কীটনাশক যেভাবে আমাদের অনুভূতি ও স্নায়ুতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে
যুক্তরাজ্যের একটি কৃষি খামার ব্যবস্থাপক টিম পার্টন। বছর ১৫ আগে কৃত্রিম সার ও কীটনাশকের বদলে নিজদের তৈরি জৈবিকভাবে সক্রিয় প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন। যেমন মাটিতে নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের মাত্রা ঠিকঠাক রাখতে, ফসলের সাথে রোপণ করেন ট্রিকোডের্মা নামক এক ধরনের ফাঙ্গাস। বিবিসি ফিউচার অবলম্বনে।
পার্টন একা নন, বিশ্বব্যাপী কৃষিখাতের অনেকেই 'পুনরুৎপাদনশীল কৃষি'র (রিজেনারেটিভ এগ্রিকালচার) সাথে যুক্ত হচ্ছেন। এটি এমন এক পদ্ধতি যেখানে কৃত্রিম উপকরণের ন্যূনতম ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকৃতি ও মানবস্বাস্থ্য সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
কীটনাশকের প্রভাবে মাথাব্যথা এবং চামড়ায় ফুসকুড়ির মতো লক্ষণ দেখা দেওয়ায় টিম পার্টন জৈবিক উপাদান ব্যবহারে ঝোঁকেন। বাণিজ্যিক খামারে ভেড়ার পশমে বাসা বাঁধা উকুন/ পরজীবী দূর করতে তাদের মাসে একবার কীটনাশক ভরা চৌবাচ্চায় স্নান করানো হয়। একাজ করার পর টিম পার্টন খেয়াল করেন, তার হাতের কিছু অংশ ফুলে উঠছে। আর তারপর সেখানে চুলকানি ও জ্বলুনির মতো বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা বেশ কয়েকদিন ধরে থাকতো।
তার ভাষ্যে, 'এটা ছিল বেশ যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা; চিকিৎসকদের কাছে গেলে তারা বলতেন এটা তোমার শারীরিক প্রতিক্রিয়া মাত্র, খুব বেশি গুরুতরভাবে নেওয়ার দরকার নেই'।
রাসায়নিকের প্রতি তখন থেকেই আগ্রহ হারান টিম। ধীরে ধীরে জৈবিক চাষ পদ্ধতিকে গ্রহণ করেছেন বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে। এখন এ পদ্ধতিতে যথেষ্ট অভিজ্ঞ তিনি। পুনরুৎপাদনশীল কৃষি পদ্ধতি রপ্ত করার পর আর কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়তে হয়নি। এমনকী গত ১০ বছরে খামারের জমিতে কোনো প্রকার ফসফরাস বা পটাশিয়াম সার ব্যবহার করতে হয়নি বলেও জানান টিম। বলেন, 'ফসলের চারাগুলোকে যথাসম্ভব তরতাজা ও পুষ্টিগতভাবে ভারসাম্যের মধ্যে রাখার চেষ্টা করি; সঠিক মাত্রায় পুষ্টি পেলে চারাগুলো রোগাক্রান্ত হয় না'।
অর্থাৎ, শুধু যদি ফসলকে স্বাস্থ্যকর রাখা যায়, তাহলেই অনেকাংশ ক্ষেত্রে দূরে থাকে রোগবালাই। সেক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের দরকারও হয় না।
খামারে কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করলে জীববৈচিত্র্যও রক্ষা পায়। ফিরে আসে প্রকৃতির সন্তানেরা। টিম লক্ষ করেন, কীটনাশককে বিদায় জানানোর পর থেকেই তার খামারের এলাকা পাখি ও পতঙ্গের বিভিন্ন প্রজাতির যেন হাট বসেছে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, 'উপরি পাওনা হিসেবে এলো অনেক অনেক পাখি; এখানে যথেষ্ট খাদ্যের উৎস (পতঙ্গ) থাকায় বিভিন্ন বিপন্ন প্রজাতি এখানে প্রজনন ও বংশবিস্তার করছে'।
