কী করে ভ্রমণ করবেন?
নিজের টুকটাক অনুল্লেখযোগ্য ভ্রমণ নিতান্তই নির্লজ্জ আত্মপ্রচারের জন্য প্রকাশ শুরু করার পর থেকেই আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পরামর্শ যে বিষয় নিয়ে লেখার জন্য পেয়েছি তা হচ্ছে ভ্রমণ শুরু করবেন কী করে তার উপরে আলোকপাত করতে। আর যে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি তা হচ্ছে - এই যে ভাই, এত এনার্জি, সময় আর টাকা আসে কোথা থেকে? অনেক সময়ই ভেবেছি কোন এক অবসরে গুছিয়ে লিখব এই নিয়ে, কিন্তু সেই অবসর আর মিলে না। ঘুরতে গেলে সেখানে ব্যস্ততা আরও বেশি! তাই এই চটজলদি বিরতির মাঝেই জলবৎ তরলং করে একান্ত নিজের মত করেই বলি ব্যাপারখানা—
অবশ্য অনেক ভ্রমণবিদের পথপ্রদর্শকগ্রন্থ বিখ্যাত পরিব্রাজক রাহুল স্যাংকৃত্যায়নের ভবঘুরে শাস্ত্র পড়ে দেখতে পারেন, আমিও পড়েছি অনেক আগ্রহ নিয়ে। সেখানে ভবঘুরের হতে হলে প্রথমে ইচ্ছা ব্যতীত কোন কিছুর প্রয়োজন নেই বলা হলেও পরে নানা অধ্যায়ে যে সমস্ত গুণাবলী আয়ত্তে আনার সুপরামর্শ দেওয়া হয়েছে (সেলাই, রান্না, গান, নাচ, ভাষা শিক্ষা, কায়িক পরিশ্রমে অভ্যস্ত হওয়া, যে কোন পেশাকে স্বাগত জানানো) সেগুলো যথার্থই পথচলার তাগিদে শেখা থাকা অতি অতি অত্যুত্তম। কিন্তু আমার মনে হলো আরে ভাই, এতই যদি সকল কাজের কাজী হব তাহলে আর ভবঘুরে হওয়া কেন? রাহুল অবশ্য খাইশুইঘুরফির টাইপের ভবঘুরের কথা বলেন নি, বলেছেন গৌতম বুদ্ধ, চার্লস ডারউইন, কলম্বাস ধরনের ভবঘুরের কথা, কিন্তু সেরকম হওয়া কি আর রাস্তায় বেরোলেই হয়! কাজেই দুনিয়া পরিবর্তনের আশাতে নয়, যুগের নায়ক হবার জন্যও নয়, কেবলই হয়ত নিজের উপভোগের জন্য কিভাবে ভ্রমণ করা যেতে পারে সেই নিয়ে একটুআধটু পাকনামি করি, চলুন মাঠে নামে যাক-
ভ্রমণের মূল কথা, এক্কেবারে প্রথম শর্ত এবং সূত্র- পথ চলার জন্য টান থাকতে হবে, সত্যিকারের ভালবাসার মত, পোড় খাওয়া সারেং-এর মনটা যেমন সমুদ্দুরে না ভাসলে খাঁ খাঁ করে, তেমনটা আপনারও করলে বুঝবেন খবর আছে, পৃথিবী ডাকছে। এখন ঝোলা (অধুনা ব্যাকপ্যাক) কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ার সময়।
কোথায় যাবেন, কেন যাবেন, কী দেখবেন?
