সৌরভ মাতানো পুরান ঢাকার সুগন্ধী ব্যবসার অন্দরে
পুরান ঢাকার ইমামগঞ্জের মিটফোর্ড রোড দিয়ে হেঁটে যেতেই আমাদের নাকে বিভিন্ন সুগন্ধ ধাক্কা দিলো। গন্ধগুলো আসছে রাস্তার পাশে থাকা সুগন্ধী বিক্রি করা দোকানগুলো থেকে।
দোকানগুলোর শোকেস আর শেলফগুলো ভর্তি সিলভার অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি বোতল দিয়ে। এই এক লিটারের বোতলগুলো খুব কম সময়ই খোলেন দোকানের কর্মীরা। যখন কেউ সুগন্ধী কিনতে আসেন, তখন কাঁচের ছোট কৌটার ছিপি খুলে হলুদাভ, কমলা বা রংহীন তরলের ঘ্রাণ শুঁকতে দেওয়া হয় তাদেরকে।
কয়েকজন দোকান মালিক জানান, তারা কেবল আতর বিক্রি করেন। আর আতর বিক্রির সবচেয়ে ভালো সময় রমজান মাস।
কেপিএম পারফিউমারির মালিক কেপি আরিফ আলী জানান, "শব-এ-মেরাজ থেকে শুরু করে ঈদুল ফিতর পর্যন্ত আর ঈদুল আযহার এক সপ্তাহ আগে থেকে ঈদ পর্যন্ত প্রচুর বিক্রি হয়। রমজান মাসে মাঝেমধ্যে আমরা দিনে এক লাখ টাকার আতরও বিক্রি করি।"
আরিফ হলেন মিটফোর্ড এলাকায় সুগন্ধী ব্যবসার অন্যতম অগ্রদূত দক্ষিণ ভারতীয় ব্যবসায়ী কাদের পীর মোহাম্মাদের নাতি।
বেশিরভাগ দোকানকর্মীরা ব্যস্ত তাদের অতিথিদের নিয়ে, যারা মূলত সুগন্ধী আমদানিকারক আর খুচরা বিক্রেতা। তাদের মধ্যকার কথোপকথন থেকে সিকে ওয়ান, গুচি, ফেরারি, ক্রিশ্চিয়ান ডিওর, মোহিনী, দরবার, সুলতান, কস্তুরী, জেসমিন আর কাঁচা বকুলের মতো শব্দ শোনা যায়। মাঝেমধ্যে ভ্যানিলা, অরেঞ্জ, লেমন, চকোলেটের মতো শব্দও শোনা যাবে।
সিকে ওয়ান আর ক্রিশ্চিয়ান ডিওর শব্দ শুনে পারফিউম ব্র্যান্ডের কথা মাথায় আসলেও তারা মূলত এগুলো দিয়ে সুগন্ধীর উপাদানের নাম বোঝাচ্ছেন।
পারফিউমের জন্য মিটফোর্ড রোড বিখ্যাত হলেও টয়লেট্রিজ ব্র্যান্ডের সুগন্ধী এবং খাদ্য-পানীয়ের ফ্লেভারের জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে সবচেয়ে বড় বাজারও এটি। টয়লেট্রিজ কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যে যে সুগন্ধী ব্যবহার করে কিংবা খাদ্য-পানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের খাবারে যে ফ্লেভার ব্যবহার করে তার সবকিছুর ব্যবসা মিটফোর্ড রোডকে কেন্দ্র করেই হয়।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, প্রতি মাসে ৫ কোটি টাকা সমমূল্যের সুগন্ধী কেমিক্যাল বেচাকেনা হয় মিটফোর্ড রোডের দোকানগুলোতে। বর্তমানে অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যসংখ্যা ১,৪৫০ জন।
মিটফোর্ড রোডকে কেন্দ্র করে সুগন্ধী কেমিক্যালের ব্যবসার গোড়াপত্তন হয় ষাটের দশকে। সে সময়ে আরমানি স্ট্রিট থেকে শুরু করে ইমামগঞ্জ পর্যন্ত পুরো এলাকাটিই ছিল পাইকারি বিক্রির কেন্দ্র, আর পণ্য পরিবহনের পুরোটাই হতো জলপথে।
ব্যবসায়ীরা পণ্য অথবা টাকা নিয়ে বুড়িগঙ্গার তীরে হাজির হতেন। বেশ কয়েকজন পণ্য উৎপাদনকারী চক মৌলভীবাজার থেকে কসমেটিক এবং টয়লেট্রিজ উৎপাদনের প্রধান উপাদান স্টিয়ারিক এসিড কিনতেন। এগুলো কেনার পাশাপাশি এলাকায় সুগন্ধীর দোকানও খুঁজতেন তারা।