পরজীবী, আগাছাসহ বিভিন্ন অণুজীব, যেগুলো ফসলের জন্য ক্ষতিকর, তাদের নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদানই হলো কৃত্রিম কীটনাশক। এতে গাছের বৃদ্ধিকে সাহায্য করা যায়। এগুলো কার্যকর হলেও, কীটনাশনকে থাকে তেজস্ক্রিয় বিভিন্ন উপাদান, যা মানবদেহের অনুভূতিশীল অঙ্গ এবং স্নায়ুতন্ত্রে নানান দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
১৯৩০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে ফসলের মাঠে কৃত্রিম কীটনাশকের ব্যবহার ব্যাপক স্তরে শুরু হয়, পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে। প্রান্তিক কৃষিজীবী থেকে শুরু করে বড় খামার সংস্থা– সবাই এর ব্যবহার শুরু করে। আর ফলনেও পড়ে তার ব্যাপক প্রভাব। বর্তমানে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ কৃষিপণ্য উৎপাদন কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও বা হু)-র মতে, বিশ্বজুড়ে এক হাজারের বেশি ধরনের কীটনাশক ব্যবহার হচ্ছে; সবচেয়ে প্রচলিত ধরনগুলো হচ্ছে হার্বিসাইড(৪৯%), ফাঙ্গিসাইড ও ব্যাক্টেরিয়াসাইড (২৭%) এবং ইনসেক্টিসাইড (১৯%)।
১৯৯০ সালে কীটনাশকের বৈশ্বিক ব্যবহার ছিল- ৩৭২ কোটি লিটার বা ১৬৯ কোটি কেজি। গত দুই দশকে যা ৫৭ শতাংশ বেড়ে ২০২০ সাল নাগাদ ৫৮৬ কোটি লিটার বা ২৬৬ কোটি কেজিতে পৌঁছায়। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির এক প্রতিবেদনে কীটনাশকের ব্যবহার আরো বৃদ্ধির আভাস রয়েছে, যার পেছনে প্রধান ভূমিকা থাকবে বিশ্বের বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য বাড়তি খাদ্য উৎপাদনের চাহিদা।
২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা ৯৩০ কোটি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, এজন্য খাদ্য উৎপাদনও ৬০ শতাংশ বাড়াতে হবে। এ চাহিদা পূরণে কৃষকদের আরো কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে বলে মনে করেন গবেষকরা।
অর্থাৎ, আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য ও চারপাশের প্রকৃতিতে ক্ষতিকর রাসায়নিকের আরো বিস্তার হতে চলেছে। এতে প্রাণপ্রকৃতির সাথে সাথে মানবস্বাস্থ্যও গুরুতর হুমকির মুখে। অথচ খাদ্যের উচ্চ চাহিদার বর্তমান প্রেক্ষাপটে কীটনাশক নির্ভর কৃষি থেকে সরে আসাও সহজ নয়।
যেমন ইউরোপীয় কৃষি পদ্ধতির ওপর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, একেবারে কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ করলে ফল উৎপাদন ৭৮ শতাংশ, সবজি উৎপাদন ৫৪ শতাংশ এবং ৩২ শতাংশ দানাদার শস্যের ফলন কমবে। কিন্তু, আমাদের কীটনাশক নির্ভরতার চড়া মূল্য দিচ্ছে প্রকৃতি। বিভিন্ন গবেষণা জানাচ্ছে, এর কারণে গন্ধের অনুভূতি হারাচ্ছে মৌমাছি ও স্যামন মাছ। নদী, খাল, বিল, জলাশয় দূষিত হয়ে বিপন্ন জলজ বাস্তুসংস্থান।
'বায়োঅ্যাকুমুলেশন' জৈবসঞ্চয় প্রক্রিয়ায় কীটনাশক খাদ্যচক্রেও অনুপ্রবেশ করে। এটা তখনই ঘটে যখন প্রাণীর শরীরে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত দ্রব্য অনুপ্রবেশ করে যা জৈবিক প্রক্রিয়া পাঁচন বা নিঃসরণ করতে পারে না। এতে ওই উপাদান শরীরে জমতে থাকে। রাসায়নিক অনেক কীটনাশক মানুষ বা প্রাণীদেহ ভাঙতে না পারায় এগুলো চর্বির সাথে আমাদের দেহে জমা হতে শুরু করে।
