ঢাকাবাসীকে ভয়, ভক্তি আর রোমাঞ্চের অনুভূতি এনে দিয়েছিল যে দুটি কামান
একসময় ঢাকার পর্যটকদের আকর্ষণ লালবাগ দূর্গ বা বড় কাটরা নয়, ছিল মোগল যুগের একটি কামান। ১৭৭৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে এসেছিলেন রবার্ট লিন্ডস। তিনি লিখেছিলেন, 'ঢাকায় গর্ব করার মতো তেমন কিছু নেই। লালবাগ দূর্গ, বড় কাটরা, তাঁতিবাজার আর টঙ্গীর পুল কিছুই তাকে আকৃষ্ট করেনি। শুধু একটি জিনিসই করেছে। তা হলো, ঢাকার একটি কামান।'
মুনতাসীর মামুনের রচনাবলি ২য় খন্ড বইয়ের 'ঢাকার হারিয়ে যাওয়া কামান' শিরোনামের একটি অধ্যায়ে পাওয়া যায় এই বর্ণনা।
কোথা থেকে এলো এই কামান
এত বিশাল ও ওজনে ভারি জিনিস জলপথে হাজার মাইল দূর থেকে আনা প্রায় অসম্ভব।
১৭ শতকের গোড়ার দিকে মোগল বাদশাহ সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থাপন করলে, এখানে গড়ে ওঠে নানা প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। সে সঙ্গে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে জলদস্যুদের উপদ্রবও। বিভিন্ন বই-পুস্তকে সেসময়কার জলদস্যুদের কথা উঠে এসেছে।
ঢাকার চারপাশ ঘিরে কয়েকটি নদী থাকায়, জলদস্যুরা সে পথ দিয়েই আসতো। বিশেষত মগ, পর্তুগিজ ও আরাকানি জলদস্যুদের উপদ্রব বেড়ে গিয়েছিল অনেক। তাই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করতে ঢাকায় বেশ কিছু কামান তৈরি করা হয়। এর মধ্যে দুটি কামান ছিল সুবিখ্যাত। মোগল নির্মাণশৈলীতে, বিশালত্বে ও সৌন্দর্যে এগুলো ছিল বিশ্বমানের কামান।
কামান দুটির একটির নাম কালে খাঁ জমজম ও অপরটির নাম বিবি মরিয়ম। ধারণা করা হয়, কালে খাঁ নামক কোনো বীর এবং তার স্ত্রীর নামে এই নামকরণ করা হয়েছিল। তবে কেউ কেউ দাবি করেছে, মীর জুমলাই এই কামানদুটির নাম রেখেছেন।
ব্রিটিশ রাজকর্মচারী ও পর্যটকেরা কালে খাঁ-কে দেখেই সবচেয়ে বেশি অবাক হতেন এবং এর বৃত্তান্ত লিখে রেখে যান। বিখ্যাত ভূগোলবিদ জেমস রেনেল তার স্মৃতিকথায় ঢাকার ঐ কামানের কথাই বিস্তারিতভাবে লিখে গেছেন। পরিমাপের দিক থেকে কালে খাঁ জমজমকে তিনি তুলনামূলক বেশি জমকালো এবং বিশাল হিসেবে আখ্যায়িত করে গেছেন।
নদী থেকে শোনা যেত গর্জন!
মীর জুমলা আসাম যুদ্ধে এই দুটি কামান ব্যবহার করেছিলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৬০ সালে মীর জুমলাকে বাংলার সুবেদার নিয়োগ করেন। মীর জুমলা ১৬৬১ সালে আসাম অভিযানের সময় ৬৭৫টি ভারী কামান ব্যবহার করেন। তার মধ্যে বিবি মরিয়ম ছিল সর্ববৃহৎ। যুদ্ধশেষে বিজয়ী হয়ে তিনি বিবি মরিয়মকে বড় কাটরার দক্ষিণে সোয়ারীঘাটে স্থাপন করেন। মীর জুমলার সময় বড় কাটরা ছিল ঢাকার বৈশিষ্ট্যময় একমাত্র জাঁকালো অট্টালিকা!
সৈয়দ মোহাম্মদ তাইফুর তার 'গ্লিম্পস অব ঢাকা' বইয়ে বলেন, সুবাদার মীর জুমলা কামানটিকে আসাম অভিযানের সময় ব্যবহার করেছিলেন এবং তারপর তা আবার ফিরিয়ে এনেছিলেন ঢাকায়। হতে পারে, আসাম অভিযানের পর তিনি এটিকে কাটরার সামনে স্থাপন করেছিলেন যুদ্ধ জয়ের স্বারক বা দ্রষ্টব্য হিসেবে।
তখন থেকে কামানটি 'মীর জুমলার কামান' নামে পরিচিত লাভ করে। বুড়িগঙ্গার মোগরাই চরে রাখা হয় কালে খাঁ জমজমকে। পরবর্তীতে নদীভাঙ্গনে বুড়িগঙ্গায় বিসর্জিত হয় কালে খাঁ জমজম।
রবার্ট লিন্ডস ১৭৮০ সালের নদীভাঙ্গনে কালে খাঁ জমজমের ক্ষতির জন্য কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করে গেছেন। কিন্তু স্থানীয়দের কাছে তা এতটাই পূজনীয় ও আধ্যাত্মিক ছিল যে তারা মনে করতেন, স্বর্গ থেকে এটি এসেছিল, আবার স্বর্গেই তা ফিরে গেছে!