সুগন্ধীর ব্যবসার সম্ভাবনা বুঝতে পেরে কাদের পীর মোহাম্মাদ এবং সৈয়দ আহমেদের মতো বেশ কয়েকজন দক্ষিণ ভারতীয় ব্যবসায়ী মিটফোর্ড রোডে সুগন্ধী কেমিক্যালের দোকান খুলে বসেন।
সৈয়দ আহমেদ ব্যবসার চেয়ে গজল গান গাওয়ায় বেশি আগ্রহী ছিলেন। তাই তিনি তার ছোট ভাই মোহাম্মাদ ফারুকের হাতে ব্যবসার দায়িত্ব দিয়ে গজলে মনোনিবেশ করেন। ফারুকের বয়স তখন মাত্র ১৯, কিন্তু তারুণ্য আর প্রাণশক্তিতে ভরপুর এই ব্যবসায়ী ব্যবসায়ে নেমে পড়েন এবং গোড়াপত্তন করেন ফেমাস গ্রুপ অব কোম্পানিজের।
২০০২ সালে বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন রেজিস্ট্রেশন করে। সে সময় থেকে ২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিদ্বন্দ্বীহীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ফারুক।
ফারুক চেয়েছিলেন তার অন্তত একজন উত্তরাধিকার সুগন্ধী প্রস্তুতের ওপর হাতেকলমে শিক্ষার্জন করুক। এ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করা ছোট ছেলে মোহাম্মাদ নওয়াজকে তিনি প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেন বিজনেস অ্যান্ড পারফিউমারির ওপর ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জনের জন্য। এখন পর্যন্ত নওয়াজই একমাত্র বাংলাদেশি যার পারফিউমারির ওপর উচ্চতর ডিগ্রি রয়েছে।
পারফিউমারি ব্যবসা সম্পর্কে কথা বলার জন্য আমরা কথা বলেছিলাম নওয়াজের সাথে। তিনি জানান, "সারাবিশ্বে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার সুগন্ধী কেমিক্যালের বাণিজ্য হয়। এর বিপরীতে দেশের সবচেয়ে বড় সুগন্ধী বাণিজ্যকেন্দ্র মিটফোর্ড রোডে মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ সুগন্ধী কেমিক্যালের বাণিজ্য হয়।"
কোন সুগন্ধী কেমিক্যালটি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় তা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটির উত্তর দেওয়াটা বেশ কঠিন।
"ধরা যাক, আপনার প্রয়োজন 'মোহিনী', যেটি ভারতের বিখ্যাত আগরবাতি ব্র্যান্ড 'দর্শন' ব্যবহার করে থাকে। মোহিনী সুগন্ধী তৈরি করতে প্রায় ২০০টি কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, এগুলোর মধ্যে আবার বেশ কয়েকটি খুবই সামান্য পরিমাণ ব্যবহার করা হয়। ক্রেতারা সবগুলো কেমিক্যালের নাম জানেন না, তারা কেবল 'মোহিনী'র নামই জানেন।"
মিটফোর্ডের ব্যবসায়ীরা কখনো নকল বা ভেজাল সুগন্ধীর বাণিজ্য করেন না। ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর অথবা ভারত থেকে তারা সরাসরি সুগন্ধি কেমিক্যাল আমদানি করে বলে জানান তিনি।
পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে তাদের প্রয়োজনীয় সুগন্ধীর অর্ডার দেয় সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নওয়াজ বলেন, "ধরুন একজন ডিটারজেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাদের প্রয়োজনীয় সুগন্ধীর চাহিদা সম্পর্কে আমাদেরকে জানিয়েছে। আমরা তখন ইউরোপে সেই সুগন্ধীর নমুনা পাঠিয়ে দেই। নমুনাটিকে এরপর জিসি-এমএস (গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফি ম্যাস স্পেক্ট্রোমেট্রি) পদ্ধতি দ্বারা পরীক্ষা করা হয়, যার মাধ্যমে সুগন্ধীর মধ্যে থাকা জটিল কেমিক্যাল বিশ্লেষণ করে সেগুলোকে আলাদা করে চিহ্নিত করে সেগুলোর পরিমাণ বের করা হয়। বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া রিপোর্ট পাওয়ার পর আমরা প্রয়োজনীয় কেমিক্যালের অর্ডার দেই।"
