সাইকেলে প্রথম বিশ্বভ্রমণকারীর চোখে যেমন ছিল ভারতবর্ষ
টমাস স্টিভেন্স ছিলেন বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি যিনি সাইকেলে চড়ে বিশ্বভ্রমণ করেছিলেন। তার ভ্রমণ তালিকায় ভারতবর্ষও ছিল। ১৮৮৮ সালে এ সাইক্লিস্ট তেহেরান টু ইয়োকোহামা নামের একটি বই লিখেন। সেখানে তিনি ভারতের একটি সড়ককে বাইসাইকেলের জন্য সবচেয়ে চমৎকার সড়ক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
সেসময়ের বিখ্যাত দ্য গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড ছিল স্টিভেন্স-এর চোখে সাইকেল চালানোর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সড়ক। তিনি লিখেন, 'আফগান ফ্রন্টিয়ারের পেশওয়ার থেকে কলকাতা, (গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড) হচ্ছে চমৎকারিত্বের আতিশয্যপূর্ণ একটি অখণ্ড মহাসড়ক। দ্য গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডটি স্থানীয় একধরনের চুনাপাথর দিয়ে পাকা করা হয়েছিল যাকে স্টিভেন্স 'কুনাখ' নামে অভিহিত করেছিলেন তার লেখায়।
১৮৮৬ সালে আগস্ট মাসের শুরুর দিকে টমাস স্টিভেন্স প্রথমবারের মতো ভারতে পা দেন। তার আগেই প্রায় দুবছরের মতো পৃথিবী ঘোরা হয়ে গেছে এ পর্যটকের। বাইসাইকেলে চড়লেও মাঝেমধ্যে তাকে জাহাজ, রেলগাড়িতে চড়তে হতো। ১৮৮৫ সালের এপ্রিল মাসে স্টিভেন্স প্রথমবারের মতো নিউ ইয়র্ক থেকে তার সাইকেল যাত্রা শুরু করেন। তিনি যে সাইকেলটি তার বিশ্বভ্রমণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন, সেটি ছিল একটি কলম্বিয়া অর্ডিনারি। ইংল্যান্ডে এ সাইকেলটি তখন 'পেনি ফার্দিং' নামে বেশি জনপ্রিয় ছিল।
সাইকেলটির সামনে চাকাটি ছিল পেছনের চাকার চেয়ে তিনগুণ বেশি উঁচু। তাই আরোহীকে এ সাইকেলে চড়তে হলে একটা ছোটখাট বেঞ্চ বা চৌকিতে দাঁড়িয়ে তবেই চড়তে হতো। লোহার তৈরি কাঠামো, রবারের টায়ার, প্লেইন বিয়ারিং, স্টিয়ারিং, চাকা; এসবের সমন্বয়ে তৈরি কলম্বিয়া অর্ডিনারি ছিল তার আগের ডিজাইনগুলোর একটি উন্নততর রূপ।
সেসময়ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন স্টিভেন্স। তার স্পন্সর ছিল পোপ ম্যানফ্যাকচারিং কোম্পানি নামের তৎকালীন একটি সাইকেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া আউটিং নামের মার্কিন একটি ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখার চুক্তি ছিল তার।
স্টিভেন্সের এই যাত্রাটি ছিল প্রথমবারের মতো জলপথে কারও পৃথিবী প্রদক্ষিণের যাত্রা। আমেরিকা থেকে ইউরোপ ও এশিয়ায় পদার্পণের জন্য তাকে স্বভাবতই জাহাজে চড়ে আটলান্টিক মহাসাগর পার হতে হয়েছিল। তার এশিয়া ভ্রমণের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল মার্কিনীদের প্রাচ্য বা 'অরিয়েন্ট'দের সম্পর্কে ধারণা দেওয়া।
স্টিভেন্সের এ যাত্রার আরেকটি বিশেষ কারণ ছিল। আমেরিকানদের মাঝে সাইক্লিং-কে একটি খেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস করেছিলেন স্টিভেন্স ও তার পৃষ্ঠপোষকেরা। গ্ল্যাডিস মিলারসহ অন্য ঐতিহাসিকেরা এ ধারণাকে সমর্থন করেছেন।