এই উত্তর বের করতে হবে আপনার নিজেকেই। ছোটবেলায় এক মামা বলতেন ভাগ্নে- পৃথিবী এক আজব জায়গা- কেউ মদ বেঁচে দুধ খায়, আবার কেউ দুধ বেঁচে মদ খায়। কাজেই চাওয়াটা আপনার নিজের উপর। হতে পারে আপনি হিমালয় প্রেমিক- পৃথিবীর সব জায়গার চেয়ে ভুটানের কমলা বাগিচাময় উপত্যকা আর তিব্বতের গুম্ফা আপনাকে বেশি টানে। হতে পারে আপনি সারা জীবনে একবার হলেও লাগ ভেগাসে যেয়ে ক্যাসিনো খেলতে চান, হয়ত আমাজনের বৃষ্টি অরণ্য আপনাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে, অথবা মিউনিখের অক্টোবর ফেস্ট, আবার হয়ত জীবনে একটাই লক্ষ্য আছে আপনার- কোন এক চাঁদনী রাতে মানস সরোবরের পাশে বসে হেঁড়ে গলায় সঙ্গীত চর্চা করা।
মূল কথা ঘোরার উদ্দেশ্য নিজের কাছে। কেউ জাদুঘর পছন্দ করে, কেউ প্রকৃতি পছন্দ করে, কেউ পানশালা পছন্দ করে, কেউ অট্টালিকা পছন্দ করে, কেউ কেউ আবার সবই একসাথে পছন্দ করে। যে নেপালে সারা বিশ্ব থেকে মানুষ আসে হিমালয় দর্শনে সেই নেপালেই লাখ ট্যুরিস্ট যায় ক্যাসিনোর আকর্ষণে। কাঠমান্ডুতেই এক বন্ধুর সাথে একচোট হয়ে গিয়েছিল হলে যেয়ে সিনেমা দেখতে চাওয়ায়। বেচারার দোষ না, সে প্রেক্ষাগৃহে যেয়ে সিনেমা দেখতে চাইতেই পারে, কিন্তু তারচেয়ে নাগার্জুনের বনে যেয়ে পাখি দেখে আমার কাছে বেশি উপভোগ্য মনে হয়েছিল।
কাজেই কী দেখবেন এবং কেন দেখবেন সেটি আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
ভ্রমণস্থল সম্পর্কে জানবেন কী করে?
হ্যাঁ, এই বিষয়ে জীবনের প্রথম যখন বাংলাদেশের বাইরে গিয়েছিলাম (একা একা দিল্লী পর্যন্ত) তখন থেকেই আমার সাথী LONELY PLANET এর গাইড বই। বইটি একাধিকবার আসলেই জীবনরক্ষার মত তথ্য দিয়েছে বিদেশবিভূঁইতে, এখন বেশি তাড়াহুড়ো থাকলে অনেক সময় স্থানীয় গ্রন্থাগার থেকে লোনলি প্ল্যানেট, লেটস গো অথবা ডিসকভারি এমনকি ন্যাশনাল জিওগ্রাফির গাইডবুক পর্যন্ত এনে রাখি। পরে বিমানযাত্রার সময় চোখ বুলিয়ে মূল পরিকল্পনার খসড়া করে ফেলি। তবে অবশ্যই বইয়ের চাইতেও ভাল হয় যদি স্থানীয় কোন বন্ধু থাকে। স্থানীয় মানে সেই দেশের বা শহরের লোক বুঝিয়েছি, সেখানে বসবাসরত বাঙ্গালী নহে। বিদেশে বাংলাভাষী ভাই- বোনদের সাথে দেখা হলে অনেক ক্ষেত্রেই চোব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়র ব্যবস্থা হয়ে যাবে কিন্তু তারা ভ্রমণপ্রিয় না হলে, আপনার সাথে তাদের রুচি না মিললে কতখানি জায়গা তারা ঘুরিয়ে দেখাবে সেই বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়। আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, সারা