চা পান করেছেন আজ বিশ্ব চা দিবসে?
চা নিয়ে অযুত-নিযুত স্মৃতি আমার সারা বিশ্বজুড়ে, তার মধ্যে থেকে প্রায় ৩০টা মুহূর্ত ভাগাভাগি করি এখানে। কত যে অসামান্য অভিজ্ঞতার জন্ম হয়েছে এই চা পানকে কেন্দ্র করে!
কিংবদন্তি জাপানিজ চিত্রকর হকুসাই ও হিরোসিগের কাঠ খোদাই করা অপূর্ব সব শিল্পকর্ম সেবার প্রথমবারের মত এসেছে জাপানের চৌহদ্দি পেরিয়ে ইউরোপে, হেলসিংকিতে সে চিত্ত হরণ করা প্রদর্শনী দেখে বেরোতে যাচ্ছি জাদুঘরের বাইরে। সেখানেরই একজন কর্মচারী বললো পাশেই চলা প্রাচীন জাপানের জনজীবন নিয়ে অন্য ধরনের এক প্রদর্শনী যেন অবশ্যই দেখে যাই, সেখানে নাকি তুলে আনা হয়েছে কয়েকশ বছর আগের জাপান।
বেশ চিত্তাকর্ষক ছিল প্রদর্শনীটি, জাপানি জীবনের নানা ঘটনায় ও বৈশিষ্ট্যে ভরপুর, তবে মনে বিশেষ ভাবে দাগ কেটে গেছিল তাদের চা-পানের বিষয়টি- সে যেন কেবল পানীয় গলাধকরণ নয়, বরং উপাসনার একটি অংশ। কিভাবে জাপানিরা চিত্ত শুদ্ধ করার জন্য বাগানের মধ্যে অবস্থিত বিশেষ কুটিরে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুঁকে, বিশেষ টুলের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে যেভাবে সন্মান ভরে চা-পান করেন তাকে উপাসনা বলাই শ্রেয়।
এবং তা কেবল জাতি বিশেষের জন্য নয়, চীন থেকে আগত এই অদ্বিতীয় পানীয়, নানা ঘটনা-পরিক্রমা, ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ইত্যাদির কারণে আজ ঠাঁই নিয়েছে সারা বিশ্বে, যে তুষারস্নাত ঊষর প্রান্তরে কোন শস্য হয় না, সেখানের অধিবাসীরাও আজ চায়ের জাদুতে বিমোহিত। সুদূর ল্যাতিন আমেরিকার দেশে চিলি যে কস্মিনকালেও চা উৎপন্ন হয় না সেখানের বাসিন্দাদের দুই বেলা এই চিজটি থাকতেই হবে!
[এখানে একটা তধ্য দেই: ইউরোপের একমাত্র ট্রি প্লান্টেশন, আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে আজোরেস দ্বীপপুঞ্জে, যা পর্তুগাল শাসিত]
চা-য়ের সঙ্গে আড্ডার সম্পর্ক গভীর। বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলেই চা-পান শুধুই চা পান করা নয়, এর সাথেই থাকে ইয়ার-দোস্তদের সাথে মিঠেকড়া বাক্য বিনিময়ের আলাপ-সালাপ।
মাস কয় আগেই বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় দেখলাম সেখানের লোকেরা সারাদিনই রোদে বসে হয় চা, না হয় কফি নিয়ে ব্যস্ত! জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল যে কোনো সুযোগে কাজের ফাঁকে আড্ডায় বসার জন্য চা-কফির কোনো বিকল্প নেই! অনেক সময়ই দেখা গেছে একই অফিসের বড়কর্তা এবং কর্মচারীরা একইসাথে চা পানে ব্যস্ত।
[আরেকটি তথ্য: কালের সাক্ষী জটাধারী এই দাদু বললেন 'এইটিই বরিশালের চালু দোকানদের মধ্যে প্রাচীনতম। ব্রিটিশ আমলের দোকান'। ওনাকে সেই মুহূর্তের কালজয়ী কোন জাদুকর বলে ভ্রম হচ্ছিল। Lone tea-maker in a antique tea shop, his Monk like age and appearance made him looking alike a magician.]
