রাণী রাসমণি: ভারতবর্ষের প্রথম দিকের নারী উদ্যোক্তা
জনদরদি শাসক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন রাণী রাসমণি। শাসনকালে অনেক জনহিতকর কাজ করেন তিনি। তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে সুবর্ণরেখা নদী থেকে পুরী পর্যন্ত একটি সড়ক পথ নির্মাণ করিয়ে দেন তিনি। ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি ও হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠাকালেও অর্থসাহায্য করেন।
তবে এসবের বাইরেও রাণী রাসমণি ছিলেন সফল ব্যবসায়ী।
'নারী উদ্যোক্তা' ধারণাটি কয়েক দশক আগেও অপরিচিত ছিল। এই কয়েক দশক আগপর্যন্তও উপমহাদেশে একজন নারীর ভূমিকা ছিল পরিবারের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ। নারীকে ঘরকন্নার কাজেই দেখতে চাইত সবাই। রাণী রাসমণির আমলে (উনিশ শতকে) তো নারীকে ঘর থেকে বেরই হতে দেওয়া হতো না। ওই যুগে একজন নারীর শাসনকার্য ও ব্যবসায় একাধারে সফল হওয়া ছিল বিরলতম ঘটনা।
কিন্তু অসামান্য প্রজ্ঞা ও মেধায় এ দুই অকল্পনীয় সাফল্যই করায়ত্ত করেন রাণী রাসমণি। অদম্য প্রাণশক্তি, প্রখর ব্যবসায়িক দক্ষতা এবং উনিশ শতকের বাংলায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন তিনি।
উনিশ শতকে ব্রিটিশরা ক্রমবর্ধমান ইউরোপীয় জনসংখ্যার জন্য এবং তাদের বর্ধিষ্ণু ভারতীয় সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কলকাতাকে প্রাচ্যের লন্ডন বানাতে চেয়েছিল। কলকাতা ছিল জৌলুসপূর্ণ, সমৃদ্ধ শহর।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় অভিজাত পরিবারের নারীরা থাকতেন পর্দার আড়ালে। ঘর থেকে বের হলেও চারদিকে পর্দাঘেরা পালকিতে চেপে যাতায়াত করতেন, যাতে বাইরের কোনো পুরুষ তাদের চেহারা দেখতে না পারে। সেটা এমন এক সময় ছিল যখন বেশিরভাগ বয়ঃসন্ধির আগেই অধিকাংশ মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যেত। আর যৌবনপ্রাপ্তির পর সন্তানধারণ ছাড়া আর কিছু ভাবারই সুযোগ দেওয়া হতো না।
এমনই এক সময়ে আবির্ভাব রাণী রাসমণির।
রাণী রাসমণির জন্ম ১৭৯৩ সালে, বর্তমান চব্বিশ পরগনার কোনা গ্রামের এক মাহিষ্য পরিবারে। মাত্র সাত বছর বয়সে মাকে হারান। মাত্র এগারো বছর বয়সে তার বিয়ে হয় কলকাতার জানবাজারের ধনী জমিদার বাবু রাজচন্দ্র দাসের সঙ্গে।
বাবু রাজচন্দ্র ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মুক্তচিন্তার মানুষ। নানা প্রকার সামাজিক বাধানিষেধ সত্ত্বেও তিনি রাসমণিকে তার বিশাল জমিদারি এস্টেটের প্রশাসনিক কাজে অংশ নিতে উৎসাহ জোগাতেন। নারীরা এরকম প্রশাসনিক কাজে যুক্ত থাকবেন—সে সময় এমনটা কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু সেসব সামাজিক বাধা অগ্রাহ্য করেই স্ত্রীকে জমিদারি ও ব্যবসা পরিচালনার কলাকৌশল শেখাতে থাকেন রাজচন্দ্র।
রাসমণির শেখার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ব্যবসার কায়দাকানুন রপ্ত করে নেন। জমিদারি পরিচালনাতেও নিজের প্রশাসনিক দক্ষতার প্রমাণ রাখেন।
