খুদের ভাত খেতে কেন যাই কেরানীগঞ্জের ইনসার আলীর হোটেলে!
বাংলার গৃহস্থ বাড়ির ঘরে ঘরে তখন ঢেঁকি। সেই ঢেঁকিতে পা দিয়ে ধান ভাঙার আসর জমাতেন বাড়ির বউরা। ধান ছেঁটে চাল বের করতে গিয়ে জমতো ভাঙা চাল। গ্রামবাংলার সকালের নাস্তায় সাধারণ খাবার ছিল সেই ভাঙা চাল দিয়ে রান্না করা খুদের ভাত। এলাকাভেদে যাকে ডাকা হতো বউভাত, খুদের ভাকা, বউখুদি, বউয়া ভাত ইত্যাদি নানান আদুরে নামে। অবস্থাসম্পন্ন ঘরে শখ করে এ খাবার রান্না হলেও মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র কৃষকের ঘরে খুদের ভাত ছিল সহজে খিদে মেটানোর এক অব্যর্থ টোটকা। নানান পদের ঝাল ভর্তার সঙ্গে খুদের ভাতের যুগলবন্দী স্বাদও ছিল অতুলনীয়।
সময়ের সঙ্গে ঢেঁকির প্রচলন হারিয়ে চাল ভাঙার মেশিন যত আধুনিক হতে লাগল, খুদের ভাতও স্মৃতির কোণে জমে তত ফ্যাকাশে হয়ে এল। কারণ চাল ভাঙার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে যে খুদ মিলে না সহজে। কিন্তু রসনাবিলাসী বাঙালির মন থেকে বাঙালিয়ানার গন্ধমাখা কোনো খাবার কি সহজে হারায়! বাঙালিয়ানার সে স্বাদের টানেই আট বছর ধরে ভোজনপ্রেমীদের মনে জায়গা করে নিয়েছে সোহানা হোটেলের ইনসার আলীর খুদের ভাত।
কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠা ইনসার আলী প্রায় বারো বছর আগে ঢাকার কেরানীগঞ্জের রোহিতপুরের গোয়ালখালী গ্রামে খুলেছিলেন সোহানা হোটেল। পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট মেয়ে সোহানার নামেই হোটেলের নাম। শুরুতে ভাত, পরোটা, পুরি, সিঙ্গারা, পেঁয়াজুর মতো নানান ধরনের খাবার পাওয়া গেলেও এখন শুধু খুদের ভাত-ভর্তাই ইনসার আলীর হোটেলের মূল আকর্ষণ। ১০ বছর আগে ইনসার আলী যখন হোটেলের জন্য খুদের ভাত রান্না করার পরিকল্পনা করেছিলেন, তখন বাঙালি পয়সা দিয়ে খুদের ভাত কিনে খাওয়ার কথা ভাবতেই পারত না। কিন্তু ইনসারের চিন্তা ছিল ভিন্ন।
তার ভাষ্যে, 'পরোটার সাথে প্রতিযোগিতা কইরা খুদের ভাকা (কেরানীগঞ্জে খুদের ভাতকে বলা হয় খুদের ভাকা) রান্না করতাম আমি। সে সময়ে পরোটার দাম ছিল পাঁচ টাকা কইরা। দুইটা পরোটা আর একটা চা বা ভাজি খাইলেই ১৫ টাকা শেষ। আমার হোটেলের কাস্টমার ছিল গ্রামের কৃষক-মজুরেরা। ১৫ টাকার এ নাস্তা কইরা ক্ষেতে কাজ করতে গেলে একটু পরেই খিদা লাগে। কম টাকায় বেশিক্ষণ পেট ভরা রাখার মতো খাবার খুঁজতে গিয়া খুদের ভাকার কথা মাথায় আসে।'
শুরুতে ১৫ টাকায় খুদের ভাতের সঙ্গে পাঁচ-সাত পদের ভর্তা বিক্রি করতেন ইনসার আলী। গ্রামের কৃষকেরা যে খুব একটা আগ্রহ নিয়ে খেতে আসতেন এ খাবার তা কিন্তু নয়। তাদের জন্য খুদের ভাত এতটাই সাধারণ খাবার যে হোটেলে বসে খাওয়াটা ছিল বিলাসিতা, তার দাম যত কমই হোক! বছরখানেক পর একদিন কয়েকজন সাইক্লিস্টের একটি দল আসে ইনসার আলীর হোটেলে। সেখানে খুদের ভাত-ভর্তা খেয়ে বেশ চমৎকৃত হন দলের সবাই।
ফিরে গিয়ে তারা ফেসবুকে পোস্ট করলে তা দেখে আগ্রহী হন আরও অনেক ভোজনপ্রিয় ব্যক্তি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে ধীরে ধীরে ইনসার আলীর খুদের ভাতের নামডাক ছড়িয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে। গ্রাহকদের অনুরোধে তখন খুদের ভাত-ভর্তার সঙ্গে ডিম ভাজিও যোগ করেন তিনি। নিয়মিতই ঢাকা শহরের নানা প্রান্ত ও আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সোহানা হোটেলে ভিড় জমান বাঙালি খাদ্যরসিকেরা।
