কোক বনাম পেপসির বাজার দ্বৈরথ: কেহ কারে নাহি ছাড়ে, কেহ নহে ঊন
কোক বনাম পেপসি; আপনার কোনটি পছন্দ? জানেন কি, অতীতে এ দুটি বেভারেজ ব্র্যান্ডের মধ্যে তুমুল মার্কেটিং দ্বন্দ্ব ছিল? কোক-পেপসির বাজার দখলের চেষ্টার এ দ্বৈরথের গল্প শুনিয়েছে কনটেন্টরাইটার্স ডটকম।
কোক-পেপসি জন্মকথন
কোকা-কোলার জন্ম সেই ১৮৮৬ সালে। তবে কোনো কোমল পানীয় হিসেব নয়, জর্জিয়ার আটলান্টার জর্জ এস. প্যাম্বারটন নামক একজন ফার্মাসিস্ট বোতলজাত ঔষধ হিসেবে কোক তৈরি করেছিলেন।
পেপসি'র জন্মও ফার্মাসিস্টের হাত ধরে। ১৮৯৩ সালে নর্থ ক্যারোলাইনার ক্যালেব ব্র্যাডহাম 'ব্র্যাড'স ড্রিন্ক' নাম দিয়ে পেপসি বাজারে আনেন। ১৮৯৮ সালে পেপসি হিসেবে আনুষ্ঠানিক পরিচিতি লাভ করে পানীয়টি। গ্রীক শব্দ পেপসির অর্থ 'হজম'।
পেপসির যখন জন্ম হলো, ততদিনে কোকা-কোলার বিক্রি বছরে এক মিলিয়ন গ্যালনের বেশি ছাড়িয়েছে। নিজেদের বিজ্ঞাপনে সেলিব্রিটি আনার ক্ষেত্রেও প্রথম কোকা-কোলা। ১৯০০ সালে শিল্পী ও অভিনেত্রী হিলডা ক্লার্ককে প্রথমবারের মতো কোকের বিজ্ঞাপনে দেখা যায়।
কোকের শ্রীবৃদ্ধি, দেউলিয়া পেপসি
১৯১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ২৪টি রাজ্যে বছরে লাখ গ্যালন করে বিক্রি হচ্ছিল পেপসি। ওদিকে নিজেদের প্রচারণা ক্যাম্পেইনে সান্তা ক্লজের মতো বিখ্যাত সব চরিত্রকে নিয়ে আসতে শুরু করেছিল কোক।
পেপসির আগেই আমেরিকার বাজার ছেড়ে বাইরে রপ্তানি শুরু করে কোকা-কোলা। ১৯৩০-এর দশকের মধ্যেই ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছে গিয়েছিল পানীয়টি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে চিনি রেশনিংয়ের কারণে ১৯২৩ সালে দেউলিয়া হয়ে যায় পেপসি। এর পাঁচ বছর পরে কোম্পানিটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। ১৯৩০-এর দশকের পরে দ্বিতীয়বার দেউলিয়াত্বের মুখে পড়ে পেপসি। এরপরে ধীরে ধীরে আবার ঘুরে দাঁড়ায় প্রতিষ্ঠানটি।
কোক-পেপসি'র দ্বৈরথ
১৯৫০-এর দশকে টেলিভিশন ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর এ গণমাধ্যমটির ক্ষমতাকে দ্রুত কাজে লাগায় কোকা-কোলা।
একই সময়ে বিজ্ঞাপনের কৌশলে পরিবর্তন আনে পেপসি। কোম্পানিটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ঠিক করেন, পেপসিকে একটি লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড হিসেবে তুলে ধরবেন।
১৯৬০-এর দশকের মধ্যেই বিশ্বের প্রায় ১০০টির বেশি দেশে কোক ও পেপসি পাওয়া যেতে শুরু করে। এ সময় পেপসি তরুণ ভোক্তাদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করে।
১৯৬১ সালে নিজেদের সবচেয়ে সফল স্পিন-অফ পণ্য স্প্রাইট তৈরি করে কোকা-কোলা। তারও পরে ১৯৮০-এর দশকে সেভেন-আপের আন্তর্জাতিক বিপণন স্বত্ব কিনে নেয় পেপসি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে এ পানীয় বিক্রয়ের স্বত্ব ডক্টর পেপারের।
১৯৬৪ সালে ডায়েট পেপসি নিয়ে আসে কোম্পানিটি। তার জবাবে ফ্রেসকো বাজারে আনে কোক। আর ডায়েট কোকের জন্ম হয় ১৯৮২ সালে। ব্র্যান্ড বাড়ানোর ক্ষেত্রে কোক ও পেপসি উভয়েই সমান তালে এগিয়েছে। তবে বর্তমানে সংখ্যার হিসেবে ১৫টি ব্র্যান্ডের মালিকানা নিয়ে এগিয়ে আছে কোক।
১৯৮৫ সালে পণ্যে পরিবর্তন আনতে গিয়ে হোঁচট খায় কোক। নিজেদের চিরায়ত স্বাদের পানীয়ের বদলে তারা নিউ কোক নামক নতুন একটি পানীয় বাজারে ছাড়ে। ভোক্তাদের কাছ থেকে মারাত্মক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়ার পর পুরোনো ফর্মুলাতেই ফিরে গিয়েছিল কোম্পানিটি।
১৯৪৬ সালেই হলিউডের সিনেমায় নিজেদের বিজ্ঞাপনের জায়গা করে নেয় কোকা-কোলা। বিখ্যাত ইট'স আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ দিয়ে এ যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬০-এর দশকে লস অ্যাঞ্জেলসে একটি অফিসই খুলে বসে কোক। ওই অফিসের কাজ ছিল সিনেমাগুলোতে কোকের প্রতিনিধিত্ব যেন সঠিকভাবে ফুটে ওঠে, তা নিশ্চিত করা।
