পুরনো ডাকটিকেট, মুদ্রা, নোট সংগ্রহ করে কারা? আবার বিক্রিও হয় জমজমাট নিলামে
সাধারণত আপনার-আমার মধ্যে টাকা জমিয়ে ভবিষ্যতের জন্য বাড়ি-গাড়ি, স্বর্ণ কিংবা দামি জিনিসপত্র কেনার ঝোঁক থাকবে। কিন্তু একদল লোক আছে যাদের নেশা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুর্লভ ও পুরনো ডাকটিকেট, ব্যাংকনোট, পয়সা সংগ্রহ করে নিজেদের সংরক্ষণে রাখা। আর এই কাজটি করতে তারা ছুটে যান দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায়। প্রশ্ন জাগতে পারে, এতো কিছু থাকতে ডাকটিকেট, ব্যাংকনোট কেন সংগ্রহ করছেন! এই সংগ্রহদাতাদের শখ শুধু যেনতেনভাবে সংগ্রহ করা না, এদের অনেকেরই রয়েছে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান, যেখানে তারা নিয়মিত নিলামের আয়োজন করে দুর্লভ এসব বস্তু কেনাবেচাও করেন।
চিঠি-ডাকটিকিট
কেউ কেউ ছোটবেলা থেকে এ পর্যন্ত শতশত পুরোনো খাম, ডাকটিকেট জমিয়ে নিজেদের সংগ্রহের ঝুলিতে রেখেছেন। সময়টা ছিল চিঠির যুগ, তখন বর্তমান সময়ের মতো আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি ছিলো না। তাই যোগাযোগ করার প্রধান মাধ্যম ছিল চিঠি লিখে খামে ভরে তা গন্তব্যে পাঠিয়ে দেওয়া। বর্তমানে সরকারি কাজে চিঠির আদান-প্রদান দেখা গেলেও, ব্যক্তিগত যোগাযোগে এই খামে ভরে চিঠির ব্যবহার প্রায় উঠেই গেছে বলা চলে। কিন্তু এতে থেমে নেই ডাকটিকেট সংগ্রহ ও কেনাবেচার কাজ। তবে এসব পুরোনো ডাকটিকেট, মুদ্রা, ব্যাংকনোটের সংগ্রহদাতা আসলে কারা! আর কেনই বা তারা এগুলো জমাচ্ছেন? নিলামেই বা কারা অংশ নেন, আর কারা এর ক্রেতা!
পুরোনো জিনিসই যখন মূল্যবান হয়ে উঠে
বাইতুল মোকাররম মসজিদের পাশে রয়েছে ডাক অধিদপ্তর বিভাগ, গেটের প্রবেশমুখের পাশেই মিলবে জিপিও ক্যান্টিন। এই ক্যান্টিনেই আয়োজন করা হয় নিলাম অনুষ্ঠানের। মাসের শুক্রবারগুলোতে ঘটা করে চলে এ নিলাম অনুষ্ঠান। এখানে নানাপ্রান্ত থেকে অংশগ্রহণকারীরা হাজির হয় তাদের দুর্লভ সব সংগ্রহ নিয়ে, নিলামে উপস্থিত সংগ্রাহক-ক্রেতা উভয়ের মতেই এই নিলাম দেশের সবচেয়ে বড় এবং সমৃদ্ধ। অন্য কোথাও এখানকার মতো কালেকশন পাওয়া যায় না।
