পুরনো ল্যাপটপ, মোবাইল, কম্পিউটার: চানখাঁর পুল, ধোলাইরপাড় থেকে যেভাবে চীন, জাপানে
'তখন স্বর্ণের ভরি ছিল ৩০০০ টাকা, একটি মাদারবোর্ডের দাম পড়তো ১০-১৫ হাজার টাকা আর পুরো একটি কম্পিউটার ১ লক্ষ টাকার কমে হতো না।' ১৯৮৪ সালের কথা বলছিলেন আকবর আলী।
ডজ (ডিস্ক-বেইজড অপারেটিং সিস্টেম) কম্পিউটারের আমলে হার্ডওয়্যারের কাজ শিখেছিলেন আকবর। সাকলায়েন নামের একজন তার গুরু ছিলেন, যিনি অফিস-আদালতে যেয়ে কম্পিউটার সারাতেন। আকবরও যেতেন তার সহকারী হিসেবে। দেখতে দেখতে কাজটা তার আয়ত্তে চলে আসে। সেসময় এলিফ্যান্ট রোডে গোল্ডেন গেট নামে একটা বার ছিল যার নিচের একটা অফিসের কম্পিউটার আকবর নিজে প্রথম একা সারিয়েছেন।
মেকানিকরা ছিল ডাক্তারের মতো
এমন এক সময় ছিল সেটা যখন কম্পিউটার মেকানিকরা ডাক্তারদের মতো ভিজিট নিতেন। কোথায় কোনটা নষ্ট হয়েছে সেটা জানতে কাস্টমারকে ৫০০ টাকা গুনতে হতো। তারপর সারাতে চাইলে নির্দিষ্ট অংকের টাকায় চুক্তিতে আসতে হতো।
স্পেয়ার পার্টসের কয়েকটি দোকান ছিল এলিফ্যান্ট রোডে। তখন ঘরে ঘরে কম্পিউটার ছিল না, ছিল কেবল বিদেশি বড় বড় অফিস, ব্যাংক আর দেশি কিছু প্রতিষ্ঠানে। টুকটাক কিছু কাজ করা যেত কম্পিউটারে যেমন লগ শিট তৈরি করা, চিঠি লেখা ইত্যাদি। র্যাম হতো ২৬৪ কিলোবাইট, বেশি হলে ৫১২ কিলোবাইটের।
নব্বই দশকের শুরু থেকে কম্পিউটারের ব্যবহার কিছুটা বৃদ্ধি পায় তবে মাঝামাঝি থেকে ব্যাপকভাবে বাড়ে। ১৯৯৫ সালে আসা অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ ৯৫ এক বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলে। গুগল সার্চ ইঞ্জিনও চলে আসে ১৯৯৮ সালে। পরের বছর আসে ব্লটুথ প্রযুক্তি; ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব এসেছিল অবশ্য ৯১ সালেই। কাছাকাছি সময়ের মধ্যে ইন্টেলের পেন্টিয়াম প্রসেসর বাজারে আসায় আরেকটি বিপ্লব ঘটে, বিশেষ করে পেন্টিয়াম থ্রি আসার পরে।
পার্সোনাল কম্পিউটারে গান শোনা, ছবি দেখা, গেইম খেলাকে সহজ করে দেয় পেন্টিয়াম থ্রি। দাম তখনো এখনকার তুলনায় বেশিই ছিল। অবাক করা এক যন্ত্র ওই কম্পিউটার। এক যন্ত্রের ভিতরেই টেলিভিশন, ক্যালকুলেটর, কালি-কলম-খাতা, খেলার মাঠ আরো কত কী! লোকে তাই কম্পিউটার কিনবে বলে টাকা জমাতে থাকে। যা এতদিন জমাতো জমি রেজিস্ট্রি বা স্বর্ণের গহনা কেনার জন্য।
পাশাপাশি মোবাইল ফোনের ব্যবহারও বাড়তে থাকল, টাচ ফোন তখনো আসেনি, তবে আসতে বাকি ছিল না । গৃহস্থালিতে ইলেকট্রনিক পণ্য, যেমন মাইক্রোওয়েভ ওভেন, টোস্টার, ব্লেন্ডার ইত্যাদির ব্যবহারও বাড়ল। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকল ইলেকট্রনিক বর্জ্যের পরিমাণও। ২০০০ সালের আগে অবশ্য আমাদের এখানে এটা সেভাবে টের পাওয়া যায়নি।
ইলেকট্রনিক পণ্য বাড়লো, সাথে বাড়লো ই-বর্জ্য
