৫০ বছরে 'নাপাম কন্যা': ভিয়েতনাম যুদ্ধের সেই বিখ্যাত ছবির পেছনের গল্প
চেঁচিয়ে কান্না করতে করতে বাচ্চারা দৌঁড়ে পালাচ্ছে রাস্তা ধরে। কারো পায়ে জুতো নেই। মাঝখানে ৯ বছর বয়সী ছোট্ট একটা মেয়ে, দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে কান্না করছে। তার গায়ে কোনো পোশাক নেই, শরীর ততক্ষণে অনেকটা পুড়ে গেছে। ঠিক পেছনেই দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনাবাহিনীর ২৫ ডিভিশনের কয়েকজন সেনাকে। তারাও নিরুপায়। তাদের ছাড়িয়ে আরও পেছনে নাপাম বোমার আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে ভিয়েতনামি একটা গ্রাম।
ভিয়েতনামের যুদ্ধের সময় নাপাম বোমা থেকে বাঁচতে শিশুদের পালানোর এ ছবিটি বিশ্ববাসীকে নাড়া দিয়েছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধের আসল রূপ জানান দিয়েছিল ওই বিখ্যাত ছবি। 'নাপাম গার্ল' হিসেবে খ্যাত এ ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৯৭২ সালের ৮ জুন ত্র্যাং ব্যাং গ্রামের বাইরে।
ছবির মধ্যমণি হতভাগ্য ওই ভিয়েতনামি মেয়েটির নাম ফান থি কিম ফুক। ছবিটি তুলেছিলেন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-এর চিত্রগ্রাহক নিক উট।
ছবি তোলার পর আহত কিম ফুককে সাহায্য করেছিলেন তিনি। ৫০ বছর পর এখনো এ দুজন নিজেদের সাথে যোগাযোগ রেখেছেন। নিজেদের গল্পের মাধ্যমে সমাজকে দিতে চাইছেন শান্তির বার্তা।
সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কিম ফুক বলেন, "সে মুহূর্তটার কথা আমি কখনো ভুলব না।"
সেদিন জ্বলন্ত শরীর নিয়ে দৌড়ানো এই মেয়েটি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৩ সালের ৬ এপ্রিল। বর্তমানে কানাডার টরন্টোতে বাস করেন তিনি।
সাইগন (অধুনা হো চি মিন সিটি) থেকে কিম ফুকের গ্রাম ত্র্যাং ব্যাং-এর দূরত্ব ৩০ মাইলেরও কম। ১৯৭২ সালে গ্রামটি দখলে নিয়ে নেয় কম্যুনিস্ট সেনারা। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সে সময়কার একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনারা তিন দিন ধরে গ্রাম থেকে তাদেরকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
সেদিন সকালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিমানবাহিনী নাপাম বোমাসহ স্কাইরেইডার বিমান আকাশে ওড়ায়। নাপাম বোমা যে স্থানে পড়ে তা পুরোপুরি জ্বালিয়ে দেয়।
এক বৌদ্ধ মন্দিরে অন্যান্য বেসামরিক নাগরিক ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের কয়েকজন সৈন্যসহ ফুক ও তার পরিবার আশ্রয় নেয়। মাথার ওপর নিজেদের বিমানের শব্দ শোনার পর ওই সৈন্যরা সবাইকে আশ্রয়স্থল ছেড়ে পালাতে বলেন। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিলেন তখুনি আক্রমণ শুরু হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ওই দলটিকেই শত্রু ভেবে ভুল করে বিমানগুলো।
ফুক বলেন, "মাথা ঘুরিয়েই প্লেনগুলো দেখতে পেলাম, এরপরই দেখলাম চারটা বোমা পড়ছে। তারপর হঠাৎ করে চারদিকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। সে আগুনে আমার কাপড়ও জ্বলে গেল। সে মুহূর্তে আমার চারপাশে আমি আগুন ছাড়া আর কিছু দেখতে পাইনি।"
সে মুহূর্তে ঠিক কী ভাবছিলেন সেটার কথাও জানালেন কিম ফুক, "আমি ভাবছিলাম আমার শরীর পুড়ে গেল। আমি দেখতে কুৎসিত হয়ে যাব। মানুষ আমাকে ভিন্নচোখে দেখবে এখন। কিন্ত আমার খুব ভয়ও লাগছিল।"
আগুনে পোড়া জামার অবশিষ্টাংশ ছিঁড়ে রুট ওয়ান হাইওয়ের দিকে ছুটতে শুরু করেছিলেন ফুক। নিক উট তখন ছিলেন ২১ বছর বয়সী তরুণ। ওইদিন তিনিসহ আরও কয়েকজন সাংবাদিক গ্রামের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। তারা ধারণা করেছিলেন সেদিন সেখানে বড় যুদ্ধ হবে।