ক্যান্টিনে ঢুকতেই চোখে পড়লো অনেক লোক, অপেক্ষা করছেন অনুষ্ঠান শুরুর। টেবিলের ওপর অসংখ্য খামে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ডাকটিকেট। কোনটিতে আবার আছে আগেকার দিনে প্রচলিত মুদ্রা, ব্যাংকনোট, ম্যাচবাক্স, বই, ম্যাগাজিন, পুরোনো লটারি টিকেট, নির্বাচনী লিফলেট, পত্রিকা, ভিউকার্ডসহ আরও কতো কী! প্রতিটি খামের ওপর দাম লিখে দিয়েছে বিক্রেতা। সেই মূল্য ধরেই দাম হাঁকানো শুরু হয়।
নিলাম অনুষ্ঠান সকাল ১০টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও লোকের সমাগম বাড়তে বাড়তে ঘড়ির কাঁটা তখন ১১টা ছুঁইছুঁই। একটা টেবিলের ওপর ট্রেতে রাখা কাঠের হাতুড়ি। যিনি নিলামে দাম হাঁকাবেন তিনি কাঠের হাতুড়ি দিয়ে টেবিলে আঘাত করতেই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। এক এক করে খাম খুলে খুলে দাম হাঁকানো শুরু করলেন। পুরোনো কিছু ডাকটিকেট হাতে নিয়ে তা উঁচিয়ে দেখিয়ে বললেন, "এগুলো ব্রিটিশ ইন্ডিয়া আমলে চিঠিপত্রে ব্যবহৃত স্ট্যাম্প"। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। দাম চড়তে শুরু করল, অনেকেই এই দুর্লভ জিনিসটির মালিক হতে চান। হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আফসোস নিয়ে বাড়ি ফিরতে চান না! ৫০০ থেকে দাম শুরু হয়েছিল, একজন ৫১০, অপরজন ৫২০ এরকম করে বাড়তে বাড়তে তা ৫৮০ এর ঘরে গিয়ে থামলো এবং শেষ পর্যন্ত এ দাম বলা ব্যক্তিই বিজয়ী হলেন দুর্লভ এই ডাকটিকেটগুলোর।
নিছক দর্শক গোছের কিছু লোক গরমে হাসফাঁস করলেও, ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভ্রক্ষেপ সেদিকে ছিল না, তারা ব্যস্ত দরদাম হাঁকানো নিয়ে। কিছু কিছু ডাকটিকেট দেখা গেল যা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ছাপানো হলেও ব্যবহারের পূর্বেই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই ব্যতিক্রমী সংগ্রহ অবশ্য তেমন সাড়া ফেলতে পারল না। আগ্রহী লোক পাওয়া গেল না। পাশে দাঁড়ানো এক সংগ্রাহক বলে উঠলেন "ব্যবহার করা টিকেট হলে নিতাম, থাক এটা নিবো না"।
যত পুরনো আর বিবর্ণ, এসব বস্তুর যেন তত দাম, তত আগ্রহী ক্রেতা। নানা কারণে পুরনো, ব্যবহৃত এসব স্ট্যাম্পের গুরুত্ব সমীহ জাগানো, এই স্ট্যাম্প দূর অতীতের, নোটগুলো সেই কোন সময়ের ইতিহাসের স্মৃতি, তথ্য যেন জানান দিচ্ছে!
