ভারতবর্ষের ‘প্রথম’ ক্রিসমাস কেকের গল্প!
কেক ছাড়া বড়দিনের আনন্দই যেন অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। ভারতবর্ষে কেকের প্রচলন হয় ব্রিটিশ আমলে। এই ব্রিটিশ উপনিবেশে কেকের যাত্রা উনিশ শতকের প্রথমার্ধ্বে শুরু হলেও, বড়দিনের কেকের প্রচলন হয় আরও কয়েক দশক পরে। কেমন ছিল এ অঞ্চলের ক্রিসমাস কেকের শুরুর গল্পটা? উত্তর উঠে এসেছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
সময়টা ১৮৮৩ সালের নভেম্বর মাস। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত ভারতে মার্ডক ব্রাউন নামে একজন বণিক ছিলেন। স্কটিশ নাগরিক মার্ডক কেরালার উপকূলবর্তী মালাবার অঞ্চলে দারুচিনি চাষাবাদের ব্যবসা করতেন। একদিন বড়দিনকে সামনে রেখে কেকের সন্ধানে গেলেন রয়্যাল বিস্কিট ফ্যাক্টরিতে। সেখানকার মালিক মাম্বলি বাপুকে জিজ্ঞাসা করলেন, আসন্ন বড়দিন উপলক্ষে একটি কেক বানিয়ে দেওয়া যাবে কি না।
ব্যবসা তো দূরের কথা, গোটা ভারত মুলুকে তখনো কেকের প্রচলনও ঘটেনি। তাই বাপুর রেসিপি জানা না থাকাই সমীচীন। তবে মার্ডক সুদূর ব্রিটেন থেকে একটি নমুনা কেক নিয়ে এসেছিলেন। পুরো প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে বুঝিয়ে দেন তিনি বাপুকে।
নতুন ধরনের কেকের বিষয়টি বুঝে ফেলতে দেরি হয়নি বাপুর। কারণ বেকারি দোকানের বদৌলতে ইতোমধ্যেই রুটি এবং বিস্কুট বানানোর প্রক্রিয়া তার রপ্ত ছিল, যে বিদ্যা তিনি শিখেছিলেন বার্মায় (বর্তমান মিয়ানমার)। তাই কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও সাহস করে কেক বানানোর দায়িত্ব নিয়ে নেন তিনি।
ম্যাডক তাকে কেক ব্যাটারের সাথে মেশানোর জন্য ব্র্যান্ডি (পানীয় অ্যালকোহল) দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথমবারের মতো কেক তৈরির এই অভিজ্ঞতা কিংবা নিরীক্ষণে নতুনত্ব আসবে না - তা হয় না। ব্র্যান্ডির পরিবর্তে বাপু মেশালেন কাজু আপেল থেকে তৈরি এক ধরনের স্থানীয় মদ। ফলাফল সম্পূর্ণ স্থানীয় উপকরণ দিয়ে তৈরি একটি অনন্য স্বাদের প্লাম কেক!
বানানো শেষে চেখে দেখার পর মার্ডকের মুখ হা হওয়ার জোগাড়। ফলাফলে খুশি হয়ে সাথে সাথেই পুরো এক ডজন কেক অর্ডার করে বসলেন তিনি।
'এভাবেই তৈরি হয়েছিল ভারতের প্রথম ক্রিসমাস কেক,' জানালেন প্রকাশ মাম্বালি, সম্পর্কে বাপুর ভ্রাতুষ্পুত্রের নাতি হন তিনি।
এই কাহিনির কোনো লিখিত প্রমাণ নেই, শুধু আছে পারিবারিক স্মৃতিভাণ্ডারে। কিন্তু মাম্বলি বাপুর রয়াল বিস্কিট ফ্যাক্টরি চার প্রজন্ম ধরে চলছে এখনও একই জৌলুশের সাথে। ভারতের কেরালা রাজ্যের কান্নুর জেলার টেলিচেরি (বর্তমানে থালাসেরি)-তে অবস্থিত তার বেকারি দোকান এখন ভারতের বড়দিনের ঐতিহ্যের অংশ।
বেশ গর্ব করেই প্রকাশ মাম্বলি বলেন, 'বাপু ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ রুচিকে জনপ্রিয় করেছিলেন।'
পূর্বসূরীর এমন চমৎকার কাজ নিয়ে কে বা গর্ব না করে পারবেন! মাম্বলি বাপু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সৈন্যদের কাছেও কেক এবং মিষ্টি রপ্তানি করেছিলেন!