নিক স্মরণ করেন সেদিনের দৃশ্য, "দেখলাম কিম দৌড়াচ্ছে আর ভিয়েতনামি ভাষায় চিৎকার করছে, 'গরম! খুব গরম!' ছবিটা তোলার পর খেয়াল করলাম তার শরীর মারাত্মকভাবে পুড়ে গেছে। আমি তাৎক্ষণিকভাবে তাকে সাহায্য করতে চাইলাম। ক্যামেরা ও অন্যান্য সরঞ্জাম রাস্তার ওপর রেখে তার শরীরে পানি ঢাললাম।"
এরপর আহত কিমকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে ৩০ মিনিট গাড়ি চালিয়ে কাছের একটি হাসপাতালে পৌঁছান নিক। কিন্তু সেখানে পৌঁছে শুনতে পেলেন হাসপাতালে কোনো জায়গা নেই, তাকে সাইগন যেতে হবে।
"আমি তখন বললাম, 'আগামী এক ঘণ্টার মধ্যে যদি ওর কোনো চিকিৎসা না হয়, তাহলে ওকে আর বাঁচানো যাবে না,'" স্মৃতিচারণ করেন এ সাংবাদিক।
এরপর নিজের প্রেস কার্ড দেখিয়ে কিমকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ডাক্তারদের রাজি করাতে সক্ষম হন নিক। তিনি তাদেরকে বলেছিলেন, এ বাচ্চাদের ছবি কাল সারা বিশ্বের পত্রিকায় ছাপা হবে। এদের একজনও যদি মারা যায়, তাহলে তারা (ডাক্তার) বিপদে পড়বেন।
যে ছবি দেখেছিল বিশ্ববাসী
হাসপাতাল থেকে নিক সাইগনে অবস্থিত এপি'র অফিসে গিয়ে ছবিগুলো ডেভেলপ করেন। সেদিন তার তোলা ছবিগুলোর মধ্যে ছিল: একটি স্কাইরেইডার প্লেনের নিচে শূন্য থেকে পড়ন্ত বোমা, জ্বলন্ত ত্র্যাং ব্যাং গ্রাম থেকে নিঃসৃত ঘন কালো ধোঁয়া, অস্থায়ী স্ট্রেচারে করে একজন আহতকে বয়ে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এ ছবিগুলোতে ওইদিনের ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞের বেশিরভাগই স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছিল।
নিক কিম ফুকের আরও একটা ছবি তুলেছিলেন। তবে সেটা খুব বেশি পরিচিত নয়। ওই ছবিতে দেখা যায় টেলিভিশন ক্রু ও সৈন্যরা ফুকের চারপাশ ঘিরে আছে, আর তার পিঠ ও হাতের চামড়া নাপাম বোমার জেলির ছোঁয়ায় পুড়ে গেছে। নাপামের এই কুখ্যাত জেলির কারণে এ বোমাটি অনেক বেশি বিতর্কিত অস্ত্রে পরিণত হয়েছিল।
নিক অবশ্য তখনই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, তার একটি ছবি বাকিসবগুলো থেকে পুরো আলাদা।
"সেদিন অফিসের ডার্ক রুমে থাকা টেকনিশিয়ান ও অন্যরা যারা ছবিটি দেখেছিল, তারা বলেছিল এটা খুবই শক্তিশালী ছবি এবং এটি পুলিৎজারও জিততে পারে।"
তারা ঠিক ধারণা করেছিলেন। স্পট নিউজ ফটোগ্রাফির জন্য নিক উট ১৯৭৩ সালে পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন। তার ছবিটি যুক্তরাষ্ট্রের ২০টি প্রথম সারির পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল। ছবিটি ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো অভ দ্য ইয়ার হিসেবেও নির্বাচিত হয়।
'নাপাম গার্ল' ছবির কারণে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমাপ্তি ত্বরান্বিত হয়েছে এ দাবির কোনো প্রমাণ নেই। কারণ যুদ্ধ চলেছিল ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। এ ছবির জন্য ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়েও যে মার্কিনীদের মতের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়েছিল, তা-ও নয়। কারণ মার্কিনীরা তার আগে থেকেই ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার ব্যাপারটি নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন। কিন্তু এ ছবিটি যুদ্ধবিরোধিতার প্রতীক হিসেবে মানুষের মনে চিরস্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছিল।
এ ছবিতে নাপাম বোমার নৃশংসতা এত স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল যে, খোদ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সন্দেহ করেছিলেন ছবিটি 'জাল' ছিল কিনা। কয়েক দশক পরে হোয়াইট হাউজ এ সংক্রান্ত রেকর্ড প্রকাশ করার পর নিক তা শুনে 'বেশ মর্মাহত' হয়েছিলেন।