গোয়ালখালী মেইন রোডের পাশে কচুরিপানার ডোবার ওপর কাঠের মাচা আর টিনের বেড়ায় তৈরি হোটেলটি। ছিমছাম পরিবেশে আট-দশটির মতো টেবিল পাতা। এক পাশে টেবিলের ওপর বড় হাঁড়িতে রাখা খুদের ভাত, আর কয়েকটি পাত্রে সাজানো ভর্তা। গ্যাসের চুলায় ভাজা হচ্ছে ডিম। অর্ডার করার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মেলামাইনের প্লেটে হলদে খুদের ভাতের চারপাশে আলু, সরিষা, ধনে-পুদিনা, কালোজিরা, কাঁচা মরিচ আর শুকনা মরিচের ভর্তার সঙ্গে গরম গরম ভাজা ডিম পরিবেশিত হলো। খুদের ভাতে তেলের পরিমাণ কিছুটা বেশি মনে হলেও ডিম ভাজা আর ভর্তার যুগলবন্দীতে স্বাদের কোনো কমতি হয়নি। দোকানের কর্মচারী জানালেন ছুটির দিন নয় বলে আজ ভিড় নেই তেমন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সাইকেলে চেপে হাজির হলেন চারজনের একটি দল। ঢাকা থেকে আসা সে দলের একজন জানালেন প্রায়ই তারা দলবেঁধে খেতে আসেন এখানে। গ্রামীণ পরিবেশে মাটির চুলায় রান্না খুদের ভাতের স্বাদ আর ঘ্রাণ মুগ্ধ করেছে তাদেরকে। তিনটি মোটরবাইকে করে আরেক দল তরুণ এসেছেন মুন্সিগঞ্জ থেকে। সোহানা হোটেলের খুদের ভাতের বিশেষত্ব জানতে চাইলে এ দলের মাসুম বলেন, 'ছোটবেলায় খুদের চাল ডিম-পেঁয়াজ দিয়ে ভেজে রান্না করত মা। ভাঙা চাল দিয়ে রান্না করা সেই ভাতে কালো কালো অনেক মরা চালও থাকত। অন্যরকম একটা স্বাদ ছিল তাতে। ফেসবুকে দেখে ইনসার আলীর হোটেলে সেই স্বাদই খুঁজতে এসেছিলাম। কিন্তু এখানকার খুদের ভাত অনেকটা পোলাওয়ের মতোই। আমার মায়ের রান্নার সঙ্গে এটার মিল না থাকলেও হতাশ হইনি। বন্ধুদের সাথে নতুন জায়গায় ঘুরতে আসার আমেজটাই আসল।'
ঢাকার বাদামতলী থেকে পোলাওয়ের চালের বাছাই করা খুদ সংগ্রহ করেন ইনসার আলী। তার স্পেশাল খুদের ভাতের রন্ধনপ্রণালীটাও পোলাওয়ের মতোই। হলুদ দিয়ে রান্না করা হয় বলে অনেকে খিচুড়িও ভাবেন। খুদের ভাত রান্নার কার্যক্রম এত বছর যাবৎ নিজেই করছেন তিনি। সঙ্গে থাকা ভর্তাগুলো বানান তার স্ত্রী নিলুফার বেগম। বর্তমানে এক প্লেট খুদের ভাত আর ছয় পদের ভর্তার দাম ৪০ টাকা। সঙ্গে ডিম ভাজি নিলে দাম পড়বে ৬০ টাকা। ছুটির দিনে আয়োজন থাকে গরু আর মুরগির মাংসেরও। দাম যথাক্রমে ১৬০ টাকা আর ৭০ টাকা প্রতিবাটি। ইনসার আলীর নিজের পালিত গরুর দুধের তৈরি দইও পাওয়া যায় হোটেলে।
প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চলে সোহানা হোটেলে। সকাল ১১টা পর্যন্ত ভিড় থাকে বেশি। সারাদিনে রান্না হয় তিনবার। ইনসার আলীর স্ত্রী ও তার ব্যবসায়িক সঙ্গী নিলুফার বেগম জানান দিনের খাবার শেষ হয়ে যাওয়ার পরও হোটেলে দূর-দূরান্ত থেকে কেউ খেতে আসলে কখনো না খাইয়ে ফেরত পাঠান না তারা। তাৎক্ষণিক রান্না করে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
সাধারণ দিনে প্রায় ১০-১৫ কেজি খুদের ভাত রান্না করেন ইনসার আলী। শীতের দিনে চাহিদা বেশি থাকায় রান্না হয় প্রায় দ্বিগুণ। আর প্রতি ছুটির দিনে খুদের ভাত বিক্রি হয় প্রায় ৫০ কেজি। ইনসার আলীকে দেখে আশেপাশের অনেক হোটেলেই শুরু হয়েছে খুদের ভাত বিক্রি। তবে মাটির চুলায় রান্না করা ইনসার আলীর স্পেশাল খুদের ভাত এখনো সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ভোজনপ্রেমীদের কাছে।
কৃষি জমিতে দিনমজুরীর কাজ ছেড়ে হোটেল ব্যবসা শুরু করেছিলেন ইনসার আলী। বর্তমানে নিজের জায়গায় পাঁচ তলা ফাউন্ডেশনের বাড়িও করেছেন হোটেলের আয় থেকে। আগামী কোরবানী ঈদের পর সেই বাড়ির নিচের দুই তলায় সোহানা হোটেলের নতুন শাখা খোলার পরিকল্পনা করছেন তিনি।
ঢাকার গুলিস্তান থেকে নবাবগঞ্জগামী বাসে করে সহজেই যাওয়া যায় কেরানীগঞ্জের রোহিতপুর। আবার মোহাম্মদপুরের বছিলা ব্রিজ হয়ে আটিঁবাজার পার হয়েও যাওয়া যায় সেখানে। রোহিতপুর বাজার থেকে অটোরিকশায় করে মিনিট দশেকের রাস্তা ইনসার আলীর খুদের ভাতের হোটেলের।