জীবন তো বাঙ্গালী দেখেছেনই, অল্প কদিন না হয় বিদেশি মানুষদের সাথে মিশে সেই দেশের সংস্কৃতি-আচার- ব্যবহার সম্পর্কে জানলেন! তবে হ্যাঁ, যদি সেখানে আপনার বাল্যবন্ধু থাকে, বা এমন কেউ যার আশাতেই যাচ্ছেন সেই ক্ষেত্রে ব্যাপারটি আলাদা। সে আপনাকে এমন জায়গাতে নিয়ে যেতে পারে যার হদিশ অধিকাংশ গাইড বই পায় নি, কিংবা দিতে পারে অজানা কোন কাহিনীর পটভূমি।
অবশ্য এখন আবার নেটের যুগ চাইলেই Trip Advisorসহ বেশকিছু ওয়েব পেজ থেকে বৈকাল হ্রদ থেকে শুরু করে গ্যালোপাগোস দ্বীপ পর্যন্ত কোথায় গেলে কী মিলবে, কোন হোটেলের কী ভাল এবং কী মন্দ, কোন রেস্তোরাঁয় চায়ে চিনির বদলে লবণ দেয় সবই জেনে যাবেন। আর বাংলাদেশের ভিতরে ভ্রমণ করতে চাইলেও নানা জনপ্রিয় গন্তব্যে নিয়ে লিফলেট পাওয়া যায়, তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত কিংবা ঐতিহাসিক কিন্তু অজনপ্রিয় বা প্রায় অজানা জায়গাগুলো নিয়ে এমন রেডিমেড তথ্য খুবই অপ্রতুল। সেই ক্ষেত্রে উপায় একমাত্র রবি ঠাকুরকে ডাকা- যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে।
এখন একটা ব্যাপার- ভ্রমণ করবেন কার সাথে?
বছর কয়েক আগে পরিচিত এক ভাই বলেছিল চলেন সামনের ছুটিতে একসাথে কোথাও যাওয়া যাবে, কী বলেন? মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি বরাবরের মতই ভর করায় বলে ফেললাম সরাসরি- দেখেন ভাই, প্রিয় কবি শেখ সাদি বলেছেন- ভ্রমণের সঙ্গী যদি মনের সঙ্গী না হয় তবে সেই ভ্রমণ বিষবৎ! মানে আপনার পছন্দ-অপছন্দ- রুচি সম্পর্কে আমি জানি না কিছুই, রাস্তায় নামার পর খাবার সময় হলে আবিস্কার করলাম আপনি পাড় ইহুদী- শূকরের মাংস তো খানই না, পারলে যে দোকানে বিক্রি হয় সেখানের ছায়াও মাড়ান না, বা পাড় হিন্দু- দিলেন তো আবার কাবাব খাওয়ার মজা নষ্ট করে, কিংবা পাড় মুসলমান- হালাল না হলে আপনার চলে না, এখন ঘোর এই রোদের মাঝে কয়েক মাইল সেই পারফেক্ট খাবারের খোঁজে। দেখা গেল আপনি কট্টর নিরামিষভোজী আর আমি মাছের ঝোলের ভক্ত, আপনি যা খান তাতে আমার কোন সমস্যা নেই, কিন্তু আমি আপনার সামনে আপনার অপছন্দের জিনিস খেলে অসুবিধে- তাহলে কি আর আনন্দ মত ভ্রমণ করা যায়?
শুধু খাবারই নয়, দেখা গেল আমি রাতে বিশ্রামের সময় আলো জালিয়ে একটু টিনটিন পড়তে বা ব্লগ লিখতে পছন্দ করি, আর অমাবস্যার আঁধার ঘরের মাঝে না থাকলে আপনার ঘুম হয় না, আমার ঘুম ভীষণ পাতলা আর আপনার নাসিকা গর্জন কুম্ভকর্ণের মত- গেলে ভ্রমণের মজা উবে!
আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফিনিশ তরুণী নোরা হেলেনা, যতবারই বয়ফ্রেন্ডের সাথে দূরদেশে গেছে ততবারই তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে! কারণ হিসেবে নোরা বলেছে আসলে ভ্রমণে গেলেই সত্যিকার অর্থে মানুষে চেনা যায়, তুমি যদি এক ঘরেও থাক, তারপরেও বের হলে বুঝতে পারবে তোমাদের মধ্যকার সত্যিকারের মিল কতটুকু। বেচারির সাথে আমার বন্ধুত্ব এখন পর্যন্ত টিকে থাকার একমাত্র কারণ মনে হয় আমরা একসাথে এখন পর্যন্ত কোথাও ঘুরতে যাই নি! কিন্তু তার কথা যথেষ্ট গুরুত্ব দেবার মত, আমারই বাংলাভাষী এক রুমমেট, যার সাথে ডর্মের ৩ বছরের জীবনে কোনদিন দুই কথা হয় নি, সেই বেচারাকে ভ্রমণ শুরুর মাত্র তিন দিনের মাথায় বলে ফেললাম আর একসাথে কোনদিন ভ্রমণের পরিকল্পনা করা যাবে না!
কাজেই, ভ্রমণের সঙ্গী সেটা হোক এক বা একাধিক, নির্বাচন করুন অত্যধিক সতর্কতার সাথে, না হলে কিন্তু গেল সবকিছু কেঁচে!
শারীরিক সক্ষমতা ভ্রমণের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ, ব্রুস লীর মত পাকানো দড়ি হবার দরকার নেই বা র্যাম্বোর মত পেশীমানব, কিন্তু যে জায়গায় যাচ্ছেন তা ভাল মত দেখে ফিরে আসার মত সক্ষমতা যেন আপনার অবশ্যই থাকে। যদি বান্দরবানে হাইকিঙে যান বা নেপালের অন্নপূর্ণা সার্কিটে- অবশ্যই নিজেকে প্রস্তত করবেন কয়েক সপ্তাহ ধরে হেঁটে, বা দৌড়ে বা সাইকেল চালিয়ে কোন একটা উপায়ে নিজেকে ফিট রাখবার। দেখা গেল কোন শহর ভ্রমণেই গেছেন- কুমিল্লার শালবন বিহার, প্যারিস, রোম, বেইজিং- হাঁটতে হবেই, পায়ে বা লাঠির উপরে ভর দিয়ে। মানে মানেই তার জন্য প্রস্তত থাকুন যাত্রা শুরুর আগেই।
আর ঝোলা মানে ব্যাকপ্যাক তৈরি রাখুন গন্তব্য অনুযায়ী, যেখানে যাবেন, সেই হিসেবে ব্যাগ তৈরি হবে। যাচ্ছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে হাইকিঙয়ে- অবশ্যই সুঁইসুতো নেবেন( যদি কাপড় ছিঁড়ে যায়), লবণ অপরিহার্য (ছড়া পেরোনোর সময় যদি জোঁক ধরে), অল্প কিছু ঔষধপত্র বিশেষ করে জ্বরের এবং সেই সাথে স্যালাইন, পৈটিক গোলযোগ দেখা দিক বা না দিক, সারা দিন ঘামার পরে বিশ্রামের সময় স্যালাইন নেহাত খারাপ জিনিস নহে। গামছা নিবেন, তোয়ালে নিবেন, কাপড় নিবেন প্রয়োজন মত, মানে দরকারের অতিরিক্ত নিলে বহন করতে হবে আপনাকেই। ও আচ্ছা, আপনি ফাঁকা ব্যাগ নিয়ে গেছেন সেখানের বাহারি পোশাক কিনে ব্যাগ ভর্তি করে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য, দুঃখিত- এই ব্যাপারে ভাল জ্ঞান রাখি না! দরকার মনে হলে অবশ্যই অবশ্যই টয়লেট পেপার নেবেন, আর পানির বোতল। যুক্তরাজ্য নামে ভূখণ্ডে যাবেন, আর কিছু না হলেও আধ ডজন ছাতা নিয়ে যাবেন অবশ্যই!