এমনকি তাদের এই কুসংস্কারের তীব্রতা বোঝা যায় নিচের ঘটনাটি পড়লে। মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, বুড়িগঙ্গায় কালে খাঁ জমজম ডুবে যাওয়ার পর লোকমুখে কুসংস্কার বেরিয়েছিল যে, নদী থেকে বিবি মরিয়মের (পরবর্তীতে মীর জুমলা নামকরণ) জন্য বুড়িগঙ্গা থেকে প্রায়ই গর্জন ভেসে আসতো। তারা বিশ্বাস করতেন, এ গর্জনের অর্থ হলো, 'কালে খাঁ' তার সঙ্গিনী 'মরিয়ম'কে ডাকছে। এবং তারা হলফ করে বলতেন, যে ঐ গুরুগম্ভীর আওয়াজ তারা শুনেছেন!
এতবছরেও মরিচা ধরেনি কামানে
কালে খাঁ জমজম ও বিবি মরিয়মের নকশা তৈরি এবং নির্মাণকাজ তদারকি করেন মোগল কামান নির্মাতারা। এ কামান দুটি প্রমাণ করে তখনকার ঢাকার কামান তৈরির কারিগরদের দক্ষতা। মোগল আমলে ঢাকায় উন্নতমানের কামান তৈরির বহু কারিগর ছিলেন। তখন ঢাকায় এ কামান শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল।
মজবুত ও টেকসই কামান তৈরিতে তারা ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সুবেদার ও জমিদারেরা ফরমায়েশ দিয়ে এসব কারিগর দিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় কামান তৈরি করিয়ে নিতেন। বর্তমানে মুর্শিদাবাদে যে বিশাল কামানটি দেখা যায়, নবাব আলীবর্দী খান ঢাকায় কামান তৈরির কারিগর জনার্ধন কর্মকারকে দিয়ে তা তৈরি করিয়ে নেন।
একটা সময় পর্যন্ত কিন্তু 'কালে খাঁ জমজম' ই বিখ্যাত ছিল সবার কাছে। রেনেল এবং লিন্ডসের বিবরণ থেকে তা-ই ধারণা করা হয়। কারণ তারা দুজনেই কালে খাঁ-র কথা বলেছেন শুধু। 'মরিয়ম'-এর কোনো উল্লেখ নেই সেখানে। তাতে বোঝা যায়, কালে খাঁ-র তুলনায় মরিয়ম ছিল অনুল্লেখ্য।
পূজনীয় হয়ে উঠেছিল এই কামান
মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, লিন্ডসের বিবরণ থেকে বোঝা যায়, দেশীয়দের মনেও এটি বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল। লিন্ডসের মতে, স্থানীয়রা মনে করতেন স্বর্গ থেকে এটি পতিত হয়েছে। এ কারণে কামানটি ছিল পূজিত। হিন্দু রমণীরা এসে কামানটির মুখে দুধ ঢালতেন, ফুল দিতেন এবং সিঁদুরের ফোঁটা দিতেন। শুধু তা-ই নয়, আবহমানকাল থেকে এর ভেতরে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হতো। ১৭৮০ সালের আগ পর্যন্ত এই কামানটি 'পবিত্র স্থান' হিসেবেই স্থানীয়দের কাছে মর্যাদা পেত।
কামান দুটির সঙ্গে স্থানীয়দের ছিল এক আধ্যাত্মিক বন্ধন
বিবি মরিয়মের দৈর্ঘ্য ১১ ফুট। মুখের ব্যাস ছয় ইঞ্চি। কামানে ব্যবহৃত গোলার ওজন পাঁচ থেকে ছয় মণ। অপরদিকে 'কালে খাঁ জমজম' এর দৈর্ঘ্য ২২ বা ৩৬ ফুটের মতো। ছিল এতটাই ভারি যে, শক্তিশালী একজন লোক খুব বেশি হলে হাঁটু পর্যন্ত ওঠাতে পারবে! অত্যন্ত শক্ত ও পেটানো লোহা দিয়ে কামানটি তৈরি করা হয়েছে বলে এত বছরেও মরিচা ধরেনি। সুতরাং দুটির মধ্যে তুলনামূলক কালে খাঁ জমজমই প্রকান্ড ছিল বেশি। তাই সকলের নজর কাড়তো বেশি।
কিন্তু বৈপরীত্য দেখা যায় পরে। কালে খাঁ বুড়িগঙ্গা নদীতে তলিয়ে গেলে বিবি মরিয়ম হয়ে ওঠে দর্শনীয় বস্তু।
কালে খাঁর মতো 'মীর জুমলা'ও একই ভাগ্যবরণ করতে যাচ্ছিল মোগল শাসকদের পতনের পর। ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়ালটার্স ১৮৪০ সালে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কামানটিকে কাদাপানি থেকে উদ্ধার করে চকবাজারের উত্তরে একটি বেদির ওপর স্থাপন করেন।
তখন চকবাজার ছিল ঢাকার সবচেয়ে সুন্দর স্থান। কামানটি চকবাজারে এনে রাখার পর তা দর্শনীয় হয়ে ওঠে। নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে সব বয়সী মানুষ এ কামান দেখার জন্য ভিড় করতে শুরু করে। কালে খাঁ-র মতো মরিয়মও তখন পূজনীয় হয়ে উঠতে থাকে! এর শরীর ও বেদি দুধ, সিঁদুরের চর্চিত এবং ফুলে ফুলে শোভিত থাকতো।
কামানের মুখের ভিতরে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে যেত শিশুরা!
