কতোখানি উন্মুক্ত আমাদের আকাশপথ?
প্যারাগ্লাইডিং এর জন্য বিদেশি এক পর্যটককে এগিয়ে আসতে দেখেই রবি নামের তরুণ এক প্যারাগ্লাইডারের মুখে হাসি ফুটলো। পর্যটকদের মধ্যে জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল নেপালের পোখারায় দীর্ঘ ১১ মাস ২১ ফেব্রুয়ারি পর প্রথমবারের মতো একজন যাত্রী পেলেন এই তরুণ।
"আমি আজ ভাগ্যবান," দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিবেদককে বলছিলেন তিনি। মহামারির মধ্যে পর্যটন স্থানগুলোর অবস্থা কেমন তার ধারণা দিতে পারে রবির গল্প, এমনকি দেশগুলো এখন নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে সীমান্ত খুলে দেওয়ার পরও অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে দেশগুলোর গৃহীত স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধির শর্তাবলী যে কারোই বিদেশে আনন্দভ্রমণ ও উদ্বেগমুক্ত ভ্রমণের উৎসাহ কমিয়ে দেবে।
পর্যটকদের প্লেনে ওঠার আগেই কোভিড-১৯ নেগেটিভ সনদের প্রয়োজন পড়ে, ভিসার জন্য অতিরিক্ত অর্থ খরচ ও গন্তব্যস্থলে পৌঁছে সেই দেশের নির্ধারিত সময় কোয়ারেন্টিনে থাকার খরচ তো আছেই।
মাস্ক পরিহিত ফ্লাইট এটেন্ডেন্সসহ আরও বিভিন্ন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি নিশ্চিত করতে হয় এয়ার অপারেটরদের।
বিমানের সার্বিক কার্যক্রমের খরচ বেড়ে যাওয়ায় ও যাত্রী সংখ্যা কমে যাওয়ায়, আয়ের লোকসান পোষাতে টিকিটের দামও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তারপরও অনেকেই আছেন যারা এতোসব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েই জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্যে যাবেন। তবে সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের অধিক সংক্রামক ও ক্ষতিকর নতুন স্ট্রেইনের উদ্ভবে দেশগুলো অতিরিক্ত বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে।
ভ্রমণের প্রতিকূলতা
বিদেশ ভ্রমণ কতোটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে তা বোঝার জন্য নেপালের কথাই ধরা যাক। পর্যটন ভিত্তিক অর্থনীতির দেশটি সীমান্ত খুলে দিলেও পর্যটকরা এখন আর পৌঁছে তাৎক্ষনিক ভিসা সুবিধা গ্রহন করে প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছেন না। নিজ দেশের নেপালের দূতাবাস থেকেই নেপালের ভিসা করে নিতে হয়।
যেসব দেশে ভাইরাসের নতুন ধরন পাওয়া গেছে সেসব দেশের পর্যটকদের নেপাল পৌঁছে নিজ খরচে ১০ দিন হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। অন্যান্য দেশের পর্যটকদের কোভিড নেগেটিভ সনদ নিয়ে যেতে হয়।
নেপাল যাওয়া এবং দেশে ফেরার আগে দুইবার নেগেটিভ সনদ সংগ্রহের জন্য একজন বাংলাদেশিকে অতিরিক্ত ছয় হাজার টাকা খরচ করতে হবে।
পর্যটনের এমন সংকটকালীন অবস্থায় শুধু অল্প কিছু এয়ারলাইন-ই ভ্রমণ গন্তব্যগুলোতে ফ্লাইট চালু রেখেছে।
শুধু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সই গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে নেপালের ফ্লাইট চালু রেখেছে। তবে যাত্রী সংখ্যা সীমাবদ্ধ রাখার কারণে প্রতি ফ্লাইটেই বড়সড় লোকসানে পড়তে হয়। টিকিটের দাম শতভাগ বৃদ্ধি পেয়ে ২৫-৩০ হাজার হওয়ার পরেও লোকসান এড়াতে পারেনি সংস্থাটি।
যেসব দেশে বাংলাদেশিদের ভ্রমণের অনুমতি আছে ও আনুষঙ্গিক খরচ
বর্তমানে নেপাল, মালদ্বীপ, দুবাই, মিশর ও তুরস্ক- এই পাঁচটি দেশে নেগেটিভ সনদ নিয়ে ভ্রমণে যেতে পারবেন বাংলাদেশিরা।
মালদ্বীপ পর্যটকদের অন-এরাইভাল ভিসা সুবিধা দিচ্ছে। মহামারির আগের সময়ের তুলনায় টিকিটের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। দুবাই যেতে ভিসার জন্য আগের চেয়ে ৩-১২ হাজার বেশি খরচ করতে হবে, টিকিটের দামও দ্বিগুণ বেড়েছে।
মিশর ও তুরস্ক ভ্রমণেও আগের চেয়ে বেশি খরচ পড়বে।
শর্তসাপেক্ষে যেসব দেশের সীমান্ত খোলা আছে