প্রায় ১৪ মাস হাসপাতালে ছিলেন কিম ফুক। ওই বোমাবর্ষণে তার দুই তুতো ভাই-বোন নিহত হয়েছিল। কিন্তু সে ঘটনার স্মৃতি ও সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়া সেই ছবিটির কথা পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন ফুক।
"সত্যি বলতে কী, বাচ্চা হিসেবে আমি খুবই লজ্জিত ছিলাম," বলেন কিম, "ওই ছবিটা কখনোই আমার পছন্দ হয়নি। উনি কেন আমার ছবি তুলবেন? আমি কখনো এটা দেখতে চাইনি।"
কিম ফুকের ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু ভিয়েতনামের কম্যুনিস্ট সরকার তাকে মেডিকেল স্কুল থেকে এনে প্রোপাগান্ডার কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে। বিদেশ থেকে সাংবাদিকেরা এসে তার গল্প শুনতে চাইত। কিন্তু সবার অত মনোযোগের সাথে খাপ খাওয়াতে পারেননি তিনি।
"এসবের কারণে আমার ব্যক্তিগত জীবন প্রভাবিত হয়েছিল। কখনো কখনো আমি 'হারিয়ে যেতে' চেয়েছিলাম," বলেন তিনি, "আমি স্কুলে যেতে পারিনি, নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি। তাই আমি এটাকে অপছন্দও করতে শুরু করেছিলাম," জানান কিম।
আশার প্রতীক
১৯৯২ সালে কিম ফুককে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান করে কানাডা। এরপর নিজের ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডিকে কাজে লাগিয়ে আরও বিস্তৃত পরিসরে ভালো কিছু করার উৎসাহ পান তিনি।
নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লিখেন কিম ফুক। কিম ফাউন্ডেশন ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এ প্রতিষ্ঠানটি যুদ্ধশিশুদের সহায়তা দেওয়ার কাজ করে।
১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের শুভেচ্ছাদূত নির্বাচিত হন কিম ফুক। সারাবিশ্বে নিজের জীবনের গল্প ও ক্ষমার মাহাত্ম্যের কথা বলে বেড়ান তিনি।
নিককে এখনো 'আঙ্কেল' বলে ডাকেন কিম। গত মাসে তারা দুজন সেইন্ট পিটার্স স্কয়ারের পোপ ফ্রান্সিসের হাতে ছবিটির একটি কপি তুলে দিয়েছেন।
"আমি বুঝতে পারলাম যে, আরে এ ছবিটা তো আমার জন্য একটি শক্তিশালী উপহারে পরিণত হলো - এটা দিয়ে আমি শান্তির কাজে ব্যবহার করতে পারি, কারণ এ ছবিটি কখনো আমাকে হারিয়ে যেতে দেয়নি," বলেন কিম।
"এখন আমি পেছনে ফিরে তাকিয়ে সব গ্রহণ করতে পারি...আমি কৃতজ্ঞ নিক ওই মুহূর্তটি ক্যামেরায় ধারণ করতে পেরেছিলন। অন্যদের সহায়তা করার জন্য আমি এখনো স্বপ্ন দেখে যাই," বলেন কিম।
কিম ফুক অনেক বছর ধরে অস্ত্রোপচার ও থেরাপির মধ্যে ছিলেন। কিন্তু এখনো সেই আঘাত থেকে পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি তিনি। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লেজার চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। তবে এখনো মাঝেমধ্যে ব্যথায় কাতরান কিম।
দুই সন্তানের মা কিম ফুক। নিজের ধর্মীয় বিশ্বাসের শক্তিতে জীবনে 'এগিয়ে চলার সাহস' পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
"আজ ৫০ বছর পরে আমি কৃতজ্ঞ যে আমি এখন আর কোনো যুদ্ধের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ নই। আমি একজন সার্ভাইভার এবং আমার সুযোগ রয়েছে শান্তির জন্য কাজ করার," বলেন কিম।
নিক উট এখন অবসরপ্রাপ্ত। তিনি এখনো যুদ্ধের ছবির শক্তিতে বিশ্বাস করেন।
ইউক্রেনে যুদ্ধের কথা ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ভিয়েতনামে যেরকম ওয়ার ফটোগ্রাফি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও তা-ই। আজকাল পাঠক যেরকম হাজার হাজার ছবি দেখতে অভ্যস্ত, তা সামগ্রিকভাবে অতীতের একটি ছবির মতোই শক্তিশালী।
- সিএনএন থেকে অনূদিত