১৯৮০-এর দশকে ব্যাক টু দ্য ফিউচার সিনেমায় পেপসির উল্লেখ পাওয়া যায়। সিনেমাটির ১৯৮৯ সালের সিক্যুয়েলেও পেপসির সরব উপস্থিতি ছিল। ১৯৮০ সালের কাল্ট ক্লাসিক সিনেমা দ্য গডস মাস্ট বি ক্রেজি-তে একটি কোকের বোতল থেকেই যত কাণ্ডের সূচনা হয়।
বিজ্ঞাপনে সেলিব্রিটি
১৯৮০-এর দশকের শুরু থেকেই নিজেদের বিজ্ঞাপনে বিখ্যাত সেলিব্রিটিদের আনতে শুরু করে কোক ও পেপসি দুই কোম্পানিই। মাইকেল জে. ফক্স, মাইকেল জ্যাকসন বেশ কয়েকটি পেপসির বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেন।
পেপসির বিজ্ঞাপনে আরও দেখা গিয়েছে ব্রিটনি স্পিয়ার্স, শাকিরা, কেটি পেরি, বিয়ন্সে, রিকি মার্টিন, নে-ইয়ো-র মতো তারকাদের।
বিজ্ঞাপনে সেলিব্রিটি ব্যবহারে কম যায়নি কোকা-কোলাও। তাদের বিজ্ঞাপনে অংশে নিয়েছিলেন হুইটনি হিউস্টন, পলা আবদুল, এল্টন জন, সেলেনা গোমেজ প্রমুখ। তবে সেলিব্রিটি বিজ্ঞাপনে দুই কোম্পানির মধ্যে পেপসিকেই এগিয়ে রাখতে হবে।
খেলোয়াড় তারকাদের বিজ্ঞাপনে আনার ক্ষেত্রে কোক-পেপসির দৌড় প্রায় সমান। গত কয়েক দশকে দুই কোম্পানিই বেশ কয়েকটি বড় বড় ক্রীড়া আসরের পৃষ্ঠপোষক ছিল। ১৯২৮ সাল থেকেই অলিম্পিকের সঙ্গে যুক্ত কোকা-কোলা। আর যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ফুটবল লিগ (এনএফএল)-এর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি রয়েছে পেপসির।
১০ বছর ধরে সুপার বোল হাফটাইম শো স্পন্সর-এর দায়িত্বে ছিল পেপসি। ২০২১-২০২২ মৌসুমে তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। অনলাইন বিজ্ঞাপনে মনোযোগ দেওয়ার জন্য নতুন করে আর চুক্তি নবায়ন করেনি পেপসি।
সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে পেপসি ও কোক দুটোই অনলাইনে সক্রিয় উপস্থিতি দেখাতে শুরু করে। তবে অনলাইন অনুসারীর দিক থেকে বিবেচনা করলে, ফেইসবুক ফ্যান ও টুইটার ফলোয়ারের ক্ষেত্রে পেপসির চেয়ে অনেক এগিয়ে কোকা-কোলা।
সংখ্যায় সংখ্যায় কোক-পেপসি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কার্বনেটেড কোমল পানীয় বিক্রির তিন-চতুর্থাংশ বাজার কোক ও পেপসির দখলে। আর কোম্পানি দুটির মধ্যে মার্কেট শেয়ারের ৪৫ শতাংশ নিয়ে পেপসির চেয়ে এগিয়ে আছে কোক। অন্যদিকে পেপসির মার্কেট শেয়ার ২৬ শতাংশের মতো।
২০২১ সালে ৩১.৩ বিলিয়ন ইউনিট কেস বিক্রি করেছে কোক। বর্তমানে কোক ও ডায়েট কোক সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া কোমল পানীয়ের ক্ষেত্রে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
২০১১ সালে ডায়েট কোক পেপসিকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থানে উঠে আসে। কারণ তখন পেপসি গতানুগতিক বিজ্ঞাপন কমিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ডিজিটাল বিজ্ঞাপনে বিনিয়োগ করেছিল।
২০২২ সালে কোকা-কোলার মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন ছিল ২৬৮.৪ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে একই সময়ে পেপসির ছিল ২২৯.৩ বিলিয়ন ডলার।
কোক পানীয় তৈরিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও খাদ্যপণ্যের দিকে ঝুঁকেছে পেপসি। এখন পেপসিকোর অর্ধেকের বেশি আয় হয় খাদ্যপণ্য বিক্রি করে।
বিজ্ঞাপনে কে বেশি খরচ করে?
২০২১ সালে কোমল পানীয়র বিজ্ঞাপনের পেছনে ১৯৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে কোকা-কোলা। আর একই সময়ে পেপসির ব্যয় ১১৪ মিলিয়ন ডলার।
অতীতের বছরগুলোতে, কোক-পেপসি দুটোই বিজ্ঞাপনের পেছনে বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করছে। তবে দুই ব্র্যান্ডের মধ্যে তুলনা করলে এক্ষেত্রে পেপসির চেয়ে এগিয়ে কোক।