করছি। এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে আমরা এখনো মাটির তন্দুর রেখে দিয়েছি। শতবছর আগের রীতি অনুযায়ী এখনো বেলা বিস্কুটি তৈরি হচ্ছে। দামটাও আমরা নাগালে রেখেছি। ৪০ পিস বেলা বিস্কুটের দাম রাখা হয় ৯০ টাকা।
ইতিহাস ভিত্তিক প্রকাশনা ‘চট্টগ্রাম পরিক্রমা’ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আবদুল গণি সওদাগর ১৮৭০ সালে গণি বেকারি প্রতিষ্ঠা করলেও তার পূর্বপুরষদের বেকারি পণ্য তৈরির ব্যবসা ছিলো। আবদুল গণির পূর্বপুরুষ লাল খাঁ সুবেদার ও তার ছেলে কানু খাঁ মূলত বেকারি পণ্যের ব্যবসা শুরু করেন।
আবদুল গণির পূর্বপুরষরা পশ্চিবঙ্গের বর্ধমান জেলার বাসিন্দা। তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে চট্টগ্রামে আসেন। পূর্বপুরুষের হাত ধরে বেকারিশিল্পে যুক্ত হন আবদুল গণি সওদাগর। ১৯৭৩ সালে মারা যান শতবর্ষী আবদুল গণি।
নিঃসন্তান আবদুল গণি মৃত্যু পরবর্তী তার ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব ভাইয়ের ছেলে দানু মিঞাকে অসিয়ত করে যান। দানু মিঞা মারা যান ১৯৮৭ সালে। এরপর ব্যবসার হাল ধরেন তার ছেলে অ্যাডভোকেট জামাল উদ্দিন।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ব্যবসা চালিয়ে যান। পরবর্তী সময়ে জামাল উদ্দিনের মৃত্যুর পর এখনো পর্যন্ত ব্যবসা পরিচালনা করছেন তার ছেলে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশাম।
গণি বেকারির হাত ধরে বেলা বিস্কুট জনপ্রিয় হলেও বর্তমানে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক অনেক প্রতিষ্ঠান বেলা বিস্কুট তৈরি করছে।
(https://tbsnews.net/feature/demand-century-old-recipe-bela-biscuit-declines-36299)