সিঙ্গাপুরে যেতে চাইলে ভ্রমণকারীকে পৌঁছেই ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। ভিসা আবেদন প্রক্রিয়ার সময়ই কোয়ারেন্টিন প্যাকেজের খরচ হিসেবে ২ হাজার ২০০ এসজিডি ডিপোজিট করতে হবে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১.৪০ লাখ টাকা।
মালেয়শিয়ায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ও অধিবাসীদের জন্যই শুধু মালেয়শিয়ায় প্রবেশের অনুমতি আছে।
বাংলাদেশি পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের গন্তব্য থাইল্যান্ড নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে টুরিস্ট ভিসা দিচ্ছে। ভিসা পাওয়ার জন্য কোয়ারেন্টিন প্যাকেজের খরচ হিসেবে ১ লাখ টাকা ডিপোজিট করতে হবে।
ভারত শুধু বিজনেস, মেডিক্যাল ও স্টাডি ভিসা দিচ্ছে। লন্ডনেও পর্যটকরা যেতে পারবেন, তবে পৌঁছানোর পর ৭ দিন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র সীমিত পরিসরে ভিসা দিচ্ছে, পর্যটকদের পৌঁছে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকার শর্ত দেওয়া হয়েছে।
বিমান পরিবহন খাতে বিপর্যয়
অনেক দেশই পর্যটকদের ওপর নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করায় বিমান পরিবহন খাতের ক্ষতি পুষিয়ে আরও সময় লাগবে। বিভিন্ন দেশে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সরবরাহ শুরু হয়ে গেলেও, টিকাদান কার্যক্রম সার্বজনীন হতে আরও অনেক সময় লাগবে।
বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৬০-৭০টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের কার্যক্রম চালু আছে, এ সংখ্যা মহামারির আগের সময়ের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।
কার্যক্রম পরিচালনায় আগের চেয়ে বেশি খরচ হওয়ায় লোকসানের কারণে দেশের বৃহত্তম বিমান বহরের সংস্থাটি সংকটে পড়েছে।
গত বছরের অক্টোবরে বিমান বাংলাদেশেদের গড় কার্য ঘন্টা ৩.৪২ ঘন্টায় নেমে আসে, একটি প্লেনের কার্যকর ব্যবহার সাধারণত ১০ ঘন্টার বেশি। এর আগে ২০১৯ সালের জুলাইতে সংস্থাটির কার্য ঘন্টা সর্বোচ্চ ছিল, সংস্থাটির ফ্লাইট কার্যক্রম ১২ ঘন্টা চালু থাকতো সেসময়। সিরিয়ামের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ২০ শতাংশ বিমান বহরের কার্যক্রম এখনো বন্ধ আছে।
এবছরের শুরুতে অধিক সংক্রামক নতুন ভাইরাস স্ট্রেইনের কারণে পুনরায় বিভিন্ন দেশের সীমান্ত বন্ধের কারণে উত্তরণের আশাও ম্লান হয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থার (আইএটিএ) সম্প্রতি প্রকাশিত নতুন বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এবছরের পুরো সময় জুড়েও বিমান পরিবহন খাতে তারল্যের নেতিবাচক প্রবণতা বজায় থাকবে। এর আগে ২০২০ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত বিশ্লেষণে বলা হয়েছিল ২০২১ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে বিমান পরিবহন খাত ঘাটতি পুষিয়ে উঠতে পারবে। ২০২২ সালের আগে এ খাতে তারল্য উদ্ধৃত্তের সম্ভাবনা নেই।
আইএটিএ'র তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের এর অনুমিত ঘাটতি ৪৮ বিলিয়ন ডলার ধরা হলেও বর্তমানে তা ৭৫-৯৫ বিলিয়ন ডলার হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
খরচ কমিয়ে, কর্মী ছাটাই করে ও বিমান চলাচল বন্ধ রেখে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে এয়ারলাইন্সগুলো। কিন্তু তাও মাসিক ৫-৬ ডলার বিলিয়ন ডলার ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে।
অনেক বড় প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হওয়ার মুখে। ইউরোপের বৃহত্তম লো কস্ট ক্যারিয়ার, নরওয়েজিয়ান এয়ার শাটল গত বছরের নভেম্বরে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। ব্রিটিশ লো কস্ট ক্যারিয়ার ফ্লাইবে, লাতিন আমেরিকা ভিত্তিক বিমান সংস্থা ভারজিন অস্ট্রেলিয়া ও অ্যাভিয়াঙ্কাও দেউলিয়া হয়ে গেছে।