ঢাকা মহিলা পলিটেকনিকের ইলা ঘোষ, এক বিস্মৃত প্রকৌশলী!
১৯৮৮ সাল। প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকা ওমেন পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট থেকে কয়েকজন শিক্ষককে পাঠানো হলো ভারতের চণ্ডীগড় এবং মাদ্রাজ টেকনিক্যাল টিচারস ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে। একেক দল একেক ইন্সটিটিউটে যাবার জন্য প্রস্তুত। এমন একটি দলে ছিলেন মোঃ শাহাবুদ্দীন। তার দলটির গন্তব্য ছিল মাদ্রাজে। কিন্তু প্লেন আসতে দেরি হওয়ায় কলকাতার এক হোটেলে উঠতে হলো। একে তো ছয়জন যুবক, তার ওপর গিয়েছেন দেশের বাইরে। সারাদিন নিশ্চয়ই হোটেলে বসে ঘুমোবেন না! ঠিক তা-ই হলো। হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লেন তারা। ঠিক করলেন, ইলা ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। ম্যাডাম চলে যাবার পর তো আর দেখা হয়নি। তাই এত কাছাকছি যেহেতু এসেছেন, তার সঙ্গে একবার দেখা না করলে কী করে হয়?
ছয়জন গিয়ে পৌঁছালেন কলকাতা ওমেন পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে। ইলা ঘোষ (বিয়ের আগে পদবী ছিল মজুমদার) তখন সেখানকার অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বরত। ছয়জনকে দেখেই সর্বদা কপালে টিপ পরিহিতা এই নারীটির চোখেমুখে ফুটে উঠলো আনন্দের ঝলক। টানা দু'বছর তো এদের সঙ্গেই কাজ করেছেন। আজ হুট করেই তাদেরকে নিজ কলেজ প্রাঙ্গণে দেখে আনন্দ আর ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। ছয়জনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন কলকাতা শহরে ঘুরতে। সারাদিন ঘোরাঘুরির পর ম্যাডামের থেকে বিদায় নিয়ে যুবক দলটি ফিরলো হোটেলে।
এই ইলা ঘোষ হলেন প্রথম বাঙ্গালী নারী ইঞ্জিনিয়ার। এমনই সদা হাস্যোজ্জবল আর প্রাণবন্ত ছিলেন তিনি। ঢাকার আগারগাঁওয়ে বর্তমানে যে ওমেন পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট রয়েছে, তার প্রতিষ্ঠাতাও এই ইলা ঘোষ।
বাংলাদেশের সঙ্গে তার সখ্যতা কিন্তু জন্মসূত্রেও
১৯৩০ সালের ২৪ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমায় (বর্তমানে জেলা) জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা যতীন্দ্র কুমার মজুমদার ছিলেন অবিভক্ত বাংলার বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা ছিলেন গৃহিণী। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।
সরকারি কর্মচারী হওয়ায় বাবার বদলির কারণে বিদ্যালয়ের পাঠও হয় বিভিন্ন জেলায়। তবে এজন্য শুধু বাবার বদলি নয়, রাজনৈতিক কারণও দায়ী। খুলনার এক স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছিলেন। এরপর ১৯৪৫ সালে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক বিভিন্ন জটিলতা শুরু হলে পরিবারসমেত কলকাতায় চলে যান তারা। এরপর পড়াশোনা হয় কিছুটা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবেই। ১৯৪৬ সালে প্রাইভেট থেকে ম্যাট্রিক দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হোন। পরে কলকাতার আশুতোষ কলেজে ভর্তি হয়ে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট (আইএসসি) পাশ করেন।
এরপর তার ভাগ্যও যেন সুযোগ পায়। সময়টা তখন স্বাধীনতার পরপর। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন বাংলার শিক্ষামন্ত্রী, নিকুঞ্জ বিহারী মাইতির উদ্যোগে নারীদের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং-সহ শিক্ষার সব ক্ষেত্রেই নারীদের পড়ার দরজা খুলে দেয়া হয়। ইলা ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারির দুটোর প্রবেশিকা পরীক্ষাতে অংশ নিয়ে দুটো পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হন।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াও ছিল তার কাছে তেমনই একটি চ্যালেঞ্জের মতো
কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তার কারিগরি বিদ্যায় আকর্ষণ ছিল। তাই ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারির মধ্যে বেছে নিলেন ইঞ্জিনিয়ারিংকেই। আরেকটি বিষয় তাকে প্রবলভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তা হলো, জেদ। ছেলেরাই পারবে, মেয়েরা পারবেনা এই ধারণাকে ভেঙ্গে দেওয়ার অদম্য জেদ। তাই ইঞ্জিনিয়ারিং বেছে নেওয়ায় এই জেদও ছিল একটি বড় কারণ।
"মেয়েটার ও যতীনবাবুর মাথা খারাপ হয়ে গেছে"
ছোট থেকেই ইলা স্বভাবে জেদি এবং সাহসী ছিলেন। যে কারণে ১২ বছর বয়সে সাইকেল চালানো এবং ১৬ বছর বয়সে জিপগাড়ি চালিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সেসময়ে।
তার এই অদম্য সাহস, বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাওয়ার মতো দুঃসাহস নিয়ে সবাই কটু কথা বললেও, ইলার বাবা যতীন্দ্র মজুমদার সবসময় মেয়েকে সমর্থন যোগাতেন। আর যেহেতু বাবার কথাই শেষ কথা, তাই পরিবার থেকে সেভাবে বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি তাকে কখনো।
২০০৯ সালের Gaabesuকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'I wanted to opt for engineering and my father agreed. Relations and friends thought it was very unwise. General opinion was, "মেয়েটার ও যতীনবাবুর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।"
এরপর বাবার মত নিয়ে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হতে এলেন। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো বিভাগ নির্বাচন নিয়ে। তিনি চেয়েছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। কিন্তু অধ্যক্ষ তাকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে দেননি। কেননা এই বিভাগে মাঠপর্যায়ের কাজ অনেক বেশি ছিল। যা ঐসময়ে একজন নারীর পক্ষে বেশ কঠিন। অগত্যা মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হলেন তিনি।
শুরুতে তার সহপাঠিনী হিসেবে ছিলেন অজন্তা গুহ। তারা দুজনই কেবল ছিলেন নারী শিক্ষার্থী, বাকি সব ছেলে। এরমধ্যে অজন্তা গুহ সবসময় ট্রাউজার এবং টি শার্ট পরে ক্লাসে যেতেন। অপরদিকে ইলা সবসময় শাড়ি পরেই যেতেন ক্লাসে। এতগুলো উৎসুক চোখের মাঝে একজন বাঙ্গালি নারীর শাড়ি পরে ক্লাস করা তখনকার সময়ে এক অসাধ্য সাধনের মতো বিষয়ই ছিল। আর সে অসাধ্য সাধনের সাহস ইলা একাই দেখিয়েছিলেন!
তবে ক্লাসের বাইরে তাদের জীবন ছিল একাকীত্বের
স্বাধীনতার পর মেয়েদের জন্য শিক্ষাক্ষেত্র খুলে দিলেও সে অনুযায়ী ছাত্রীবান্ধব পরিবেশ তখনো গড়ে ওঠেনি। যেকারণে মেয়েদের জন্য কোনো আবাসিক হোস্টেলের ব্যবস্থাও ছিল না। অজন্তা এবং ইলা দু'জন ছাত্রী থাকতেন অধ্যক্ষের বাংলোর নিচতলায় ছোট্ট একটি রুমে। সাথে ছিল লাগোয়া বাথরুমও। খাওয়াদাওয়া আসতো ছেলেদের হোস্টেল থেকে। তবে, এই দুজন ছাত্রীর দেখাশোনার জন্য একজন পরিচারিকা নিযুক্ত করে দিয়েছিলেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। তিনিই তাদের খাবার দাবার এনে দিতেন ও দেখভাল করতেন। তবু ক্লাসের বাইরে তাদের জীবন ছিল খুব একাকীত্বের।
একসময় অজন্তা গুহও বাদ পড়ে যান। কেবল একা নারী শিক্ষার্থী রয়ে গেলেন ইলা মজুমদার (বিয়ের পরে ঘোষ)।
২০০৮ সালে কলকাতার ইংরেজি দৈনিক টেলিগ্রাফের এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'পুরো ব্যাচের মধ্যে একটি মাত্র মেয়ে ছিল। প্রথমদিকে ছেলেরা হতবাক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু শীঘ্রই আমরা ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, খোশগল্প করতাম, ঠাট্টা করতাম। ক্রিকেট খেলার সময় বন্ধুদের উৎসাহ দিতাম, ছেলে সহপাঠীদের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে মিশতাম, একজন মেয়ে হয়ে কখনই অস্বস্তি বোধ করিনি।'
তবে এ-ও ঠিক। তার বিকল্প পরিকল্পনাও ছিল। যদি অজন্তার মতো তিনিও এই বৈরী পরিবেশে ইঞ্জিনিয়ারিং এর সাথে খাপ খাওয়াতে না পারতেন তবে ঠিকই মেডিকেলে চলে যেতেন বলে জানিয়েছিলেন সে সাক্ষাৎকারে।
বিদেশে যাওয়া প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং নারী শিক্ষানবিশও তিনি!