"যারা এই সুগন্ধী ব্যবহার করে, এমনকি এগুলোর আমদানিকারকরাও কেবল [মোহিনীর মতো] ব্র্যান্ডের নামই জানেন। কিন্তু তারা জানেন না এই ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলো কোথা থেকে তাদের কেমিক্যালগুলো নিয়ে আসে। অবশ্য তাদের এগুলো জানার প্রয়োজনও নেই।"
মাঝেমধ্যে মিটফোর্ড রোডের এই দোকানগুলোকে নকল ও ভেজাল পারফিউম এবং টয়লেট্রিজ উৎপাদনের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ করা হয়। তবে এখানকার ব্যবসায়ীরা শক্তভাবে এটি অস্বীকার করেন।
লাক্স ভেলভেট টাচ সাবানের লেবেল দেখিয়ে একজন ব্যবসায়ী বলেন, "এই যে এখানে ছোট অক্ষরে লেখা রয়েছে সাবানটিতে জেসমিনের 'গ্রেড-২'-এর সুগন্ধী ব্যবহার করা হয়। এর মানে কি ইউনিলিভার নকল লাক্স উৎপাদন করে? না, এর মানে সাবানে 'প্রিমিয়াম' মানের সুগন্ধী ব্যবহার করা হয় না। (প্রিমিয়াম, গ্রেড-১ এবং গ্রেড-২ তিনটি মানের সুগন্ধী, যেখানে প্রিমিয়াম সুগন্ধী সবচেয়ে ভালো মানের।)"
ছোট ও মাঝারি মানের শিল্প কোম্পানির জন্য সরাসরি ইউরোপ থেকে আমদানিকৃত প্রিমিয়াম কোয়ালিটি সুগন্ধীর হালকা মিশ্রণও বিক্রি করেন মিটফোর্ড রোডের ব্যবসায়ীরা। মাঝেমধ্যে বড় কোম্পানিগুলোও ছোট আকারে ভারি মিশ্রণের কেমিক্যাল কিনে থাকে।
যেমন: বাংলাদেশের স্কয়ার টয়লেট্রিজ প্রায়ই স্পেনের ইবারশেম ফ্রেগরেন্সেস অব ন্যাচার এবং নওয়াজের ফেমাস কোম্পানির জয়েন্ট ভেঞ্চার ফেমাস ইবারশেম ফ্লেভারস অ্যান্ড ফ্রেগরেন্স থেকে কেমিক্যাল কিনে থাকেন। ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর গাজীপুরের টঙ্গীতে ২০০৩ সালে কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
নওয়াজ জানান, "বড় কোম্পানিগুলো গুণমান নিয়ে কাজ করে। যেহেতু আমি স্প্যানিশ মান ধরে রেখে একটি কারখানা চালাই, আমি শক্তিশালী মিশ্রণের সুগন্ধী সরবরাহ করতে পারি। অন্য ব্যবসায়ীরা এই কেমিক্যালগুলোই দিয়েই তৈরি সুগন্ধী বানায়, কিন্তু সেগুলো আমদানি করা হয় ভারত থেকে, ফলে সেগুলোর দামও কম। এই পার্থক্যগুলো কেবল তাদের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ, যারা এই কেমিক্যালগুলোকে তাদের পণ্য হিসেবে বা পণ্যের ভেতর ব্যবহার করবে।"
নওয়াজের মতো বিশেষজ্ঞরা মাত্র একবার গন্ধ শুঁকেই প্রতিটি পারফিউমকে আলাদা করে চিনতে পারেন। তবে পুরো কথোপকথনে একবারও কোন কেমিক্যালের রাসায়নিক নাম শোনা যায়নি। তিনি জানান, এটাই সুগন্ধীর ব্যবসা। কেমিক্যালের নাম না জেনেই এই ব্যবসা চালানো সম্ভব।
সাক্ষাৎকার শেষ হতেই মাথায় একগাদা তথ্য আর কাপড়ে সুগন্ধীর খুশবু নিয়ে আমরা মিটফোর্ড রোড ছাড়লাম।