ইতিহাসবিদদের তথ্য অনুযায়ী, মার্কিনীদের মধ্যে অবসরযাপন ও খেলাধুলার সংস্কৃতি সেই ১৮৭০-এর দশক থেকে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে। ১৮৭৬ থেকে ১৮৮৯ সালের মধ্যে মার্কিন পত্রিকাগুলো খেলার জন্য আলাদা একটি পাতা বরাদ্দ করতে শুরু করে। একই সময়কালে দেশটিতে বিভিন্ন খেলাধুলা সংক্রান্ত সংস্থাও জন্ম নিতে শুরু করে। ১৮৮০ সালে দ্য লিগ অভ আমেরিকান হুইলমেন (সাইক্লিস্ট) প্রতিষ্ঠিত হয়।
টমাস স্টিভেন্স-এর প্রাথমিক জীবন
১৮৫৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর লন্ডনের উত্তরে বার্খামস্টেডে জন্মগ্রহণ করেন টমাস স্টিভেন্স। ১৭ বছর বয়সে নিজে নিজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান স্টিভেন্স। সেখানে মিসৌরির পশ্চিমে একটি রেইলরোডে কাজ শুরু করেন তিনি। কিন্তু স্থানীয়দের সাথে এক ভুল বোঝাবুঝির কারণে তাকে মিসৌরি ছেড়ে কলোরাডোতে চলে যেতে হয়। নতুন জায়গায় খনিতে কাজ শুরু করেন তিনি। জীবনের এই পর্যায়ে কোনোভাবে সাইক্লিং-এর সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন স্টিভেন্স।
১৮৮৪ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট মাসে প্রথমবারের মতো সানফ্রান্সিসকো থেকে বোস্টন পর্যন্ত পাঁচমাস সময়ব্যাপী দীর্ঘ ৩০০০ মাইল পথের এক সাইকেলযাত্রার মাধ্যমে স্টিভেন্স সাধারণের নজরে আসেন।
১৮৮৫ সালের এপ্রিল মাসে স্টিভেন্স-এর সাইকেল নিয়ে বিশ্বভ্রমণ শুরু হয়। জাহাজে চড়ে নিউ ইয়র্ক থেকে লিভারপুলে পৌঁছান তিনি। সেখান থেকে ইউরোপ ও পরে এশিয়ার দিকে সাইকেল ছোটান তিনি। অবশ্য এশিয়ার দিকে যাত্রা শুরু করার পরে তাকে কিছু বিপত্তির মুখে পড়তে হয়েছিল। রাশিয়ায় তাকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি, ব্রিটিশ সরকার তাকে নিরাপত্তাজনিত কারণে আফগানিস্তানেও প্রবেশ করার অনুমতি দেননি।
হেরাত যাওয়ার পথে তাকে গ্রেপ্তার করে পার্সিয়াতে ফেরত পাঠানো হয়। সেখান থেকে তিনি মোটামুটি জটিল একটি পথ ধরে ভারতবর্ষের দিকে যাত্রা শুরু করেন। কাসপিয়ান সাগর পর্যন্ত পৌঁছে তারপর স্টিমারে আজারবাইজানের রাজধানী বাকু'র দিকে রওনা দেন তিনি। এরপর রেল ও জলপথ ব্যবহার করে জর্জিয়া ও তুরস্ক হয়ে মিশর থেকে লাহোরে পৌঁছান স্টিভেন্স। লাহোর থেকে সাইকেলে চড়ে ভারতে প্রবেশ করেন এ অভিযাত্রী।
স্টিভেন্স-এর ভারতভ্রমণ
স্টিভেন্স-এর চোখে অবিভক্ত ভারতবর্ষ ছিল রঙিন একটি দেশ। তার লেখায় তিনি ভারতের সংস্কৃতি, মানুষজন, স্থাপনার কথা বর্ণনা করেছেন। তার বর্ণনায় জানা যায় সেসময ভারতের নারীরা প্রচুর অলংকার পরিধান করতেন, রাস্তাগুলোতে গরুর গাড়িতে করে সবসময় মানুষের যাতায়াত ছিল, এসব রাস্তা গাড়োয়ান ও যাত্রীদের গানে মুখরিত থাকত। তার লেখায় তিনি আরও বর্ণনা করেছেন দিল্লির কুতুব মিনারের সৌন্দর্য ও এর ওপর থেকে দিল্লি কেমন দেখাত তার রূপ।