সত্যি বলতে কী, রাসমণির প্রখর ব্যবসাজ্ঞানের ওপর এক প্রকার নির্ভরশীলই ছিলেন তার স্বামী। আর্থিক ব্যাপারে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজচন্দ্র তার স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে নিতেন।
দুজনের মিলিত প্রচেষ্টায় তারা প্রভূত অর্থবিত্তের মালিক হন। এ দম্পতি তাদের সম্পদের বড় একটা অংশই ব্যয় করতেন জনকল্যাণে। সাধারণ মানুষের জন্য পানীয় জলের জলাশয় স্থাপন থেকে শুরু করে বৃদ্ধাশ্রম ও নিঃস্বদের জন্য বাড়ি তৈরি পর্যন্ত অনেক ধরনের জনহিতকর কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা।
চার মেয়ের মা-বাবা হন রাসমণি ও রাজচন্দ্র। ১৮৩০ সালে রাসমণির বয়স যখন চল্লিশের কোঠায়, তখন মারা যান রাজচন্দ্র। স্বামীর মৃত্যুর পর কঠিন সময় পার করতে হয় তাকে।
বিশাল এস্টেট রেখে গিয়েছিলেন বাবু রাজচন্দ্র দাস। স্বামী হারানোর শোক চাপা দিয়ে সেই এস্টেট পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয় রাসমণিকে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিশাল পারিবারিক ব্যবসা চালাতে থাকেন তিনি। তার সুদক্ষ পরিচালনায় সমস্ত ব্যবসা থেকেই মুনাফা আসতে থাকে।
রাজচন্দ্র দাসের প্রতিদ্বন্দ্বী ও পরিচিতরা তার মৃত্যুর খবর শুনে খুশি হয়ে উঠেছিল। এবার তার সব ব্যবসা সহজে সহজে দখল নিতে পারবে ভেবে খুশি হয়ে উঠেছিল তারা। ভেবেছিল, শান্ত-শিষ্ট, দয়ালু বিধবা রাসমণি তেমন একটা দেবেন না। কিন্তু তারা অচিরেই বুঝতে পারে, রাণী রাসমণি তার স্বামীর চেয়েও কঠিন ধাতুতে তৈরি। গভীর নিষ্ঠার সাথে এস্টেটের ব্যবসা ও প্রশাসনের নেতৃত্বে দেন তিনি।
কর্মে-গুণে রাসমণি স্বামীকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন বললেই চলে। কেননা রাজচন্দ্রের মৃত্যুর আগে কলকাতার মানুষের কাছে রাসমণির নাম পরিচিত ছিল না। কেননা রাজচন্দ্রের মতো ধনী কলকাতায় আরও অনেকেই ছিল তখন। তাই ধনী ব্যক্তিদের স্ত্রীকে নিয়েও কেউ তেমন ভাবত না। কিন্তু দারুণ দক্ষতায় ব্যবসা পরিচালনা করে সে ব্যবসার সম্প্রসারণের কারণে রাসমণি হয়ে ওঠেন বিখ্যাত। তিনি তো জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দ্বারকনাথ ঠাকুরকেও টাকা ধার দিয়েছিলেন।
দ্বারকানাথ ছিলেন রাজচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একবার বিদেশ যাওয়ার জন্য দ্বারকানাথ দু-লাখ টাকা ধার নেন রাজচন্দ্রের কাছ থেকে। রাজচন্দ্রের মৃত্যুর পর দ্বারকানাথ বিধবা রাসমণির কাছে গিয়ে তাদের জমিদারির ম্যানেজার হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু তার কাছে পাওনা দুই লাখ টাকা ফেরত চান রাসমণি। কিন্তু
দ্বারকানাথের কাছে তখন টাকা নেই। শেষে বুদ্ধিমতী রাসমণি তখন দ্বারকানাথকে বললেন ঠাকুরবাড়ির অনেক জায়গা-জমি আছে। কাজেই তাকে দু-লাখ টাকা সমমূল্যের জমি লিখে দিলেও চলবে। শেষ পর্যন্ত জমি লিখে দিয়ে টাকার ঋণ শোধ করেন দ্বারকানাথ।
এভাবেই নিপুণ দক্ষতায় বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে স্বামীর রেখে যাওয়া ব্যবসার প্রসার করেন রাণী রাসমণি। তবে শেষ বয়সে তিনি বৈষয়িক কাজ থেকে দূরে সরে যান। সে সময় জমিদারির সব দায়িত্ব তুলে দেন মেয়ের স্বামীর হাতে।
- সূত্র: গেটবেঙ্গল