'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' নিয়ে হ্যারিসন ও জন লেননের তুমুল তর্কের কারণ ছিল ইয়োকো ওনো?
জন লেননের উৎসাহে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের আয়োজন করেছিলেন জর্জ হ্যারিসন। সেই কনসার্টে লেননের পারফর্ম করার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে হাজির হননি। লেনন কেন আসলেন না তা নিয়েও আছে বহু বিতর্ক। অনেকের ধারণা এর জন্য দায়ী ছিলেন লেননের স্ত্রী ইয়োকো। তিনিই কনসার্টে লেননের অংশ নেওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান।
১৯৭১ সালে জর্জ হ্যারিসনের সংগীত গুরু পণ্ডিত রবি শংকর তাকে বাংলাদেশে চলমান মানবিক সংকটের বিষয়ে জানান। হ্যারিসন তাৎক্ষণিকভাবে শরণার্থীদের সাহায্য করতে কনসার্টের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের চিন্তা করেন। নিজের খ্যাতি আর বিখ্যাত সব বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে তিনি শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ান।
তবে জন লেনন যদি তাকে সাহস না যুগাতো তাহলে হয়তো গোটা আয়োজনটাই বাস্তবে রূপ দেওয়াটা হ্যারিসনের জন্য কঠিন হতো। ১৯৯৭ সালে মার্কিন টেলিভিশন বিএইচওয়ানে জন ফুজেলস্যাংকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জর্জ জানান, কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজনের জন্য লেননই তাকে সাহস যুগিয়েছেন।
'আমার মনে হয় বিটলসের অংশ হয়ে আমার একটাই উন্নতি হয়েছে, আর তা হলো আরও বোল্ড হয়ে ওঠা,' বলেন হ্যারিসন। 'আর লেনন আসলে এই বিষয়ে আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। আপনি জানেন না হয়তো লেননের কিছু মনে ধরলে, ও সেটা করেই ছাড়ত। ওর বন্ধু হয়ে আমি এই বিষয়টাই অনেকখানি আয়ত্ত করেছি। ওর আত্মবিশ্বাসটা ছিল এরকম- 'ঠিক আছে, আমরা এটা করে ফেলব। উঠে পড়'।
এমনকি হ্যারিসনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে নানাভাবে সাহায্য করতেও প্রস্তুত ছিলেন লেনন।
'রবি যখন আমাকে বলেন উনার ইচ্ছা পিটার সেলারস ও আমি এসে উনাকে ২৫ হাজার ডলার তুলতে সাহায্য করি, তখন আমার মাথায় লেননের কথাগুলো আসল। সে বলত, ভিডিও করে একটা রেকর্ড রাখলে সেখান থেকে আমরা কয়েক লাখ ডলার তুলতে পারব', বলেন হ্যারিসন।
'এই যে বোল্ডনেস এই বিষয়টা বিটলসে থেকে, খ্যাতি পেয়েই আমার মাঝে এসেছে। যদি আপনি বিখ্যাত কেউ হোন, তাহলে যেকোনো ক্ষেত্রে প্রভাবটাও একটু বেশিই ফেলতে পারবেন,' বলেন তিনি।
তবে উৎসাহ যুগানো ছাড়া জন লেনন কনসার্টটির জন্য খুব বেশি কিছু করতে পারেননি। কনসার্ট ফর বাংলাদেশে লেননের স্ত্রী ইয়োকো ওনোর পারফর্ম করা নিয়ে সেসময় হ্যারিসনের সঙ্গে তার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।
বিটলসের সাবেক সতীর্থদের আমন্ত্রণ জানান হ্যারিসন
তাড়াহুড়ো করে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের আয়োজন করার সময়ই হ্যারিসন মাথায় রেখেছিলেন কাদের পারফর্ম করতে বলবেন। তিনি লিয়ন রাসেল, ক্লাউস ভোরম্যান, বিলি প্রিসটন, ব্যাডফিংগার, এরিক ক্ল্যাপটন এবং বব ডিলান (শেষ মুহূর্তেও যার পারফর্ম করার বিষয়টি নিশ্চিত ছিল না)। তখনও বিটলস ভেঙেছে বেশিদিন হয়নি। কিন্তু হ্যারিসন বিটলসের প্রাক্তন সহশিল্পীদেরও কনসার্টের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