ভারতের বাই নাচ (নচ ড্যান্স) নিয়েও নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখে গেছেন সাইক্লিস্ট স্টিভেন্স। তখন পশ্চিমের অনেকে এ নাচকে অশ্লীল হিসেবে বিবেচনা করতেন। তবে সে ভুল ধারণাকে খণ্ডন করে গেছেন এ সাইক্লিস্ট। তিনি লিখেছেন, এ নাচকে চাইলেই অশ্লীলভাবে প্রদর্শন করা সম্ভব কিন্তু ঠিকভাবে নাচা হলে এটি হয়ে ওঠে একটি নান্দনিক শিল্প।
বেনারসের নিগূঢ় ধর্মীয় আবহে মুগ্ধ হয়েছিলেন টমাস স্টিভেন্স। তার লেখা থেকে আরও জানা যায়, এলাহাবাদে ডাকপিয়নদের নিজস্ব সাইকেল ছিল। তৎকালীন বাংলা অঞ্চলেও সাইকেল নিয়ে ঘুরে গিয়েছিলেন এ মার্কিনী। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের মেঘগুলোকে দেখে মনে হতো সেগুলো বুঝি গাছের মাথায় এসে নেমেছে। কড়া বৃষ্টি না হলেও এখানে প্রায়ই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির দেখা মিলতো। স্টিভেন্স যখন বাংলায় ভ্রমণ করেছিলেন, তখন এখানকার মানুষ ম্যালেরিয়াসহ অন্যান্য রোগে হরহামেশাই মারা যাচ্ছিল। তবে সেসব থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি।
ভারত থেকে চীনে পৌঁছান স্টিভেন্স। তবে সেখানে কিছু দুর্ভাগ্যের মুখে পড়তে হয় তাকে। আজকের ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চল টনকিন-এ পৌঁছালে সেখানে তিনি সাইনো-ফ্রেঞ্চ যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে যান। চীন থেকে জাপানের নাগাসাকিতে পৌঁছান তিনি। সেখানে তিন সপ্তাহ সাইকেলে ভ্রমণের পর পুনরায় সান ফ্রান্সিসকোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন তিনি। প্রায় দুই বছর বিশ্বভ্রমণের পর ১৮৮৭ সালে জানুয়ারি মাসে আমেরিকা পৌঁছান স্টিভেন্স।
স্টিভেন্স-এর শেষজীবন
দেশে ফিরে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন টমাস স্টিভেন্স। নিয়মিত বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশ করতে শুরু করেন তিনি। ১৮৯০ সালে তাকে মার্কিন নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। একই বছর তিনি আফ্রিকায় তার অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে লেখা প্রকাশ করেন।
১৮৯১ সালে নিজের সাইকেলটি একটি ঘোড়ার জন্য বিনিময় করেন স্টিভেন্স। এরপর তিনি জার শাসনের অধীনে থাকা রাশিয়া ভ্রমণ করেন। সেখানে তার সাথে দেখা হয় প্রখ্যাত লেখক লিও তলস্তয়ের সাথে। এরপর পুনরায় ভারতবর্ষে দেখা যায় তাকে। ১৮৯৪ সালে ভারতের হিন্দু যোগীদের নিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করার জন্য তিনি দ্বিতীয়বারের মতো ভারত ভ্রমণ করেন। এ ভ্রমণের বিস্তারিত কোথাও না পাওয়া গেলেও তিনি যোগীদের জীবনাচরণ নিয়ে মার্কিন সংবাদপত্রগুলোতে বেশকিছু লেখা প্রকাশ করেছিলেন।
জীবনের শেষদিকে এসে মোটামুটি একটি সহজ জীবন বেছে নিয়েছিলেন এ অভিযাত্রী। ১৯৩৫ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি লন্ডনের একটি থিয়েটারে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন।
স্ক্রল ডট ইন থেকে সংক্ষেপে অনূদিত