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন বিভিন্ন দেশ থেকে তাকে লেখা চিঠিতে ব্যবহৃত স্ট্যাম্পগুলোর কিছু ডাকবিভাগ এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ কেউ যত্ন করে সংরক্ষণ করে রেখে দিয়েছিলেন নিজেদের কাছে। সেগুলোও নিলামে চড়া দামে বিক্রি হলো। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জসীমউদ্দীনের মতো বিখ্যাত কবিদের ছবি সম্বলিত স্ট্যাম্প একসময় চালু করেছিল ডাকবিভাগ। সেগুলোও পেতে অনেক আগ্রহী লোকের দেখা মিলল। তাই প্রাথমিক মূল্যের চেয়ে অনেকটা বেশি দামেই বিক্রি হলো সেগুলো।
১০০ বছরেরও পুরোনো মুদ্রা, ডাকটিকেট রয়েছে কোন কোন সংগ্রহদাতার কাছে। বেশিরভাগ লোক শখের নেশায় বহু আগে থেকে সংগ্রহ করে আসছেন বিধায় এগুলোর যথাযথ সংরক্ষণেও রাখেননি কোনপ্রকার ত্রুটি। তাইতো দশকের পর দশক ধরে ছোট্ট এই কাগজের টুকরোগুলোয় নিষ্ঠা ও যত্নের ছাপ।
মোঃ লুৎফর রহমান নিলাম থেকে দুর্লভ ও কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া জিনিসপত্র কিনতে এসেছেন। ইতিমধ্যে তার সংগ্রহশালায় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের দুষ্প্রাপ্য সব ডাকটিকেট, মুদ্রা, ব্যাংকনোট রয়েছে; যেগুলো মূল্য বিবেচনায় প্রায় ১ কোটি টাকার কাছাকাছি। শুধু দেশে নয়, বিদেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন দেশের ডাকটিকেট, মুদ্রা প্রদর্শনী ও নিলাম অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। সংগ্রহকারকের পাশাপাশি তিনি একজন লর্ডদাতা। অর্থাৎ তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করে তা অন্যান্য দেশে নিয়ে গিয়ে বিক্রিও করেন। কীভাবে এটি তার নেশা থেকে পেশায় পরিণত হলো তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আমার ছোটবেলায় চিঠির প্রচলন খুব বেশি ছিল। খাম থেকে চিঠির ওপরে থাকা স্ট্যাম্পগুলো কেটে সংগ্রহ করতে আমার ভালো লাগতো। আমাদের বন্ধুমহলে এটা খুব চলতো কার কাছে কী পরিমাণ স্ট্যাম্প আছে। তারপর ধীরে ধীরে বড় হওয়ার পাশাপাশি এই বিষয়ে আমার জানার আগ্রহ আরও বাড়তে থাকে। ফেসবুক চালু হওয়ার পর সেখানে স্ট্যাম্প নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন গ্রুপের সাথে যুক্ত হওয়া শুরু করলাম। সেখান থেকেই বিভিন্ন প্রদর্শনী ও নিলামের খবর জানতে পেরে সেখানে ছুটে যেতাম। তার আগ পর্যন্ত আমি শুধু সংগ্রহ করতাম। তারপর ধীরে ধীরে আমি অন্যদের কাছে আমার সংগ্রহ করা স্ট্যাম্প বিক্রি করতে শুরু করলাম।"
মোঃ এনামুল হক রাজুর কাছে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়ে আসা বিভিন্ন মুদ্রা রয়েছে। বিশ্বের মাত্র ৪/৫টি দেশ বাদে প্রায় প্রতিটি দেশের বহু পুরোনো ব্যাংকনোটও সংরক্ষিত আছে তার নিকট। এগুলো তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে নিলাম অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী থেকে সংগ্রহ করেছেন। মুদ্রা ও নোট সংগ্রহকারীদের নিজস্ব একটি গ্রুপ আছে। এর মধ্যে এনামুল হক রাজু 'বাংলাদেশ নিউমেসমেটিক সোসাইটি' এর একজন সক্রিয় সদস্য। এই গ্রুপটি আগামী ৩ জুন ঢাকার ওয়ারীর এক স্কুলে 'শখের মেলা' নামক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে যাচ্ছে। তিনি এই নিলামে কেনাকাটার পাশাপাশি জনসংযোগও চালাচ্ছেন। রাজু জানালেন, ঐ অনুষ্ঠানে মুদ্রা-নোট কেনাবেচার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা আসবেন নিজেদের সংগ্রহে থাকা জিনিসের পসরা নিয়ে। এটাও এক ধরনের নিলাম ও প্রদর্শনী। তিনি আরো জানালেন তার সোসাইটি আগেও তিনটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। সেখানেও বহু ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম হয়েছিল।