ই-বর্জ্যের বিষয়টা আসলাম শেখ টের পেয়েছিলেন ২০০১ সালে। তিনি সেগুনবাগিচার কার্পেট গলিতে পুরনো আসবাবপত্রের ব্যবসা করতেন। আসলাম যখন দেখেছিলেন অকেজো মোবাইল, কম্পিউটার নিয়ে মানুষ কী করবে বুঝতে পারছে না- তখনই বুঝে ফেলেছিলেন, সামনে তার জন্য আছে নতুন দিন। ওসব মানুষ ঘরেও রাখতে চাইছিল না কারণ তাতে জায়গা নষ্ট হয়। তার ওপর নতুন নতুন মডেল আসায় পুরানো মডেল নিয়েও মানুষের আগ্রহ কমছিল। সেসময় এসব বর্জ্য বিক্রি হয়েছে ২০-৩০ টাকা কেজি দরেও ।
অথচ ই-বর্জ্য কথাটি ততদিনে বিশ্বের অনেক দেশেই চালু হয়ে গেছে আর সেগুলো নিয়ে শঙ্কাও বাড়ছিল। কারণ এগুলোর মধ্যে পারদ, সিসা, দস্তা, আর্সেনিক, অক্সাইডসহ বিভিন্ন ধাতব ও রাসায়নিক উপাদান থাকে যেগুলো বাতাস ও পানিতে মিশে গিয়ে পরিবেশকে দূষিত করে। এগুলো বাতাসে ছড়িয়ে যেমন ফুসফুসকে আক্রান্ত করে, মাটিতে মিশে গাছপালার বৃদ্ধি ব্যহত করে, আবার মাটির আরো গভীরে চলে গেলে পানিতে আর্সেনিক দূষণ ঘটায়।
তাই একটা সময়ে অনিবার্যভাবেই দেশে দেশে ই-বর্জ্য নিষ্কাশন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পুর্নব্যবহারের বিষয়টি সামনে চলে আসে। মোবাইল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান, টেলিফোন কোম্পানি, বিদেশি সংস্থা, ব্যাংক ইত্যাদি বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলেন আসলাম। তাদের কাছে বেশ পরিমাণে ই-বর্জ্য জমা হচ্ছিল এবং তারা বিক্রি করে দিতে আগ্রহী ছিলেন। ঠিকা দরে (কোনো নির্দিষ্ট নিরিখে নয়) সেগুলো কিনে নিতে চাইলেন তিনি। প্রতিষ্ঠানগুলো রাজি ছিল কিন্তু সমস্যা তৈরি হলো নিয়ম-কানুনের দিক থেকে। আসলামের ট্রেড লাইসেন্স তো বটেই, টিন সার্কিফিকেট, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ইত্যাদির প্রয়োজন দেখা দিল। ঘুরে ঘুরে এসব করাতে সময় লাগল অনেক।
আসলাম বলছিলেন, 'আমাদের এ ব্যবসায় ১৪টি লাইসেন্স লাগে। প্রতি বছর নবায়ন করতে ১০ লাখ টাকা চলে যায়। আগে ব্যবসা করে সুখ ছিল কারণ একটা কম্পিউটার ভাঙলে বেশ পরিমাণে ধাতব পদার্থ পাওয়া যেত। একটি মাদারবোর্ড দৈর্ঘ্যে হতো এক ফুটের মতো। দিন যত গেল সার্কিট, মাদারবোর্ড, চিপ, প্রসেসর বা র্যামের আকার ছোট হতে থাকল। ফলে এখন অনেক যন্ত্র ভেঙেও ধাতব পদার্থ যেমন লোহা, অ্যালুমিনিয়াম বা তামা মেলে অল্প।'
'মানে দিন যত গেল, বর্জ্য পরিমাণে বাড়ল, কিন্তু পদার্থ পাওয়া গেল কম। সুখের বিষয়, মানুষের মধ্যে সচেতনতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। যার কারণে যত্রতত্র বর্জ্য না ফেলে, হকারের জন্য অপেক্ষা করে। হকাররা ভ্যানে করে রাস্তায় ঘুরে সেগুলো সংগ্রহ করে। আমরা যদিও এসব মাল কিনি না তবে কোনো না কোনোভাবে এগুলো রিসাইক্লিংয়ের আওতায় আসে। আমরা লোকাল মাল বলি এগুলোকে। চানখাঁরপুল বা এলিফ্যান্ট রোডে এসব বেচাকেনা হয়।'
চানখাঁরপুলের আকবর আলী
