এক সপ্তাহেও নমুনা পরীক্ষার ফলাফল মিলছেনা বগুড়ায়
বগুড়ার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মাসুম হোসেন। অফিসের এক সহকর্মী করোনা পজিটিভ। তার শরীরেও করোনা উপসর্গ রয়েছে। এ কারণে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছেন। কিন্তু আট দিন আগে নমুনা দিয়ে এখনো ফলাফল পাননি তিনি। তার কাছ থেকে বৃদ্ধা মা আক্রান্ত হতে পারেন বলে তিনি অফিসের মেঝেতেই এক সপ্তাহ ধরে ঘুমিয়ে থাকছেন।
এই অফিসের অন্য ছয় সহকর্মীও গত ২৭ জুন নমুনা দিয়েছেন। কারও ফলাফলই আসেনি। তারাও পরিবারের সাথে শঙ্কা নিয়ে বসবাস করছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ করোনা পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তারা বলেন, 'প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে নমুনা পরীক্ষার ফল পেতে দেরি হচ্ছে না। অথচ সরকারিভাবে ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে অনেক ঘাপলা রয়েছে'।
তবে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় বলছে, জুন মাস থেকে করোনা সংক্রামণ বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক সময় ফলাফল পেতে দেরি হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু নমুনা পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বগুড়ায় সোমবার পর্যন্ত করোনা শনাক্তে নমুনা সংগ্রহ হয়েছে ৯৬ হাজার ১০৮ জনের। এর মধ্যে ৮৪ হাজার ৯১৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন ১৪ হাজার ৬৯৩ জন। বগুড়ার মৃত্যুর হারও তুলনামূলকভাবে বেশি। এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে ৪২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বগুড়ায় ১১ হাজার ১৯৪ জনের এখনও ফলাফল পাওয়া যায়নি। এসব নমুনার অধিকাংশ হিসাবের বাইরে রেখেছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। তৃতীয় ধাপে করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে শুধু জুন মাসেই ৭ হাজার ৬৩১ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ফলাফল পাওয়া গেছে ৬ হাজার ৯৬৮ জনের। এর মধ্যে দেড় হাজারের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এখনো ফলাফল পাওয়া যায়নি ৬৬৩ জনের। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য মতে, বগুড়ায় এখন তিন হাসপাতাল ও বাড়ি মিলে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৪৫৪ জন রোগী।
বগুড়ায় শুরু থেকে দুটি পিসিআর ল্যাবে করোনা পরীক্ষা করা হয়। তার মধ্যে একটি সরকারি শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল (শজিমেক) এবং অন্যটি বেসরকারি টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। এই দুই হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসাও দেওয়া হয়। এ দুটি হাসপাতাল ছাড়াও করোনা রোগীদের জন্য এ বগুড়ার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল ডেডিকেটেড করা হয়েছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয় বলছে, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরিতে প্রতিদিন মোট ২৮২টি নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব। তাও আবার করতে হয় তিন শিফটে। প্রতি শিফটে ৯৪টি করে নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা রয়েছে এই আরটি-পিসিআর ল্যাবের। কিন্তু বগুড়া থেকে এখন প্রতিদিন অন্তত ৪৫০টি নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হচ্ছে শজিমেকে। অনেক সময় বগুড়ার পাশের জেলার সুপারিশে কিছু নমুনাও এই ল্যাব থেকে পরীক্ষা করা হয়। এ কারণে নমুনা জট আর বেশি হয়। এ কারণে গত সপ্তাহে এক প্রায় হাজার নমুনা পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। এর মধ্যে ৬৭৪ টি নমুনার ফলাফল পাওয়া গেছে।
