রানিকে দেখা, রানির সাথে দেখা
রানি এলিজাবেথের শাসনামলের প্লাটিনাম জয়ন্তী পালন করছে ব্রিটেন, এদিকে রানির স্বাস্থ্যের অবস্থাও তেমন ভালো না। ছিয়ানব্বই বছর বয়স তার, বিগত কয়েক মাসে প্রিন্স অব ওয়েলসের কাছে বেশ কিছু দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন তিনি। তিনি আর কতোদিন বেঁচে থাকবেন, তার ছেলে চার্লসকে সিংহাসনে বসাবেন কিনা তা-ই এখন দেখার বিষয়।
ব্রিটেনের ইতিহাসে আর কোনো শাসকই রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মতো এতো দীর্ঘ সময় সিংহাসনে ছিলেন না। তার আমলে দেশে ১৪ জন প্রধানমন্ত্রীর পদে এসেছেন। অসংখ্যা বিদেশি নেতাদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে তার। বিশ্বের বিচিত্র অঞ্চল পরিদর্শনে গিয়েছেন তিনি, বিশেষ করে ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীনে ছিল এমন দেশগুলোতে।
কমনওয়েলথের প্রধান হিসেবে এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল তার, তার আমলেই দেশগুলো স্বাধীন হয়েছে। ১৯৫২ সালে সিংহাসনে বসার পর তার সাথে সম্পর্ক অনেক রাজনীতিবিদদের চেয়ে বেশি সময় বেঁচে আছেন তিনি। অনেক রাষ্ট্রনায়ককে সত্যিকার অর্থেই প্রশংসা করেছেন। আবার এমন গল্পও প্রচলিত আছে, কাজের খাতিরে সাক্ষাৎ করতে হয়েছে এমন অনেক বিদেশি রাজনীতিবিদকেই তেমন পছন্দ করতেন না।
তারপর আসে কমনওয়েলথের সাধারণ মানুষ তাকে কতোটা সম্মান করে সে বিষয়। প্রজাতন্ত্রী সরকারের এই যুগেও ব্রিটিশ রাজতন্ত্র বহাল থাকা উচিৎ কিনা এই প্রশ্ন তো ছিলই সবসময়, তবে সবসময়ই বিস্ময় ও প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে।
১৯৬১ সালে তিনি যখন ঢাকা সফরে আসেন, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে, আমি স্কুলে পড়তাম তখন। তবে বর্তমান গণভবনে তার সফরের সময়কার কথা মনে আছে আমার, এক কাজিন নিয়ে যাওয়ায় সৌভাগ্য হয় তাকে দেখার।
গেটের বাইরে বহু মানুষের ভীড়, ভেতরেই ছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও প্রিন্স ফিলিপ। আমি যাতে ঐতিহাসিক এ মুহূর্তের সাক্ষী হতে পারি তা নিশ্চিত করতে আমার সেই কাজিন আমাকে তার কাঁধে উঠিয়ে নেন।
রানি বারান্দায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সবাই উল্লাসে ফেটে পড়ে। সাথে ছিলেন তার স্বামী ও পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল আজম খান।
মনোয়ার দাদার কাঁধে উঠে আমিও খুশিতে চিৎকার করে উঠেছিলাম, রানির দিকে হাত নাড়াই। ভেবেছিলাম আমাকে হয়তো দেখতে পাবেন তিনি। তখনই আমার এক পায়ের জুতা খুলে পরে যায়। কাজিনকে জানাই, তবে এতো মানুষের ভীড়ে ওই জুতা খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল না। রানি ভেতরে চলে যাওয়ার পর আমরা রিকশায় করে মালিবাগের বাসায় ফিরে যাই। পরের দিনই বাবা আমাকে নতুন জুতা কিনে দেন।
এর ৩৬ বছর পর ১৯৯৭ সালে দিনটি আসে। বাকিংহাম প্যালেসে রানির সঙ্গে দেখা হয় আমার। মার্চের শীতের দিন ছিল। এর আগের রাতেই লন্ডনে পৌঁছাই। হাই কমিশনের প্রেসের দায়িত্বে, প্যালেসে হেড অব মিশনকে সঙ্গ দেওয়া কূটনীতিবিদদের মধ্যে আমিও ছিলাম।
প্রথমে হাই-কমিশনার যান, তারপর তার সহকর্মীরা গিয়ে পরিচিত হন। তার চেম্বারের বিশালাকার দরজাটি খুলে যাওয়ার পর কুর্নিশ করতে হয়। এরপর তিন কদম এগিয়ে আবার কুর্নিশ করতে হয়। এরপর আরও তিন কদম এগিয়ে আবারও কুর্নিশ করতে হয়।
রানি তার হাত বাড়িয়ে দিলে সন্তর্পনে স্পর্শ করতে হয়। রানির সঙ্গে হ্যান্ডশেক নয়, আলতো করে ছুয়ে দিতে হয়। এরপর কথাবার্তা হয়, 'ইয়োর ম্যাজেস্টি' বলে সম্বোধন করে তার দেখা পেয়ে কতোটা সৌভাগ্যবান তা বলতে হয়। তিনি নিজেই প্রশ্ন করেন, তাকে প্রশ্ন করার নিয়ম নেই। কোমল স্বরে সংক্ষেপে তার প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়।
এরপর উলটো না ঘুরে একই অবস্থানে থেকেই পেছাতে হয়, আগের ওই তিন কদমের পদ্ধতিতে, তবে উল্টোভাবে। ওই কক্ষ ত্যাগের সময় রানির দিকে পেছন ফেরা যায় না।
এভাবেই রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সাথে দেখা হয়েছিল আমার। হাই-কমিশনার তাকে জানিয়েছিলেন আমি সম্প্রতি সেখানে পৌঁছেছি। ঠান্ডা আবহাওয়ায় আমার কষ্ট করে অপেক্ষা করতে হয়েছে বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন তিনি। যখন আমি তাকে বললাম ঠান্ডা উপভোগ করেছি, আমি শীতকালই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি, তার চোখে বিস্ময় দেখলাম।
এরপর আমি তাকে জানাই সেবার দ্বিতীয় বারের মতো তাকে দেখছি আমি। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আগে কখন দেখেছি। আমি তাকে ১৯৬১ সালের সেই গল্প বললাম। চলে আসার সময় তার মুখে হাসি লেগে ছিল।
এর কয়েক মাস পর বাকিংহাম প্যালেসের গার্ডেন পার্টিতে আমার আর আমার স্ত্রীর রানির সাথে দেখা হওয়ার কথা ছিল। রাজপ্রাসাদের বাগানে নির্মল বাতাস, কূটনীতিবিদ ও তাদের স্বামী-স্ত্রী ও অন্যান্যরা দিনটি উপভোগ করছিলেন।
রানি এলিজাবেথের বয়স হয়েছে। অনেক দুর্বল তিনি। তিনি যখন থাকবেন না, তখনও তার ছায়া তার রাজত্বকে আলোকিত করে যাবে।
- ইংরেজি থেকে অনূদিত, ঈষৎ সংক্ষেপিত.
- মূল লেখা: Seeing the Queen, meeting the Queen