শাকিল এন্টারপ্রাইজের অবস্থান চানখাঁর পুলে ঢোকার একটু পরেই। ২২-২৩ বছর বয়সী আব্দুল্লাহ বসে ছিলেন দোকানে। বেশ কয়েকটি মাদারবোর্ড স্ক্রু দিয়ে লাগানো দোকানের শেষ দেয়ালটিতে। শখ করেই আব্দুল্লাহ পুরনো আমলের কয়েকটি মাদারবোর্ড লাগিয়ে রেখেছেন।
আব্দুল্লাহ জানালেন, সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা অবধি দোকান খোলা রাখে। সারা দেশ থেকেই তাদের কাছে ই-বর্জ্য আসে, তার মধ্যে মোবাইল, কম্পিউটার যেমন আছে আবার গৃহস্থালি পণ্যও আছে। প্রতিদিন তিনি ২০-২২ হাজার টাকার মাল কেনেন।
কিছুক্ষণ পর তার দোকানে কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো, মাথায় ক্যাপ পরা হালকা-পাতলা গড়নের এক ব্যক্তি এলেন। ব্যাগ থেকে তিনটি মাদারবোর্ড বের করলেন, একটি মোবাইল ফোনের, অন্য দুটি কম্পিউটারের। একনজর দেখেই আব্দুল্লাহ বললেন, 'এটি বাদ। অন্য দুটি রানিং।' আব্দুল্লাহ তাকে ১৮০ টাকা দিলে লোকটি কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন। আমি জানতে চাইলাম, কোনটা অকেজো আর কোনটা সচল আছে বোঝেন কিভাবে? আব্দুল্লাহ বললেন, 'দেখতে দেখতে শিখছি। ছোটবেলা থেকেই দোকান করি। পড়াশোনা কিছু করি নাই।'
শাকিল এন্টারপ্রাইজের মতো চানখাঁর পুলে আছে ৭-৮টি দোকান যারা ই-বর্জ্য কেনাবেচার ব্যবসা করে। এদের মধ্যে কোনো কোনোটি স্পেশালাইজড মানে শুধু মাদারবোর্ড বা শুধু র্যামের ব্যবসা করে। তবে প্রায় সব রকম পুরনো ইলেকট্রনিক পণ্য কেনাবেচা করে শুভ এন্টারপ্রাইজ, আকবর আলী যার স্বত্বাধিকারী। কম্পিউটার হার্ডওয়্যারের কাজ তিনি ভালো জানেন, আশি ও নব্বইয়ের দশকে তার মতো মেকানিক পাওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু সময় যত যাচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি হাজির হচ্ছে, শুধু প্রসেসরের সময়রেখা দেখলেই তার খানিক আন্দাজ করা সম্ভব। ইন্টেলের পেন্টিয়াম আমল শুরু হয় ১৯৯৩ সালে, ৯৫ সালে আসে পেন্টিয়াম প্রো, দুই বছর পরে পেন্টিয়াম টু, পরের বছর সেলেরন, ১৯৯৯ সালে পেন্টিয়াম থ্রি, ২০০০ সালে পেন্টিয়াম ফোর। এখনো ফি বছর নতুন জেনারেশনের প্রসেসর আনছে ইন্টেল।
আকবর আলী বললেন, 'আমি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি। দেখে দেখে হার্ডওয়্যারের কাজ শিখেছি। কোনটা কোথায় থাকে, কোনটার গুনাগুন কতটা তা বুঝতে পারি কিন্তু এখন পুরানোটা সারানোর চেয়ে নতুন মডেল কিনে ফেলা বুদ্ধির কাজ। তাতে খরচ কিছু বেশি পড়লেও সর্বাধুনিক জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। তাই বেকার হয়ে গেলাম। এখন ই-বর্জের ব্যবসা করেই সংসার চালাই।'
আকবর আলী আরো বলেছিলেন, 'আমরা এখানে পাওয়ার সাপ্লাই ইউনিট, প্রসেসর বা মাদারবোর্ড আলাদা করি। স্ক্রু ড্রাইভার হলেই আমাদের চলে চলে যায়। ধাতু আলাদা করার মতো পর্যাপ্ত জায়গাও নেই আর কৌশলও শিখিনি। বড় বড় প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছ থেকে মালামাল সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। চিটাগাং রোডে, শনির আখড়ায় বা রায়েরবাগে আছে তেমন সব প্রতিষ্ঠান যারা বিদেশে ই-বর্জ্য রপ্তানি করে।'