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ রেজাউল আলম জুয়েল বলেন, 'আমাদের এখানে ২৮২টি নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা রয়েছে। এখন বগুড়ায় নমুনা পরীক্ষার অনেক চাপ। এ কারণে নমুনাও বেশি আসছে পরীক্ষার জন্য। কিন্তু সব নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রতিদিন কিছু সংখ্যক নমুনা আসলে থেকে যাচ্ছে। এগুলো জড়ো করে ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। এর মধ্যে অন্তত ৫০০ নমুনা জমা হয়ে গেছে। এভাবে শুধু ল্যাবে পরীক্ষা করে জট কমানো সম্ভব নয়। এসময় র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। ল্যাবে বেশি চাপ দিলে আবার মেশিন বিকল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তখন বিপদ আরও বেশি হবে'।
বগুড়ার বেসরকারি টিএমএসএস মেডিকেল কলেজের আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরিতে এক দিনে ৯৪টি নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হয়। তবে সরকারি মেডিকেল কলেজে নমুনা পরীক্ষার ফি ২০০ টাকা হলেও এখানে নমুনা পরীক্ষার ফি ৩ হাজার টাকা। এ কারণে এখানে নমুনা পরীক্ষায় সাধারণ মানুষের আগ্রহ কম।
অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য পড়াশোনা করছেন নাঈম হাসান। তার মধ্যে করোনার সব উপসর্গ রয়েছে। তিনি গত ২৭ জুন করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছেন। কিন্তু ফলাফল এখনো পাননি। পরে বাধ্য হয়ে গত ৩ জুলাই আবার নমুনা দিয়েছেন তিনি। সেটার ফলাফলও পাননি এই শিক্ষার্থী। নাঈম বাড়িও ফিরতে পারছেন না তার মাধ্যমে বাবা-মা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে। এ কারণে বন্ধুর বাসায় একটি আলাদা রুমে থাকছেন।
তিনি বলেন, 'এক সপ্তাহ ধরে হালকা জ্বর, সর্দি,কাশি হচ্ছে। এ জন্য সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে গিয়ে দু'বার নমুনা দিয়ে আসছি। এখনো ফলাফলের কোনো খবর নেই। এখন উপরওয়ালার দিকে চেয়ে আছি। আর নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্যের বাড়িতে থাকাও বিব্রতকর'।
অন্যদিকে উপায় না থাকায় নমুনা দিয়ে আসার পর বাড়ির সকলের সাথে মিশছেন আসাফ-উদ-দৌলা নিওন। তিনি জানান, 'কয়েকদিন উপসর্গ নিয়ে ঘুরলাম। বাড়িতে গেলাম। আমিও ২৭ জুন নমুনা দিয়েছি। এখনো কোনো খবর নেই। শঙ্কায় থাকি আমি পজিটিভ নাকি নেগেটিভ'।
তবে বগুড়ার ডেপুটি সিভিল সার্জন মোস্তাফিজুর রহমানের দাবি, 'এখন বগুড়ায় নমুনা জট বলতে কিছু নেই। চাপ বেড়ে যাওয়ায় হয়তো কিছু নমুনা পরীক্ষার ফলাফল সময় মতো পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সেগুলো ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। চাপ কমলে আমরা এখান থেকে সব নমুনা পরীক্ষার ফলাফল দিতে পারব। তবে এখন শুধু ল্যাবে পরীক্ষার উপর নির্ভর না করে র্যাপিড অ্যান্টিজেন কিট দিয়ে পরীক্ষা করা খুব জরুরি। কারণ এখানে কিটের কোনো সংকট নেই। আর ফলাফল একদিনের মধ্যেই পাওয়া যায়'।
আটদিনে নমুনা পরীক্ষার জন্য কার্যকারিতা থাকে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'একটি নমুনা পরীক্ষার জন্য ১০ দিন পর্যন্ত কার্যকারিতা থাকে। আমার সেভাবেই নমুনা সংরক্ষণ করি'।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে গত ১৫ জুন শজিমেকে পিসিআর ল্যাবে আরও একটি অত্যাধুনিক নমুনা পরীক্ষার মেশিন দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতি শিফটে এক সঙ্গে ৩৮৬ নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব। তবে এই মেশিন এখনো চালু করা যায়নি। কবে চালু হবে তারও কোনো হিসাব নেই।
জানতে চাইলে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ রেজাউল আলম জুয়েল বলেন, 'এই আধুনিক মেশিন সেটআপ করতে বায়োসেফটি কেবিনেট লাগবে। এ ছাড়া আরও কিছু যন্ত্রাংশ দরকার। এগুলো এখনো পাওয়া যায়নি। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দক্ষ টেকনিশিয়ান দল ছাড়া এটি সেটআপ করা সম্ভব নয়। এ কারণে যন্ত্রটি চালু করা যায়নি'।
তবে এই যন্ত্রটি আদৌ চালু করা যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ডেপুটি সিভিল সার্জন মোস্তাফিজুর রহমান তুহীন। তিনি বলেন, 'আধুনিক এই যন্ত্রটি দেশের কয়েকটি জেলায় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোথাও চালু করা সম্ভব হয়নি। এখানেও সম্ভব হবে কিনা বলা যাচ্ছে না'।