মানবস্বাস্থ্যে এতে বিপর্যয়কর প্রভাব পড়ে। কীটনাশক ব্যবহার বিধিমালা বা আইনগুলোও অনেক সময় মানা হচ্ছে না। বৈশ্বিক বিভিন্ন ধরনের বিধিমালা থাকার পরও, এক বছরেই কৃষি শ্রমিকদের দেহে সাড়ে ৩৮ কোটি বার কীটনাশকের বিষাক্ত প্রভাব পড়ার প্রমাণ উঠে এসেছে এক অধ্যয়নে।
স্প্রে করা হলে, কীটনাশক সুক্ষ্ম কণা হয়ে ছড়ায়, এতে এমন ধরনের বাষ্প তৈরি হয় যা বাতাসকে দূষিত করে। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি শ্রমিকদের ৩৭-৫৪ শতাংশ কীটনাশকজনিত অসুস্থতার জন্য 'স্প্রে ড্রিফট' বা ছিটানো কীটনাশক বাতাসে ভেসে শরীরে প্রবেশ দায়ী; অসুস্থদের মধ্যে মাথাব্যথা, গা গুলানো থেকে শুরু করে চামড়ায় জ্বালাপোড়ার মতোন বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়।
কীটনাশক বিষক্রিয়ার প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে এগুলো ছাড়াও মাথা ঝিমঝিম করা, অবসন্নতা এবং শ্বাসতন্ত্র থেকে ক্ষরণের মতো উপসর্গ দেখা যায় বলে জানান মাইকেল পেররো। সাবেক এই শিশুরোগ চিকিৎসক অলাভজনক সংস্থা- জিএমও সায়েন্স- এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। এই পাবলিক প্লাটফর্মে জিএমও বা জেনেটিকভাবে রুপান্তরিত ফসল ও খাদ্যের প্রভাব পর্যালোচনা ও আলোচনা করেন চিকিৎসকরা। তাদের মতে, কীটনাশকের তীব্র শারীরিক প্রভাবে শ্বাসযন্ত্র চাপে পড়ে বা শ্বাসপ্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হয়। এতে আমাদের স্নায়ুতন্ত্র ও অনুভূতি শক্তি কতোটা বিপন্ন হবে- সেটা সংস্পর্শে থাকার সময় বা কীটনাশকের ধরনের ওপর নির্ভর করে।
পেররো বলেন, 'সব ধরনের (রাসায়নিক) কীটনাশকই ক্ষতিকর। নিঃশ্বাসের মাধ্যমে কীটনাশকের কণা আমাদের ফুসফুস হয়ে অন্ত্রে প্রবেশ করলে বিষক্রিয়া তৈরি হতে পারে'।
কীটনাশকের সংস্পর্শে এসে বিশেষ কিছু অনুভূতি (দৃষ্টি, ঘ্রাণ, স্বাদ ইত্যাদি) ক্ষমতার অবনতি হতে পারে। শুরুর দিকের এমন একটি ঘটনার কথা জানা যায়, ১৯৬০ এর দশকে জাপানের সাকু কৃষি অঞ্চলের। অর্গানোফসফেট নামক রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসার পর এই অঞ্চলের বাসিন্দারা দৃষ্টিশক্তি বিভ্রমে ভুগেছিলেন।
এই রোগকে 'সাকু ডিজিজ' নাম দেওয়া হয়; এতে ঝাপসা দেখা, চোখের মণির অস্বাভাবিক নড়াচড়া, দৃষ্টিক্ষীণতা এবং বিষমদৃষ্টি বা নকুলান্ধতা (Astigmatism) দেখা দেয়। বিষমদৃষ্টি এক ধরনের দৃষ্টিত্রুটি যেখানে কর্নিয়া বা লেন্সের বক্রতায় গড়মিল থাকে, যার ফলে যে-কোনো দূরত্বে বিকৃত বা ঝাপসা দেখা যায়।
ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের ওপর করা গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষকদের পাশাপাশি তাদের স্ত্রীরাও দৃষ্টিবিভ্রমে আক্রান্ত। গবেষকরা জানান, কৃষকরা ক্ষেত থেকে তেজস্কিয় দূষণ বাড়ি পর্যন্ত বয়ে এনেছেন অজান্তেই; আবার অনেকে বাড়ির কাছের জমিতে কীটনাশক স্প্রে করেছেন, যা বাতাসে উড়ে গিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের আক্রান্ত করেছে।
মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগবিস্তার বিজ্ঞান ও জৈবপরিসংখ্যানের অধ্যাপক হংলই চ্যান বলেন, 'যারা মাঠে কীটনাশক ছিটান তাদের ত্বক বা পোশাকেও অনেক সময় এগুলো সূক্ষ্মকণা হিসেবে লেগে থাকে, ফলে যারা তাদের আশেপাশে থাকে, তারাও এগুলো শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারে। এ ধরনের সেকেন্ডারি এক্সপোজার দীর্ঘস্থায়ী হলে তা স্বাস্থ্যে ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে'।
মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের ওপর কীটনাশকের প্রভাব নিয়ে এক অনুসন্ধানী গবেষণা করছে। চেনও এতে যুক্ত আছেন। এই গবেষণার আওতায়, ১১ হাজার ২৩২ জন চাষীকে ২০ বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এসব কৃষকদের অন্তত ১০.৬ শতাংশ 'হাই-পেস্টিসাইড এক্সপোজার ইভেন্ট' (এইচপিইই) বা কীটনাশকের উচ্চ মাত্রার সংস্পর্শে ছিলেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এইচপিইই সংজ্ঞায়িত করা হয়নি; বা গবেষকরা এর মাত্রা নির্ধারণ করে দেননি। বরং কৃষকদের নিজস্ব মতামত এবং কীটনাশকের সংস্পর্শে এসে তাদের দৈহিক প্রভাবের তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। এতে দেখা যায়, যেসব কৃষক এইচপিইই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন, তাদের মধ্যে দুর্বল ঘ্রাণশক্তির ঘটনা ৪৯ শতাংশ বেশি।
২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় ৮৬ কোটি কৃষি শ্রমিকদের অন্তত ৪৪ শতাংশ কীটনাশক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হন। কীটনাশক ছিটানোর সময় সুরক্ষা সরঞ্জাম ও পোশাকের অভাবই যেজন্য দায়ী। সুরক্ষা পোশাক না থাকায়, ত্বক বা শ্বাসগ্রহণের মাধ্যমে কীটনাশক শোষণ বেড়ে যায়; কাজের পর এটা শ্রমিকদের খাদ্য গ্রহণের সময়ও হতে পারে।
চেন বলেন, 'নিঃশ্বাসের মাধ্যমে কীটনাশক আমাদের শরীরে ঢুকে স্নায়বিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। এসব রাসায়নিক সহজে আমাদের রক্ত ও মস্তিকের বাধা এড়াতে পারে। খাদ্যের মাধ্যমে কীটনাশক আমাদের পাচকতন্ত্রে পৌঁছাতে পারে, সেখান থেকে অনুপ্রবেশ করতে পারে রক্তে'।
কীটনাশক ব্যবহারের সাথে বিভিন্ন 'নিউরোডিজেনেরেটিভ' রোগের সম্পর্কও তুলে ধরেছে অনেক গবেষণা প্রতিবেদন। কীটনাশকের সংস্পর্শে এসে 'এটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডার' (এডিএইচডি) এবং পার্কিনসন্স রোগ হতে পারে। কানাডার গুয়েলফ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে যে, কীটনাশকের প্রভাবে প্রাণীদেহের কোষ এমনভাবে অভিযোজিত হয়- যার সাথে পার্কিনসন্স রোগের বেলায় যেমনটা হয়, তার মিল আছে। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ইঁদুরের দেহে 'ডোপামিন ট্রান্সপোর্টার এক্সপ্রেশন বা ডিএটি' সৃষ্টি করেছে এক ধরনের কীটনাশক। সাধারণত এডিএইচডি'তে আক্রান্তদের কোষে ডিএটি নামক এই জিনগত প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়।
এছাড়া, গর্ভবতী নারী বা ছোট শিশুরা কীটনাশকের সংস্পর্শে এলে শিশুরা প্রতিবন্ধী হতে পারে।
প্রাণীদেহের জন্য আগাছা দমনকারী হার্বিসাইডের চেয়ে পতঙ্গদমনকারী ইনসেক্টিসাইড ধরনের কীটনাশকই বেশি তীব্র, কারণ জীবের নার্ভাস সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে এগুলো তৈরি করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ওর্গানোফসফেট, কার্বামেটস এবং ওর্গানোক্লোরিন বিশেষত বেশি ক্ষতিকর। গবেষণায় জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, এগুলোর উচ্চ মাত্রার সংস্পর্শে আমাদের স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে মাঝারি মাত্রার সংস্পর্শে থাকলে তা সমান প্রভাব ফেলে কিনা তা জানতে এখনও গবেষণা চলছে।