ধোলাইরপাড় থেকে জাপান
ধোলাইরপাড়েও আছে একটি বড় প্রতিষ্ঠান যারা ই-বর্জ্য রপ্তানি করে জাপানে। জামান এন্টারপ্রাইজ নামের প্রতিষ্ঠানটি ই-বর্জ্য নিয়ে কাজ করছে ২০০১ সাল থেকে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত অথবা ই-বর্জ্য জমিয়ে রাখলে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে জবাবদিহি করতে হয় তেমন প্রতিষ্ঠান থেকে তারা সংগ্রহ কার্যক্রম চালান যেমন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, স্মার্ট টেকনোলজিস, স্যামসাং ইত্যাদি। প্রতিষ্ঠানগুলোকে বর্জ্য হস্তান্তরের সার্টিফিকেটও দেয় জামান এন্টারপ্রাইজ। সংগৃহীত পণ্যগুলো ভাঙা বা খোলার পরবিভিন্ন অংশ আলাদা করা হয়। এজন্য তাদের মজুরি ভিত্তিক এবং বেতন ভিত্তিক শ্রমিক আছে।
ধোলাইরপাড়ে বহুকাল ধরে লোহা থেকে শুরু করে বিভিন্নরকম বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ চলে আসছে। তাই এখানে অভিজ্ঞ শ্রমিক পাওয়া সহজ। ই-বর্জ নিষ্কাশন তুলনামূলক নতুন কাজ, অন্য ভাঙারি রিসাইকেল করার মতো কঠিনও নয়। এতে ঢালাই, পেটাইয়ের কাজ বড় আকারে হয় না। গলানোর কাজও হয় কালেভদ্রে। অথচ যথেষ্ট পরিমাণে উপার্জনের সুযোগ আছে, ব্যবসায়ীদের যেমন সরকারেরও।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এক জরিপ তথ্য দিচ্ছে, ২০১৮ সালে দেশে ই-বর্জ্য তৈরি হয়েছিল ৪ লক্ষ মেট্রিক টন, পাঁচ বছর পর ২০২৩ সালে যার পরিমাণ ১২ লক্ষ টন এবং ২০৩৫ সাল নাগাদ সংখ্যাটি কোটিতে উঠে যেতে পারে।
সেকারণেই জামান এন্টারপ্রাইজের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আল-ফয়সাল বলছিলেন, 'এ খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। সরকারেরও প্রচুর রাজস্ব পাওয়ার সুযোগ আছে। আমাদের সংকট তৈরি হয় যখন রপ্তানির জন্য কমপক্ষে এক কন্টেইনার পূর্ণ করার প্রয়োজনীয় পণ্য পাওয়া যায় না। এজন্য দুই-তিন মাসও অপেক্ষা করা লাগে। ফলে গোডাউনের ভাড়া গুণতে হয় বেশি। মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ার পরও কিন্তু মাত্র ৩-৫ শতাংশ বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য সংগ্রহ করা যায়। বাকি ৯৫ ভাগেরই গন্তব্য হয় ভাগাড়।'
চানখাঁরপুলের কথা জানতে পেরেছিলাম খোকনের কাছ থেকে। তিনি একজন হকার। কাঁধে ব্যাগ আর হাতে মাইক নিয়ে তিনি তাঁতী বাজার, শাখারিবাজার, লক্ষ্মীবাজার, নওয়াবপুর, শান্তিনগর বা ইস্কাটন গার্ডেন ঘুরে বেড়ান। বাড়ি তার হবিগঞ্জ। ই-বর্জ্য সংগ্রহের কাজে লেগেছেন করোনার পরে। তার আগে চায়ের দোকান করতেন। কিন্তু করোনার সময় সঞ্চয় ভেঙে খেতে হয়েছে, দোকানও রক্ষা করা যায়নি। তাই একরকম বাধ্য হয়েই হকারি করছেন।