যেখানে যাবেন সেখানের আবহাওয়া অনুযায়ী পোশাক বাছাই করা আপনার দায়িত্ব, ঠাণ্ডা, গরম, বৃষ্টিময় যেখানেই যান না কেন। সেই সাথে ভিসা নামের ইহজগতের পুলসিরাতের ব্যবস্থা কিন্তু করে নিতে হবে নিজেকেই, এই নিয়ে কথা না আর বাড়াই।
বিদেশে গেলে সব হারান, নিজেকেও হারান- কিন্তু পাসপোর্ট আর টাকা হারাবেন না, টাকা যদি হারানও ভাগ্যচক্রে তাহলে দয়া করে সব একসাথে হারাবেন না, তাহলে ঘোর বিপদ!
নিরাপত্তা অবশ্যই একটা বিশাল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রতি শহরেই কিছু ঝামেলার এলাকা থাকে, সেগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন, আর গেলেও সতর্ক থাকুন। সাথে থাকা টাকা ভাগ করে কয়েক জায়গায় রাখুন যাতে সব একসাথে খোয়া না যায়। বাংলাদেশে একা বা কয়েকজন মিলে কোন এলাকা বেড়াতে গেলে অবশ্যই ভালো মত খোঁজখবর নিয়ে যেয়েন। এই বিষয়ে নিজে যা জানতাম তার অনেকখানিই পরিবর্তন হয়ে গেছে বিগত এক দশকে, তাই এই নিয়ে আপাতত বেশী আলোকপাত করতে পারছি না।
ভ্রমণের সময় অবশ্যই খেয়াল রাখবেন যে শতকরা ১০০ ভাগ সফল কোন পরিকল্পনাই সাধারণত হয় না, এবং তা এত নিখুঁত হবার প্রয়োজনও নেই, অবশ্য বুঝে কিছুটা ছাড় দিতেই হবে- এসি বাস না হলে বাদুড়ঝোলা বাসে গেলেনই না হয় একদিন। না হয় ভিনদেশের কোন বাস টার্মিনালের বেঞ্চিতে কফির মগ নিয়ে কেটেই গেল একটা নির্ঘুম রাত- যেহেতু বাস মিস হয়ে গেছে, এক বন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তার সেবা করতে যেয়ে না হয় একটা দিন ঘোরা বন্ধই থাকল, এগুলো মিলেই জীবন এবং ভ্রমণ।
সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো মোটামুটি শেষ, এখন শেষ কথা- অর্থ সমাগম। হুম, এই বিষয়ে কথা বলার আগেই বন্ধুরা রীতিমত হুংকার দিয়ে বলছে- আগন্তক সিনেমাটি দেখে ভ্রমণের টাকা কিভাবে জোগাড় করা যায় তা জানা যাবে- এই ধরনের উচ্চমার্গীয় কথা বলা যাবে না! কাজেই বলছি- অর্থ আপনার পকেটেই আছে, সে আপনি ছাত্র হোন বা চাকরিজীবী কিন্তু মূল ব্যাপারটি হচ্ছে আপনি ভ্রমণের জন্য কত টাকা প্রতি মাসে বা বছরের আলাদা করে বাঁচিয়ে জমা করতে পারছেন। সেইখান থেকেও কিন্তু বোঝা যায় যে ভ্রমণের জন্য আপনি কতখানি ছাড় দিতে প্রস্তত।
দেখা গেল আপনি ছাত্র মানুষ, প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের খরচ জোগাড়তো করেনই, মাঝে মাঝেই বাবা-মা কেও সাহায্য করতে হয়, এখন অর্থ সমাগম ঘটবে কিভাবে? পথটি সহজ নয় হয়ত, কিন্তু অসম্ভব বলে কিছুই নেই- হয়ত আপনার সিগারেটের খরচ কমালে সেটা থেকে বছরে একটা ছোট ভ্রমণ হয়ে যেতেও পারে, হয়ত কোন কেনাকাটার শখকে বলি দিয়ে সেটাকে আগামী শীতের উত্তরবঙ্গকে দেখার জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে। হয়ত রকি পর্বত বা পলিনেশিয়া আমাদের জন্য এক চাঁদ দূরত্বেই অবস্থান করে, কিন্তু সেখানে যেতে না পারলেও আমরা যেন দেশের আশেপাশেই বিশেষ করে দেশের মাঝেই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ভ্রমণ অব্যাহত রাখি।
এই নিয়ে আমার ভ্রমণগুরু ইনাম আল হকের একটা কথা আগেও বলেছি, কথাটা এতই খাঁটি যে আরেকবার বললাম- বিবিসি থেকে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার যেহেতু বর্তমানে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আছে সেই কারণেই আপনি এই ধরনের কাজ যেমন ভ্রমণ, পাখি দেখা, ছবি তোলা, পাহাড়ে চড়া এইগুলি করতে পারেন?