চেন বলেন, কীটনাশক ও স্বাস্থ্যের অবনতির মধ্যে সুস্পষ্ট ও চিরায়ত যোগসূত্র স্থাপন করাটা একটা চ্যালেঞ্জ, কারণ আমাদের বায়ুমণ্ডলে দূষিত গ্যাস, ভাইরাস ও অস্থিতিশীল অনুজীবসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকারক উপাদান রয়েছে। (কীটনাশকের সাথে) এগুলোও শরীরে জমা হতে পারে এবং সবমিলিয়ে স্বাস্থ্যের ব্যাপক অবনতি তৈরি করতে পারে'।
শরীরবৃত্তিক গঠনের কারণেই শিশুরা কীটনাশকের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। এতে তাদের দৈহিক বিকাশের হার ও আচরণ বদলাতে পারে। পেররো বলেন, 'মাটি থেকে শিশুদের উচ্চতা কম, প্রায়ই তারা মুখে হাত দেয়, ফলে কীটনাশক তাদের পাচকতন্ত্রে যাওয়ার বেশি ঝুঁকিও থাকে বড়দের চেয়ে'।
জার্নাল এনভায়রোমেন্টাল টক্সিকোলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র বলছে, শরীরের প্রতি পাউন্ড ওজনের বিপরীতে খাদ্য ও তরল গ্রহণের পরিমাণ বেশি হওয়ায়, শিশুদের দেহে উচ্চ মাত্রায় কীটনাশক প্রবেশের হুমকি রয়েছে।
২০১৪ সালে ফ্রান্সের বোর্দো অঞ্চলের বিদ্যালয়পড়ুয়া শিশুরা কীটনাশক বিষক্রিয়ার শিকার হয়েছিল। তাদের স্কুল ছিল দুটি আঙ্গুরের বাগানের কাছে, যেখানে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছিল। এতে ২৩ জন শিক্ষার্থী মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট ও চামড়ায় জ্বালাপোড়া বা চুলকানির মতো সমস্যায় ভোগে। পরে ফ্রান্সের দুটি বেসরকারকারি পরিবেশ সমিতি সেপানসো এবং জেনারেশন ফিউচার আঙ্গুর বাগানের মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা করলে তারা প্রায় ৩০ হাজার ইউরো করে ক্ষতিপূরণ দেয়।
কীটনাশকে শিশুদের অসুস্থ হওয়ার ঘটনা বিশ্বব্যাপী দেখা গেছে। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ থেকে নিউজিল্যান্ড দুনিয়ার সর্বত্র এর বিষাক্ত ছোবল বিপন্ন করছে কচিকাচাদের। ভারতে শিশুদের মধ্যে কীটনাশক বিষক্রিয়ার ঘটনা গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে। এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য এক গুরুতর উদ্বেগ জন্ম দিয়েছে। উত্তর ভারতে শিশুদের মধ্যে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামীণ এলাকার ৩০ জন শিশুকে কীটনাশক বিষক্রিয়ার কারণে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়, এরমধ্যে ১৪ জন শিশুকেই পরে বাঁচানো যায়নি।
অপেক্ষাকৃত পুরু ত্বকের কারণে বয়োবৃদ্ধরাও গুরুতর হুমকিতে থাকেন। ত্বকের সংস্পর্শে তাদের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে বহুগুণ। এতে তাদের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক ক্রিয়া ব্যাহত হয়। লিভার বা কিডনির অনেক বেশি সময় লাগে বিষাক্ত উপাদান অপসারণ করতে। ফলে কীটনাশকের বিষাক্ত উপাদান তাদের দেহে জমতে থাকে এবং এক পর্যায়ে শারীরিক অক্ষমতা সৃষ্টি করে; এটি মস্তিস্কের স্নায়ুতন্ত্রকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।