ব্যাংকনোট বা মুদ্রা সংরক্ষণে একেকজন সংগ্রহকারক একেকরকম থিম অনুসরণ করে কাজ করেন। প্রদর্শনীতেও থিম অনুযায়ী কয়েকটি বিভাগে ভাগ করে নোট ও মুদ্রাগুলোকে সাজানো হয়। কেউ নিজেদের সংগ্রহে রাখতে চান পশুপাখির দৃশ্যবিশিষ্ট নোট। কারও আবার পছন্দ মসজিদ, ঝরনার ছবি সম্বলিত টাকা। এভাবে একটি একটি থিমকে সামনে রেখে সংগ্রহদাতারা ব্যাংকনোট জোগাড়ে পুরো সময় ব্যয় করেন।
নিলামের আয়োজন করে কারা
বাংলাদেশে কয়েকটি গ্রুপ ও ব্যক্তি পর্যায়ে হাজার সংখ্যক লোক পুরোনো ডাকটিকেট, মুদ্রা, ব্যাংক নোট সংগ্রহ করলেও দুটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা এই বিষয়ক নানা আয়োজন করে। একটির নাম 'বাংলাদেশ ন্যাশনাল ফিলাটেলিক অ্যাসোসিয়েশন (বিএনপিএ) আর অন্যটি হচ্ছে ফিলাটেলিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (পিএবি)। মাসের ১ম ও ৩য় শুক্রবারে ন্যাশনাল ফিলাটেলিক অ্যাসোসিয়েশন জিপিও ক্যান্টিনে নিলাম অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আর মাসের ২য় ও ৪র্থ শুক্রবার নিলাম ডাকা হয় ফিলাটেলিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। প্রতিষ্ঠান দুটি থেকে এ পর্যন্ত ৩১২টি নিলাম অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে। প্রতিটি আয়োজনে ৫০ জনের ওপর লোক জমায়েত হোন কেনাবেচায় অংশ নিতে।
বাংলাদেশ ডাকবিভাগ জাতীয় পর্যায়ে ১৯৮৪ ও ১৯৯২ সালে ২বার প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। তারপর থেকে বছরে ২ বার 'ফিলাটেলিক ফেডারেশন' থেকে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন স্থানে ওয়ার্কশপের আয়োজন করে ডাকটিকেট সংরক্ষণে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করা, এবং কীভাবে অক্ষত অবস্থায় খাম থেকে স্ট্যাম্প সংরক্ষণ করা যায় সে বিষয়ক ধারণা দেয়। ফিলাটেলিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক-এটিএম আনোয়ারুল কাদির ডাকটিকেট সংরক্ষণের পদ্ধতি বর্ণনা করে বলেন, "খাম থেকে টেনে ডাকটিকেট তুলতে গেলে এটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। খামের ওপর থেকে স্ট্যাম্পের অংশটুকু কেটে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তাহলে সহজেই খাম থেকে স্ট্যাম্প আলাদা করা সম্ভব হবে এবং ছিঁড়ে যাবে না। তারপর নিউজপেপার নিয়ে স্ট্যাম্পটি মাঝে রেখে চাপ দিয়ে পানি শুষে নিতে হবে। এভাবে অনেকদিন পর্যন্ত ডাকটিকেট সংরক্ষণ করা যায়"। এটা সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি।
১৯৮৭ সালে গঠিত হওয়া ফিলাটেলিক অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (পিএবি) বর্তমানে ৪৫০ জনের বেশি সদস্য রয়েছে। যাদের মধ্যে নারী সংগ্রহদাতা রয়েছেন ১৮-২০ জনের মতো।
শুধু রাজধানীতে নয়, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি জেলায় চলে এই ধরনের নিলামের আয়োজন। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রদর্শনীর আয়োজন করতে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ডাকবিভাগ থেকে নিলাম আয়োজনের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থান বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও এতো দশক পরেও তা মেলেনি। তাইতো জিপিওর রঙচটা জীর্ণ ক্যান্টিনই হয়ে উঠেছে নিলাম অনুষ্ঠান আয়োজন করার স্থান। এমনকি নিজ অর্থায়নে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রদর্শনীর জন্য কয়েকটি ডিসপ্লে বোর্ড বানিয়ে নিয়েছে।