অধ্যক্ষের বাংলোয় থেকে এবং লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করে এরকম নারী বর্জিত এক ক্ষেত্রে সাহসের সঙ্গে স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। সেই সাথে সমাজের বিদ্যমান প্রথা ভেঙ্গে ভারতের প্রথম নারী মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রথম বাঙ্গালি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ইতিহাসে নিজের নামও লেখান তিনি।
যেহেতু সেবারই প্রথম নারীদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হয়, তাই নারীবান্ধব পরিবেশও তেমন ছিল না। একারণে মেকানিক্যালে পড়ালেখা করলেও ভারতে থাকতে হাতেকলমে কাজ করার সুযোগ পাননি তিনি। কারণ কলেজের অধ্যক্ষের ধারণা ছিল, ছেলেদের সঙ্গে সারাদিন ওয়ার্কশপে কাজ করা ইলার জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে। তাই শিক্ষানবিশীর ও স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনার জন্য স্নাতক শেষে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো যান এবং সেখানকার 'বার অ্যান্ড স্টাইড'- সংস্থা থেকে স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষা নেন। তার এই বিদেশে পড়াশোনার খরচ চালানো কিন্তু তার বাবার পক্ষে কিছুটা কঠিনই ছিল। কিন্তু মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার বাবা কখনো বাধা আসতে দেননি। তা-ই কষ্ট হলেও, নিজ মেয়েকে বাইরে লেখাপড়া করতে পাঠান তিনি। এভাবেই বিদেশে যাওয়া প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং নারী শিক্ষানবিশ হিসেবেও নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখেন তিনি।
এই প্রশিক্ষণ শেষে ভারতে ফিরে তিনি দেরাদুনের 'অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি'-এর ভারী যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানাতে প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে ছয় মাস চাকরি করার পর ১৯৫৫ সালে দিল্লি পলিটেকনিক কলেজে প্রভাষক পদে যুক্ত হন। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সে সময়ে এটি ছিল একমাত্র সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। সেখানে কর্মরত অবস্থাতেই অতি অল্প সময়ে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর দুটি বই- 'অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স থ্রু ওয়ার্কড একজাম্পেল্স' এবং 'হাইড্রলিক্স থ্রু ওয়ার্কড একজাম্পেল্স' প্রকাশ করেন।
এরপর ১৯৫৯ সালে ইলা বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। বিয়ের পর তিনি স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে আসেন এবং ইন্সটিটিউট অব জুট টেকনোলজি-তে লেকচারার পদে যোগ দেন।
সেখানে কর্মরত অবস্থায় তিনি ১৯৬৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর, কলকাতার গড়িয়াহাট রোডে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনিই প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। প্রথমদিকে মেয়েদের উপযুক্ত আর্কিটেকচার এবং ইলেকট্রনিক্স নিয়েই পঠন-পাঠন শুরু হয়। তার বিস্তৃত এই কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়ে ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে তাদের প্রকল্পে বাংলাদেশের ঢাকাতেও একটি মহিলা পলিটেকনিক কলেজ খোলার দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়। প্রথম দিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে অধ্যক্ষ পদ থেকে অব্যাহতি দিতে রাজি না হলেও পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশে আসেন এবং তারই তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা পলিটেকনিক কলেজ ঢাকায় স্থাপিত হয়। নারী উন্নয়নে এবং তাদের স্বাবলম্বী করে তুলতে যা আজও কাজ করে যাচ্ছে।
আজ কেউ তাকে চেনেনা
