গোলপাতার ছাউনিতে নির্মাণের নতুন মাত্রা
ঐতিহাসিক কাল থেকে সুন্দরবনের নিকটবর্তী খুলনা অঞ্চলে গোলপাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি নির্মাণ করা হত। সময়ের সাথে সাথে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই নির্মাণ পদ্ধতি। তবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) নতুন ক্যাফেটেরিয়ার ছাউনি গোলপাতা দিয়ে নির্মাণ করার পর এটি ব্যাপক আলোচনায় এসেছে।
গত ৯ জুলাই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত ক্যাফেটেরিয়ার নামফলক উন্মোচন করেন উপাচার্য ড. মাহমুদ হোসেন।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড ডিসিপ্লিনের একজন অধ্যাপক। সুন্দরবন নিয়ে করেছেন শতাধিক গবেষণা। ওই বনে প্রাকৃতিকভাবে জম্মানো গোলপাতা দিয়ে নতুন ক্যাফেটরিয়ার ছাউনি নির্মাণের ধারণা তিনিই দিয়েছিলেন।
ড. মাহমুদ হোসেন বলেন, "গোলপাতা দিয়ে নির্মিত এই ক্যাফেটেরিয়াটি শহুরে ইট-পাথরের অবকাঠামোর মধ্যে গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছোঁয়া এনেছে। এছাড়া ক্যাফেটেরিয়াটির বিশেষ নকশাও সকলের কাছে মনোমুগ্ধকর হয়েছে।"
"আমরা সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগুলো নান্দনিকভাবে নির্মাণ করার চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে আরও স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রমী নকশার অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে", যোগ করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ক্যাফেটেরিয়াটির নকশা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. শেখ সিরাজুল হাকিম এবং সহকারী অধ্যাপক আজহারুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
তাদের দাবি, দেশে যতগুলো গোলপাতা দিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে, তার মধ্যে খুবির ক্যাফেটেরিয়াটি সবচেয়ে বড়। এর আয়তন প্রায় ৫ হাজার ৪০০ বর্গফুট। গ্রীষ্মের মাসগুলোতে যখন প্রচণ্ড গরম পড়ে তখন অন্যান্য কংক্রিটের অবকাঠামোর তুলনায় এই ক্যাফেটরিয়ার তাপমাত্র ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকবে।
এছাড়া, ক্যাফেটেরিয়াটি পর্যাপ্ত আলো এবং বায়ু চলাচলের জন্য জন্য চারদিকে কোনো বেড়া ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছে। এর সামনের এবং পিছনের অংশ ত্রিভুজাকার হওয়ার জন্য সৌন্দয্য আরও বেড়েছে।
ক্যাফেটরিয়ার ঘুরে দেখা গেছে, আশেপাশেও গ্রামীণ পরিবেশের আবহ রয়েছে। পিছনে ঘন ঝোপ, একপাশে বাঁশঝাড়। এছাড়া বিপরীত দিকে একটি পুকুর রয়েছে যেখানে পদ্ম ফুল ফোটানোর জন্য পরিচর্যা করা হচ্ছে।
অধ্যাপক ড. শেখ সিরাজুল হাকিম বলেন, "ক্যাফেটেরিয়াটি এখন যেখানে নির্মাণ করা হয়েছে, ওই জায়গাটি আগে পরিত্যাক্ত অবস্থায় ছিল। স্থানটিকে কীভাবে সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়, তার ভিত্তিতে আমরা ক্যাফেটরিয়ার নকশাটি তৈরি করেছিলাম। তখন আশেপাশের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য গ্রামীণ আবহে এর নকশা করা হয়।"
শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উদ্বোধনের পর থেকে নতুন ক্যাফেটরিয়াটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়।
শিক্ষার্থী শরিফুল ইসলাম বলেন, 'একেবারেই ব্যতিক্রমভাবে আমাদের ক্যাফেটরিয়াটি নির্মাণ করা হয়েছে। বিশেষ করে এর গোলপাতার ছাউনি সবাইকে বেশি আকর্ষণ করেছে। শিক্ষার্থীরা প্রায়ই সেলফি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করছেন।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বহিরাগতদেরও এই নতুন ক্যাফেটরিয়া নিয়ে আলোচনার শেষ নেই।
কদরুল হুদা ডাল্টন নামের একজন এই ক্যাফেটরিয়ার চারটি ছবি ফেসবুকে পোষ্ট করে লিখেছে, 'এক সময় গোলপাতা দিয়ে গ্রামে-গঞ্জে কুটির তৈরি হতো। এখন চোখে পড়ে না। সেই সব কুটির নিম্নবিত্তের প্রতীক হলেও আলো-বাতাস খেলা করতো। গোলপাতা দিয়ে যে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা তৈরি করা যায়, তার চমৎকার নিদর্শন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়া। সত্যিই অসাধারণ! গোলপাতা দিয়ে তৈরি ক্যাফে– শহরে গ্রামীণ পরশ।'
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গোলপাতা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উপকূলে বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশের সুন্দরবনে প্রাকৃতিকভাবেই গোলপাতা উৎপাদন হয়। বন থেকে যারা গোলপাতা সংগ্রহ করেন তাদের বাওয়ালি সম্প্রদায় বলে চিহ্নিত করা হয়। চলতি বছরে সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জে ৯০ হাজার কুইন্টাল গোলপাতা সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। বছরের একটি নিদৃষ্ট সময়ে একবার গোলপাতা আহরণের অনুমতি দেওয়া হয়।
সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনার দাকোপ কালাবগি গ্রামে ঘুরে এখনো কয়েকটি বাড়িতে গোলপাতার ছাউনি দেখা যায়। এছাড়া, খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার চিংড়ি চাষ করা ঘেরগুলোতে (বড় আকারের জলাশয়) যে বাসা নির্মাণ করা হয়, তার প্রায় প্রত্যকটিতে গোলপাতার ছাউনি দেখা যায়।
বাওয়ালি নির্মল সানা বলেন, "আমাদের পারিবারিকভাবে বংশপরম্পরায় সুন্দরবন থেকে গোলপাতা সংগ্রহের ব্যবসা চলে আসছে। আগে প্রচুর চাহিদা থাকলেও বর্তমানে কেবল ঘেরের বাসা ও কোথাও কোথাও বাড়ির রান্না ঘর নির্মাণের জন্য গোলপাতার ব্যবহার করা হয়।"
তিনি জানান, একবার গোলপাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি নির্মাণ করলে ২ থেকে ৩ বছর তা স্থায়ী হয়। পরে আবারও নতুন পাতা দিয়ে ছাউনি দিতে হয়। গোলপাতা সূর্যের তাপ ভেদ করতে পারে না; তাই এই পাতা দিয়ে নির্মিত ছাউনির ঘর গ্রীষ্মকালেও তুলনামূলক শীতল থাকে।