পরবর্তীতে মাম্বলি পরিবার বিভিন্ন নামে একাধিক দোকান খোলেন, যেগুলোর সবকটিই কেকপ্রিয় ভোক্তাদের কাছে পছন্দের গন্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। থালাসেরির মাম্বলি পরিবারের প্রথম ও প্রধান বেকারি এখন প্রকাশ মাম্বলিই পরিচালনা করেন।
তার দাদা গোপাল মাম্বলি বেকারিটি মায়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে পেয়েছিলেন, যা সেই সময়ে কেরালার ঐতিহ্য ছিল। গোপালের ছিল মোট ১১টি সন্তান, যাদের সবাই একে একে এই পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেন।
থালাসেরির একটি ছোট্ট দোকান থেকে যে যাত্রা শুরু, তা ছড়িয়ে পড়ে নানা জায়গায়। মাম্বলি পরিবার বিভিন্ন জায়গায় তাদের বেকারি শাখা খুলে ছড়িয়ে দিতে থাকেন তাদের অমৃত সৃষ্টি।
তবে দোকানের সংখ্যা বৃদ্ধি করলেও, কেক তৈরিতে তাদের মৌলিক কৌশলগুলো ভুলে যাননি তারা। পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রকাশ মাম্বলি বলেন, 'আমরা কেক তৈরির ঐতিহ্যগত পদ্ধতি কঠোরভাবে অনুসরণ করি, যাতে এর গুণমান বজায় থাকে।'
কিন্তু মৌলিকত্ব বজায় রাখতে গিয়ে ব্যবসায় নতুনত্ব আসবে না তা কি হয়! কেক এক ফ্লেভার নিয়ে বসে থাকেনি পরিশ্রমী এই পরিবার। বছরের পর বছর ধরে, যোগ করা হয়েছে কেকের নতুন স্বাদ।
'আমরা এখন আমাদের গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী, দুই ডজনেরও বেশি ধরনের কেক তৈরি করি, বিবিসিকে জানান প্রকাশ।
কেবল কেরালাতেই ব্যবসার গণ্ডি সীমাবদ্ধ- তা কিন্তু নয়। প্রকাশের স্ত্রী লিজি প্রকাশ জানান, তাদের বেশিরভাগ অর্ডার ভারতের অন্যান্য শহর যেমন, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালুরু, চেন্নাই এবং কলকাতা থেকে আসে।
'আমরা তাদের আমাদের সবচেয়ে পছন্দের স্বাদের কেক কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠাই,' যোগ করেন তিনি।
কেরালা যে ক্রিসমাস কেকের জন্য একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত, এটি মোটেও আশ্চর্যজনক নয়। এ রাজ্যের তিন কোটি ৩০ লাখ অধিবাসীর ১৮ শতাংশই খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাদের অসংখ্য ছোট ছোট বেকারি এবং ক্যাফেগুলো মিষ্টান্নের জন্য সুপরিচিত।
কেকের রেকর্ড গড়াতেও পিছিয়ে নেই কেরালা। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, রাজ্যটির বেকারস অ্যাসোসিয়েশন ৫.৩ কিলোমিটারের লম্বা কেক বানিয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম কেকের জন্য গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড স্থাপন করে। এর আগে দীর্ঘতম কেকের রেকর্ড ছিল চীনের, যেটি ছিল ৩.২ কিলোমিটারের।
করোনা মহামারির কারণে দু'বছর ধরে স্তিমিত আয়োজনের পর, এক প্রাণবন্ত বড়দিন উদযাপনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে কেরালা। সেই ধুম লেগেছিল মাম্বলি বেকারিতেও। বেকারিগুলোতে বড়দিনের প্রস্তুতি শুরু হয় নভেম্বরের শুরুর দিকে। এসময় তারা কেক তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো ওয়াইনে ভিজিয়ে রাখতে শুরু করে দেন। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ কেক তৈরি সম্পন্ন হয়ে যায়।
লিজি জানান, 'তরুণরা বেশির ভাগই ফ্রেশ ক্রিম কেক পছন্দ করেন। আর কেক যেহেতু বেশিদিন টিকে না, তাই ক্রিসমাস কেক হলো এই ঋতুর একটি দ্রুত চলমান আইটেম।
মাম্বলি বেকারিতে বড়দিনের আগের সপ্তাহে বিক্রি শুরু হয়ে চলে ইংরেজি নতুন বছর পর্যন্ত।