আর্কিটেকচার এবং ইলেক্ট্রিক্যাল এ দুটি বিভাগ, ১২ জন শিক্ষক এবং প্রায় ৭০ জন ছাত্রী নিয়ে ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের যাত্রা শুরু করেন তিনি। কোথায় কোন ভবন হবে, বইয়ের লিস্ট, বই কেনা, ফার্নিচার কেনা- এসব প্রশাসনিক কাজই ছিল তার দায়িত্বে। সেই সাথে ছাত্রীদের উপদেষ্টা হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য এটা ছিল তখন সর্বোচ্চ কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তারপরও এর প্রতিষ্ঠাতা ইলা ঘোষকে মনে রাখেনি এই কলেজ। কলেজের কোথাও তার নামটি পর্যন্ত খোদাই করা নেই। নেই তার নামে কোনো ফলক, কক্ষ, লাইব্রেরী, ল্যাব বা কিছু। ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেও তাদের এ ব্যাপারে অজ্ঞতাই প্রকাশ পায়। এমনকি শিক্ষকরাও তাই। এ ব্যাপারে ইলেক্ট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক সিতারা বেগম জানান, 'আমি যখন '৯১ সালে আসি এখানে, তখন এক দু'টা ম্যাগাজিনে ইলা ঘোষের নাম দেখেছিলাম। কিন্তু এরপর তাকে নিয়ে আর কোনো সভা বা স্মরণিকা বা কিছুই হতে দেখিনি। ছাত্রীরা তো জানেইনা, শিক্ষকরাও সবাই এখন নতুন হওয়ায় কেউ তার নাম জানেনা।'
পুরোনো শিক্ষকদের মধ্যে দুজনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। সিতারা বেগম মূলত এই দুজন শিক্ষকের নামই জানান, যারা কিছুটা হলেও ইলা ঘোষ সম্পর্কে অবগত আছেন। এদের মধ্যে একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। নাম তার মোঃ শাহাবুদ্দীন। আর্কিটেকচার বিভাগের শিক্ষক। তিনি জানান, '৮৫ থেকে '৮৭ এই দু বছর ইলা ম্যাডাম আমাদের সাথে কাজ করেছেন। তখনকার সময়ে এটিই ছিল মেয়েদের জন্য সর্বোচ্চ কারিগরি বিদ্যাপীঠ। তাই এখানকার মেয়েদের জন্য কাজ করতে পেরে তিনি খুব সন্তুষ্ট থাকতেন।'
একটু থেমে আবার বলা শুরু করেন শাহাবুদ্দীন। 'আমাকে খুব পছন্দ করতে ইলা ম্যাডাম। পঁচাশি সালে যখন বয়স কম বলে ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে আমাকে প্রায় বাদই দিয়ে দিচ্ছিল, ইলা ম্যাডামই তখন একা আমার ব্যাপারে সুপারিশ করে আমাকে এই চাকরিটা দেন।'
'টুকটাক বিভিন্ন কাজে ম্যাডাম আমাকে ডাকতেন। আমিও তার কাজ করে দিতাম। এখানে থেকে চলে যাবার সময় তার ডাইনিং টেবিলটা তিনি আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন', স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নিজেই হেসে ফেলেন শাহাবুদ্দীন।
এমন একজন মহীয়সী নারীর হাতে যে বিদ্যাপীঠের জন্ম, সে বিদ্যাপীঠই আজ তাকে ভোলার পথে। এই গুটিকয়েক পুরোনো শিক্ষক ছাড়া তাকে আজ কেউ চেনেও না। শিক্ষকরাও নয়, ছাত্রীরাও নয়। কিন্তু ১৯৮৫-৮৭ সাল পর্যন্ত এই দু' বছর ছাত্রীদের যেকোনো সমস্যার সমাধানে ছিলেন ইলা ঘোষ।
পুরোনো দিনগুলো নিয়ে শাহাবুদ্দীন বলেন, 'কখনো জোরে কথা বলতে দেখিনি। যেমন শান্ত, তেমনি সাহসী আর প্রাঞ্জল। প্রায়ই দেখতাম ছোটো ছোটো দলে ভাগ করে ছাত্রীদের বিভিন্ন জিনিস বোঝাতেন, কাউন্সেলিং করাতে দেখতাম। অসাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি। এই কলেজ আজ তাকে ভুলে গেলেও আমি ভুলবো না তার অবদান কোনোদিন।'
ভারতেই বিশেষত কলকাতাতেই জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন বলে ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায়নি তার। তার ছিল দুই পুত্র। একটি কন্যার জন্মও হয়েছিল। কিন্তু কন্যাটি ১৯৬৩ সালে মারা যায়। এই মৃত্যুর জন্য তিনি নিজের কাজ এবং নিজেকেই দায়ী করে গেছেন সবসময়। কেননা তার জীবন তো তখনকার আর দশটি মেয়েদের মতো কাটেনি! তিনি লেখাপড়া করেছেন সম্পূর্ণ নারীবিহীন দুর্গম একলা পথে। কাজের পরিবেশও তেমনই ছিল। ফলে, বাঙ্গালি আর দশটি সাধারণ মেয়ের মতো সংসার করা তার ধাতে ছিল না। শাড়ি আর কপালে গোল টিপের মতোই সর্বদা তার মুখে লেগে থাকতো হাসির ছোঁয়া। বয়স ৯০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যবরণ করেন তিনি।
তবে বাংলাদেশে তার মৃত্যু হয়েছিল তিনি বেঁচে থাকতেই। আমাদের মাদারীপুরের এ কন্যাই প্রথম বাঙ্গালি নারী প্রকৌশলী। তার হাত ধরেই ঢাকায় প্রতিষ্ঠা পায় মেয়েদের জন্য প্রথম কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তারপরও তিনি আমাদের কাছে অজানা একজন। এদেশের মেয়েদের নিজ হাতে আলোর পথ দেখিয়ে দিয়েও, এদেশের কাছে নিজে রয়ে গেলেন আলোর অগোচরে…