এরপর চকবাজার ঘিঞ্জি এলাকায় পরিণত হলে ১৯২৫ সালে ঢাকার জাদুঘরের কিউরেটর নলিনীকান্ত ভট্টশালী কামানটিকে চকবাজার থেকে এনে সদরঘাটে স্থাপন করেন। তখন সদরঘাট ছিল ঢাকার সবচেয়ে মনোরম স্থান। এখানে এনে রাখার পর কামানটি আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
সৈয়দ মোহাম্মদ তাইফুর তার 'গ্লিম্পস অব ঢাকা' বইয়ে উল্লেখ করেছেন, শিশুরা এই কামান দেখতে এসে প্রায়ই সময় কামানের মুখের ভিতরে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে যেত এবং তাদের সেখান থেকে বের করা প্রায়শই বেশ কঠিন হয়ে পড়তো। তাই ইংরেজ আমলেই কামানটির মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়
এই কামানের সামনে দাঁড়িয়েই অগ্নিঝরা ভাষণ দেন মতিয়া চৌধুরী
সেই মোগল আমল থেকে শুরু করে আরও অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে এই কামান। দেশভাগের পর, মীর জুমলা কামানকে সদরঘাট থেকে এনে তৎকালীন জিন্নাহ এভিনিউয়ে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) অবস্থিত গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে রাখা হয়।
তখন গুলিস্তান ছিল ঢাকার কেন্দ্রস্থল এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান। এখানে এনে রাখার পর কামানটি 'গুলিস্তানের কামান' নামে পরিচিতি লাভ করে। তখন এই কামান দেখতে অনেকেই গুলিস্তান আসতো। মতিয়া চৌধুরী '৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় এই কামানের সামনে দাঁড়িয়েই অগ্নিঝরা ভাষণ দেন।
৪০০ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে মলিন হয়ে আছে এই কামান
১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের সময় মীর জুমলাকে গুলিস্তানের মোড় থেকে উঠিয়ে এনে ওসমানী উদ্যানের প্রধান ফটকের পেছনে স্থাপন করা হয়। আর তখন থেকেই এ কামান লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে।
'বিবি মরিয়ম'- ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সুবৃহৎ ও আকর্ষণীয় এ কামানটির নাম হয়তো এখন অনেকেরই মনে নেই। অথচ এককালে এ কামানটি ছিল বড় বিস্ময়।
ঢাকার চারশ বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ কামানটির নাম। এ কামানের সঙ্গে আরও জড়িয়ে আছে সুবেদার মীর জুমলার নাম আর সেকালের ঢাকার কামান তৈরির কারিগরদের দক্ষতা। ওই সময় কামানটি ছিল ঢাকাবাসীর গর্বের ধন। তখন এ কামানকে ঘিরে নগরবাসীর আবেগ, উচ্ছ্বাস ও আকাঙ্ক্ষার অন্ত ছিলো না।
কালে খাঁ জমজম আর বিবি মরিয়ম যেন অবিচ্ছেদ্য দুটি নাম। 'কালে খাঁ' তো নেই। বিবি মরিয়ম থেকেও মানুষের মাঝে নেই। দেশবাসী তো বটেই, ঢাকাবাসীও কামানটিকে আজ ভুলতে বসেছে। কিন্তু পুরোনো মানুষদের কাছে 'মরিয়ম' আর 'কালে খাঁ জমজম' হলো দুই সঙ্গীর নাম, যাদের সাথে জড়িত ছিল তাদের জীবন, বিশ্বাস। ছিল ভয়, ভক্তি আর রোমাঞ্চের এক সেতু...।