রিঙ্গো স্টার তাৎক্ষণিকভাবে রাজি হয়ে যান। এমনকি তিনি কনসার্টের জন্য ব্লাইন্ডম্যানের ফিল্মিংও স্থগিত করেন। তবে পল ম্যাককার্টনির মনে হয়েছিল ব্যান্ড নিয়ে নিজেদের আইনি জটিলতা চলাকালে এভাবে অংশ নেওয়া উচিত হবে না।
হ্যারিসন ভেবেছিলেন লেনন রাজি হবেন। বিশেষ করে তিনিই যখন হ্যারিসনকে নিউইয়র্কে থাকা এবং কনসার্টের আয়োজন করার বিষয়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার আশা ছিল নিরর্থক। বিটলস ভাঙার পেছনে যাকে অনেকে দায়ী করে থাকেন, সেই মানুষটিই আবার তাদের মাঝে চলে আসে।
'হিয়ার কামস দ্য সান: দ্য স্পিরিচুয়াল অ্যান্ড মিউজিক্যাল জার্নি অব জর্জ হ্যারিসন' বইয়ে জসোয়া গ্রিন লিখেন, হ্যারিসন যখন লেননকে পারফর্ম করার অনুরোধ করেন তখন লেনন জানায় তার সঙ্গে ইয়োকোকেও কনসার্টে পারফর্ম করার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হবে।
'কিন্তু জর্জ হ্যারিসন বিষয়টি মানতে চাইছিলেন না। কনসার্টের জন্য তিনি বিশ্ববিখ্যাত সব সংগীতশিল্পীকে নিজ হাতে বাছাই করে রেখেছিলেন। আর তা নিয়েই দুজনের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়,' লিখেছেন গ্রিন।
কিন্তু তারপরও জন লেনন অংশ নিতে সম্মত হন।
রাজি হয়েও শেষ মুহূর্তে মত বদলেন লেনন
প্রাথমিকভাবে ইয়োকোকে ছাড়াই কনসার্ট ফর বাংলাদেশে পারফর্ম করার জন্য সম্মত হলেও শেষ পর্যন্ত জন লেনন আর আসেননি।
ধারণা করা হয় হ্যারিসন ও লেননের মধ্যে কথা কাটাকাটির বিষয়ে জানতে পারেন ইয়োকো। ইয়োকোকে ছাড়া লেনন যেন কনসার্টে অংশ না নেয় তা নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়। কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজনের দুদিন আগেই নিউইয়র্ক ছেড়ে যান এই দম্পতি। আর তাই শেষ পর্যন্ত প্রাক্তন সতীর্থদের সঙ্গে আবারও একই স্টেজে গান গাওয়া হয়নি লেননের।
ব্যারি মাইলস এবং কিথ ব্যাডম্যানের 'দ্য বিটলস ডায়েরি ভল. ২: আফটার দ্য ব্রেক-আপ ১৯৭০-২০০১' বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী, জন লেননের দাবি এই বিষয়ে স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কোনো ঝগড়াই হয়নি। লেননের বক্তব্য বিটলসের বিজনেস ম্যানেজার অ্যালেন ক্লেইন এই গুজব ছড়ান।
তবে কনসার্ট ফর বাংলাদেশে অংশ না নেওয়ার জন্য লেনন যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন সেটাও খুব একটা যুতসই ছিল না। লেনন বলেন, 'আমার আসলে ভালো লাগছিল না। আমরা ভার্জিন আইল্যান্ডে ছিলাম আর আমি সেখান থেকে নিউইয়র্ক গিয়ে রিহার্স করে আবার ভার্জিন আইল্যান্ডে এসে আবার ফিরে গিয়ে পারফর্ম করতে চাইনি'।
তবে পুরোনো সতীর্থদের সঙ্গে লেননের একসঙ্গে পারফর্ম না করার কারণ আর যাই হোক কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ছিল দারুণভাবে সফল এক আয়োজন। হ্যারিসন আর রিঙ্গোর প্রচুর তারকাখ্যাতি ছিল। আর সেজন্যই শরণার্থীদের জন্য কয়েক লাখ ডলার সাহায্য সংগ্রহ কোনো ব্যাপার ছিল না। লেননের শেষ মুহূর্তে প্রোগ্রাম বাতিল করার কারণে অবশ্য হ্যারিসনের সঙ্গেও তার সম্পর্কে কোনো আঁচ আসেনি। হ্যারিসনও বরাবরই বলে গেছেন তিনি লেননের সঙ্গে আবারও দল বাঁধতে কখনো দ্বিতীয়বার ভাববেন না।
- সূত্র: চিটশিট