আর বিচার চাই না: রেইনট্রি হোটেল ধর্ষণ মামলার বাদী
চার বছর আগে রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণের মামলায় সম্প্রতি পাঁচজনকে খালাস দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। মামলাটির রায় এবং আদালতের পর্যবেক্ষণ ব্যাপক সমালোচনা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। রায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে গত শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, নারী অধিকারকর্মী, পেশাজীবী ও শিল্পীসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ব্যানার, প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে।
আবার এই মামলার রায়ের পর দেওয়া পর্যবেক্ষণে ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণ মামলা না নিতে পুলিশকে সুপারিশ করায় বিচারিক ক্ষমতা হারান ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার।
রায়ের পর ওই দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। তবে তারা মোবাইলে বা সরাসরি কথা বলতে চাননি। মামলার বাদী জানিয়েছেন, লিখিত প্রশ্ন পাঠাতে। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষ থেকে পাঠানো প্রশ্ন এবং ওই বাদীর দেওয়া উত্তর সরাসরি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-
প্রশ্ন: রেইনট্রির এই ঘটনা আপনার জীবনকে কীভাবে পাল্টে দিয়েছে?
উত্তর: জব সেক্টরে প্রবলেম ফেইস করেছি। আমি অনেকদিন ধরেই জবলেস। আমার ভবিষ্যতে কী আছে এবং আমার প্যারেন্টস আমাকে কোনোদিন বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব মুক্ত হতে পারবেন কিনা আমি জানি না। যারাই এই ঘটনা জানে কেউ স্থান দিতে চায় না। সমাজের চোখে যেন আমিই অপরাধী। আর এই রায়ের পর তো জীবন আরো কঠিন হয়ে গেছে। নিজের প্যারেন্ট এর কাছেও জবাবদিহি করতে হয়, যেটা প্রমাণ করতে পারব না সেটা নিয়ে কেন কেইস করেছি।
প্রশ্ন: রায়ের দিন আপনার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আপনি বলেছিলেন আদালতে যাবেন না। রায় কী হবে অনুমান করেছিলেন? কীসের ভিত্তিতে এই অনুমান?
উত্তর: বিরোধী পক্ষের অনেক টাকা। তারা এতই ক্ষমতাশালী যে কোনো প্রমাণই আমরা পেশ করতে পারি নাই। ৪৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ জন সাক্ষী দিয়েছে, তার মধ্যে আমাদের পক্ষে কেউ কথা বলেননি। তাই রায় যে তাদের পক্ষেই হবে এটা বুঝতে পেরেছিলাম, নিরাপত্তার ভয়ে আদালতে যাওয়া উচিত মনে করিনি।
প্রশ্ন: বিচারক বলেছেন, সম্মতির ভিত্তিতে সে রাতে আপনারা রেইনট্রি হোটেলে গিয়েছিলেন, ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আপনার মন্তব্য কী?
উত্তর: আমার মন্তব্য আমার চোখে আছে, সেটা আর বলে বুঝানোর ভাষা আমার নেই। কারণ আমার চোখ যা দেখেছে তা আনফরচুনেটলি কেউ দেখেনি। একটা বার্থডে পার্টির ইনভাইটেশন অ্যাকসেপ্ট করা অপরাধ বলে আমি মনে করিনা। আমি আগেও বলেছিলাম বার্থডে পার্টির লোকেশন নিয়ে আমার কোনো আইডিয়া ছিল না। একটা জেনারেল বার্থডে পার্টি ভেবেই সম্মতি দিয়েছি যাবার, তাও মোটামুটি জোর করেই সম্মতি আদায় করেছে তারা। কেউ আপনাকে পিক-আপ করতে গাড়ি পাঠিয়ে দিলে আপনি কি তাকে বিদায় করে দিতেন? যদি জানতাম রেইনট্রি হোটেল, গাড়ি পাঠানো পর্যন্ত কথাই আগাতাম না।
প্রশ্ন: এতবছর ধরে মামলা চালানো যেখানে আসামি প্রভাবশালী ও বিত্তশালী- সেটা কি আপনাদের জন্য কঠিন ছিল? কী ধরনের বাধার মধ্যে পড়েছেন আপনারা?
উত্তর: এটা নিয়ে উপরেও ব্যাখ্যা করেছি। এক কথায় চোরের মত লাইফ লিড করেছি এবং করছি, যেন কখনো বিরোধীপক্ষের কারো সামনে পড়তে না হয়…
প্রশ্ন: এত দেরিতে মামলা করার কী কারণ? পিয়াসাকে আত্মীয় হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন, এটা কেন?
উত্তর: এতদিন পর কেইস করে কোনো লাভ হবে না জেনেও কেইস করেছি কারণ পিয়াসার সাপোর্ট ছিল। সে আমাদের পক্ষে সাক্ষী দিবে এবং সব রকম হেল্প করবে বলেছিল। পিয়াসাই বলেছিলো আত্মীয় বলতে।
প্রশ্ন: বিচারক রায়ের যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তা আসলে সমাজকে কী বার্তা দিল? আপনি কি মনে করেন নারীরা এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে থানা বা আদালতে যেতে কুণ্ঠাবোধ করবেন?
উত্তর: আমি মনে করি না আর কেউ সাহস পাবে এমন ঘটনা নিয়ে আদালতে যাওয়ার। এই রায় এটাই বুঝাল যে টাকার কাছে আইনও বিক্রি হয়।
প্রশ্ন: আদালত নাঈম আশরাফকে খালাস দিয়েছেন। আপনি কি এখনও তার বিচার চান?
উত্তর: এখনও বিচার চাওয়াটা বোকামিই হবে। আমাদের পক্ষে বলার মতো কেউ নেই, আমি আর বিচার চাই না। আমাদের নিয়ে বানানো বাজে বাজে কথা শোনার আর ক্ষমতা নেই। কিন্তু একটা প্রশ্ন করতে চাই- আসামিদের খালাস দেওয়াতে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়? নাকি আমরা কিছু প্রমাণ করতে পারিনি বলে আমাদের নিরাপত্তার দরকার নেই?
প্রশ্ন: আপনারা কি আপিল করবেন? এ ধরনের ঘটনার শিকার হওয়া নারীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার আছে আপনার?
উত্তর: আমার ফ্যামিলির উপর ছেড়ে দিয়েছি। তাদের সাপোর্ট থাকলে আপিল করব, অন্যথায় এখানেই হাল ছেড়ে দিব। এমন ঘটনার শিকার এমন নারীদের মোটিভেট করার মতো এই মুহূর্তে কিছু বলার নাই আসলে। এই দেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে এখন সবাই কম বেশি জানে। কেইস করে কোনো ভালো ফল আসার পরিবর্তে দুর্নামই আসবে। এরকম ভিকটিমরা যেন আল্লাহ্র কাছে বিচার চায়, আর কেউ সুবিচার দিবে না তাদের।