তুরস্কে ব্যাপার আরও চোস্ত, কোন অজুহাতের দরকার নেই, রাস্তায় দেখা হলেই প্রথম কথা হবে- চা হয়ে যাক? তুর্কিদের দিনে অনেক অনেক কাপ চা আর কফি খাওয়া হয়ে যায় এই ভাবেই, যে কারণে মনে হয় তারা ছোট মাপের কাচের পাত্র আবিষ্কার করেছে দিনে অসংখ্যবার চা পানের জন্য। যে কোন তুর্কি ক্যাফেতে (চ্যাফে কেন নয় কেউ তা জানে না!) দেখা যাবে স্বচ্ছ হালকা লিকারের শত শত কাপ চা হারিয়ে যাচ্ছে খানিক পরপরই জনতার সাগরে, তার বিলের হিসাব কে যে রাখছে আর কেই বা দিচ্ছে সে বোঝা প্রায় অসম্ভব কোন বিদেশির জন্য।
[আরেকটি অভিজ্ঞতা:
প্যানগং হ্রদ থেকে ফেরার সময় আমাদের চালক তেঞ্জিং সাবকে অনুরোধ করেছিলাম পথে যে কোন একটা ছোট গ্রামে থামার জন্য। তার কথা - "এই গ্রামে তো দেখার কিছুই নাই।" যতই বলি - "কিছুই দেখার নাই বলেই থামতে চাই সেখানে, দুয়েক জনের সাথে কথা বলতে চাই, পারলে চায়ের দোকানে এক কাপ চমরী গাইয়ের দুধের চা খেতে চাই"। সে বলে "এত্ত ছোট গাঁওতে চায়ের দোকান হয় না"। শেষমেশ বেচারা আমাদের উৎসাহে তাঁর এক আত্মীয়কে ফোন করে চায়ের দাওয়াত নিল।
ছিমছাম, পরিপাটি, রঙিন লাদাখি বাড়ি। আঙ্কেল এবং আন্টিজি এক মুহূর্তেই আমাদের আপন করে নিলেন, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন তাদের আবাস- রান্নাঘর, বৈঠকখানা, যেখানে পা ছড়িয়ে বসে চা আর বিস্কিট খেলাম সকলে। জানতে চাইলাম তাদের বাড়িতে এত কাপ, পাত্র, ফ্লাস্ক, সামোভার কেন? আন্টি হেসে বললেন "এটাই লাদাখের রীতি"।
সমস্ত ট্রিপের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত ছিল সেই দম্পতির সাথে কাটানো সময়টুকু। যেখানেই যান, যদি স্থানীয়দের সাথে সামান্য স্মৃতিও না জন্ম নেয়, তাহলে সেই ভ্রমণ সম্পূর্ণ হয় না।]
চায়ের জন্ম যে চীনদেশে তারই একাংশে, হিমালয়ের কোলে অধিষ্ঠিত তিব্বতে চা খাওয়া হয় ভিনগ্রহের পদ্ধতিতে, চিনি নয় বরং লবণ দিয়ে! এখানেই শেষ নয়, ঘন সেই চায়ে মিশিয়ে দেওয়া হয় চমরী গরুর দুধ থেকে তৈরি মাখনের এত্ত বড় এক ডেলা! যাতে লেপটে থাকে তিব্বতের কোন অজানার তাবুর ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ। প্রথম যখন সেই অদ্ভুতুড়ে পানীয় আস্বাদ করেছিলাম, তখন সেই ঘন ক্বাথকে চা-য়ের বদলে স্যুপ মনে করাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছিল। হিমালয়ের হিমকে এর মাধ্যমেই দূর করতে পেরেছিলাম অনেকক্ষণের জন্য।
চা যে কেবল চা পাতা দিয়ে তৈরি হতে হবে এমন কোন কথা নেই চীনে, ফলে নানা ধরনের গাছের পাতা, লতা, ফুল সবকিছু দিয়েই তৈরি হয় জাত-বেজাতের চা এবং সেগুলো এখন ঠাই নিয়েছে দেশ ছাড়িয়ে নানা মহাদেশের বিপণন কেন্দ্রে।
মধ্য ইউরোপে চা-বার বেশ জনপ্রিয়, এক দোকানেই মিলতে পারে কয়েক শত ধরনের চা! দানিয়ুব তীরের হাঙ্গেরির এক দোকানে প্রথমবারের মত জেসমিন ফুলের চা পানের কথা বেশ উজ্জল ভাবে মনে পড়ে, শুকিয়ে থাকা এক রত্তি গুড়ো কিসিমের একটা জিনিস যখন গরম জলের সংস্পর্শে আস্তে আস্তে পাপড়ি ছড়াতে ছড়াতে কাপের উপরিভাগে বিশাল এক পদ্মের মত ভেসে উঠল, তখন বুঝলাম- চা পানের সাথে সাথে পরিবেশনটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
খোদ বিলেতবাসীদের বৈকালিক চা প্রীতির কথা বিশ্ব নন্দিত, এমনকি রানি এলিজাবেথের জন্য স্পেশাল চা যে দার্জিলিং থেকে যায় একথা সকলেরই জানা, যদিও চায়ের দেশ আসামের চা পান করে রানির কৃপা কেন এদিকে পড়ে ভেবে বিস্ময়াভূত হয়েছিলাম বটে। তুরস্কের লোকেরা চায়ে দুধ মেশানোর কথা বললেই তওবা তওবা করে ওঠে, ঠিক যেমন আমরা বাংলা মুলুকের লোকেরা আঁতকে উঠি চায়ে লবণ মিশিয়ে দিলে!
এভাবেই চা আজ পরিণত বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পানীয়তে- যার পরিবেশনা, উপস্থাপনা এমনকি উপাদান পরিবর্তিত হয়েছে অঞ্চলভেদে কিন্তু আবেদন থেকেছে অটুট হয়ে।
জয় চা!
(চা পান করা প্রথম বাঙালির নাম মনে আছে তো? অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান।)