ইনাম ভাইয়ের উত্তর – দেখুন ঘোরাঘুরি তো আমি আজকে করছি না, যখন আমি ছাত্র ছিলাম, নিজস্ব সঞ্চয় ছিল না তখন থেকেই করছি। এখন বিমানে চেপে অনেক দূরে যাই, কিন্তু তখনো সুযোগ পেলেই পায়ে হেঁটে, বাসে, নৌকায়, ভ্যানে চেপে দূরের শহর, গ্রামে যেতাম। তখনো পাখি দেখতাম, কিন্তু দূরবীন, টেলিস্কোপ ছাড়াই, আনন্দটা কিন্তু পেতাম পুরোদমেই! আমাদের সমাজের অধিকাংশই মানুষকেই প্রশ্ন করুন জীবনের চাহিদা নিয়ে- সবাই বলবে চাকরি, বাড়ি, গাড়ি, সংসার। কিন্তু কয়জন বলবে, বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা আমার ঘোরা থাকতে হবে, পায়ে হেঁটে হলেও! কজন ভাবে বান্দরবানের পাহাড়গুলো আমার চড়া থাকতেই হবে! টেঁকনাফ থেকে তেতুলিয়ার সৌন্দর্য একবার হলেও দেখতেই হবে?
ইনাম ভাই অনেক আগে আমাকে বলেছিলেন পৃথিবীর অধিকাংশই মানুষই কিন্তু ঘুরলেই সন্তুষ্ট হন না, সেই ঘোরা যখন অন্য মানুষ জানে তখনই তাদের ভ্রমণ যেন ষোল আলা সার্থক হয়। মানে আপনি লন্ডন গেলেই হবে না, ফিরে এসে সবাইকে বলবেন- ব্যাটা জানিস লন্ডন গেছিলাম, তার পরেই যেন ভ্রমণের সবকিছু উসুল হলো! কিন্তু এই বাঁধা অতিক্রম করতে হবে আপনাকে, আপনি দেখবেন, ঘুরবেন কেবল জানার আনন্দে, ভাল লাগার আবেশে। যদি সেই ভ্রমণ নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে হয়, ছবি প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে অবশ্যই করুন, কিন্তু সেটা যেন আপনার ভ্রমণের ইচ্ছেকে ছাপিয়ে না যায়। আমার থেকে থেকেই মনে হয় যদি ইস্টার দ্বীপে যেতে পারতাম, কিংবা মালির টিম্বাকটু, তিব্বতের মানস সরোবর- আর কেউ না জানলেও বিশ্বের সুখীতম মানুষটি আমি হয়ে যেতাম আপনা থেকেই।
মোদ্দা কথা- অনিশ্চয়তা নিয়ে বেশি ভাববেন না, পথে নামুন, ভ্রমণের আনন্দে ভ্রমণ করুন। কিছু পেতে হলে কিছু হারাতেই হয় জীবনে। জীবন হোক ভ্রমণ এবং ভ্রমণের স্মৃতিময়।
(আজ বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত)