ওসাইরিস গিটারস: দেশি গিটারের আশ্চর্য এক জগত
'ছোটবেলা থেকেই গ্রীক পুরাণ, মিশরীয় পুরাণের প্রতি আমার অনেক আগ্রহ ছিলো। মিশরীয় পুরাণের মধ্যে একটি চরিত্র ছিলো ওসাইরিস। 'জাজ অফ দ্যা ডেড অ্যান্ড আন্ডারওয়ার্ল্ড' ছিলেন তিনি। ওসাইরিস ভীষণ শক্তিশালী ছিলেন; আমরা আমাদের গিটারকেও সেই জায়গাতে দেখতে চাই। তাই আমরা নাম দিয়েছি ওসাইরিস গিটারস', বলছিলেন বাংলাদেশের প্রথম ইলেকট্রিক গিটার তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান 'ওসাইরিস' এর প্রতিষ্ঠাতা মাহবুব আলম সিয়াম ওরফে সিয়াম মাহবুব।
কোনো কাপড়ের গায়ে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' লেখা দেখলে আমরা ভীষণ গদগদ হয়ে যাই, তাই না? ভীষণ গর্ববোধ হয় আমাদের, নিজেদের পণ্য বা দেশের তৈরি পণ্য নিয়ে বিপুল আহ্লাদও প্রকাশ করে ফেলি অনেক সময়। এই আহ্লাদিত হয়ে যাওয়া অবশ্য দোষের কিছু না। অন্ততপক্ষে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার কিংবা ঐতিহ্যরক্ষার সাপেক্ষেই কাজ করে। এবার শুধু পোশাক নয়, মেইড ইন বাংলাদেশের তালিকায় যুক্ত হয়েছে দেশেই ইলেকট্রিক গিটার তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান 'ওসাইরিস গিটারস'।
যাত্রা শুরুর গল্প...
ছোটবেলা থেকেই গিটারের প্রতি আগ্রহ ছিলো ওসাইরিসের স্বত্বাধিকারী সিয়াম মাহবুবের। একসময় গিটার বাজানোও শিখেছিলেন, খুলেছিলেন 'অ্যান্ড উই' নামের ব্যান্ড। অতিরিক্ত দক্ষতা হিসেবে গিটার বাজানোর পাশাপাশি শিখে রেখেছিলেন গিটার সারানোর খুঁটিনাটি কাজ।
পরিবারের সমর্থন থাকলেও শৈশব থেকেই সিয়াম ছিলেন আত্মনির্ভরশীল। টিউশন করার পাশাপাশি ছবি আঁকা, কারুকাজ করার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ জমিয়ে রাখতেন। ২০১১ সালের দিকে আগের জমানো অর্থ এবং বাবার থেকে কিছু টাকা নিয়ে কিনেছিলেন প্রথম গিটার। গিটার কেনার পর নিজের ব্যান্ডের পাশাপাশি, অন্যান্য কিছু ব্যান্ডেও গিটারিস্ট হিসেবে বাজাতেন। তবে তিনি যে নিজেই গিটার তৈরি করবেন বা ব্যবসা করবেন এমন ভাবনা প্রথম থেকে ছিলো না। পারিবারিক কিছু সমস্যার কারণে নিজের পাশে এবং পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সিদ্ধান্ত নেন ব্যবসা শুরু করার।
গিটারিস্ট হিসেবে যা উপার্জন করতেন তা দিয়ে ব্যবসা শুরুর মতো অবস্থা ছিল না। তার ওপর স্কুল জীবন থেকে শুরু হওয়া 'অ্যান্ড উই' ব্যান্ডও ২০১৪ সালে ভেঙ্গে যায়। এ পর্যায়ে সিয়াম ঠিক করলেন তিনি যা যা শিখেছেন তা দিয়ে নিজেই কাহন ও গিটার বানাবেন। প্রথম যাত্রায় কাহন বানাতে সফল হলেও আটকে যান গিটার বানাতে গিয়ে; সফল হওয়ার পরিবর্তে উল্টো ব্যর্থ হলেন। এই ব্যর্থতা দিয়েই শুরু হলো গিটার তৈরির অভিমুখের যাত্রা।
ওসাইরিসের উত্থান
সঙ্গীতের পেছনে অনেকটা অর্থ ও সময় পার করার পরেও যখন দেখলেন তেমন সাড়া পাচ্ছেন না, তখন ভাণ্ডারে থাকা সকল গিটার সিয়াম বিক্রি করে দেন। পরিকল্পনা করেন বিক্রির অর্থ দিয়ে নিজেই ব্যবসা শুরু করার।
বেশ ভেবেচিন্তেই 'ব্লুজ ডেন' এর নামে ২০১৫ সালে ব্যবসা শুরু করেন সিয়াম। দেশেই সঙ্গীতের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি হবে- এমন লক্ষ্যেই আবির্ভাব হয় ব্লুজ ডেনের। ব্লুজ ডেনের মধ্যেই কাহনের জন্য 'বিডি কাহন' ও গিটার মেরামতের জন্য 'গিটার কেয়ার' নামে দুটি ভিন্ন উদ্যোগ শুরু করেন সিয়াম। ব্লুজ ডেনের অধীনে ২০১৯ সালের দিকে ইলেকট্রিক গিটার তৈরির জন্য শুরু হয় ওসাইরিস গিটারস।
গিটার বিক্রির প্রাপ্ত ৫০ হাজার টাকার মধ্যে কিছু টাকা দিয়ে সিয়াম ডেস্কটপ কম্পিউটার কেনেন এবং ১৫ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেন গিটারের ওয়ার্কশপ বা কারখানার কাজ। এটিই ছিলো তাদের ব্যবসায় শুরু করার প্রাথমিক পুঁজি। পরবর্তী সময়ে তাদের যা আয় হতো, সেটিকেই পুনরায় বিনিয়োগ করতেন তারা।
২০১৫ সালের দিকে মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের একটি বাসাকেই সিয়াম স্টুডিও হিসেবে ব্যবহার করতেন এবং থাকতেন। সেখানে রুমের একপাশে ঘুমাতেন আর আরেকপাশকে ওয়ার্কশপ হিসেবে ব্যবহার করতেন। এরপর ২০১৭ সালে কারখানা স্থানান্তর করা হয় ঢাকা উদ্যানে। করোনা মহামারির সময়কার লকডাউনের পরে ঢাকা উদ্যানের কারখানা ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন থেকে দ্রুত বেগে উড়তে শুরু করে ওসাইরিস গিটার। বর্তমানে তাজমহল রোডের বাসাটি ওসাইরিসের রিপেয়ার শপ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্রথম গিটারের উপাদান ঘরে থাকা সামগ্রী
গিটার তৈরির জগতে পা রাখতে সিয়ামকে নিতে হয়েছিলো অনেকটা সময়। ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিন বছর পরিপূর্ণভাবে কাজ শেখার জন্য সময় নেন। এসময় চলতে থাকে গিটারকেন্দ্রিক পড়াশোনা, দেখতে থাকেন গিটার তৈরির নানা রকম ভিডিও, পড়তে শুরু করেন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বই। এর পাশাপাশি তিনি চালিয়ে যেতে থাকেন চর্চার কাজ।
গিটারকে কেন্দ্র করে পড়াশোনার কাজ শুরু করার পর দেশের বাজার নিয়েও অধ্যয়ন চালিয়ে যান তিনি। সিয়াম জানান, 'দেশের বাজার নিয়ে যখন গবেষণা শুরু করি, তখন আমি দেখলাম বাজারে কিছু পাওয়া যায় না। দেশের বাজার যখন পুরো শূন্য, তখন আমি নিজেই যন্ত্রের বিভিন্ন অংশ তৈরির কাজ শুরু করি। দেশে ভালোমানের স্যান্ডপেপার পাওয়াটা বেশ মুশকিল, তখন বাসায় ছুরি ধার করার পাথরকে আমরা স্যান্ডপেপার হিসেবে ব্যবহার করতাম। বাসায় থাকা ছুরিকে প্রক্রিয়াজাত করে ফাইল করার জন্য ব্যবহার করতাম।'
'আমরা এখন একটি বিশেষায়িত সাবান ব্যবহার করি গিটারের টপ কিংবা ফিনিশিং পরিষ্কার করার জন্য। তখন এমন কিছুই ছিলো না, আমার মামা সেসময় বিদেশ থেকে একটা সাবান নিয়ে আসে। উপাদান তালিকা মিলিয়ে দেখি দুটি সাবান প্রায় একইরকম, সেটা দিয়েই কাজ শুরু করি তখন,' বলছিলেন তিনি।
গিটার তৈরিতে দরকার হয় যেসব অনুষঙ্গ
ইলেকট্রিক গিটার তৈরিতে প্রথমত কাঠের প্রয়োজন হয়। তবে সব রকমের কাঠ দিয়ে ইলেকট্রিক গিটার তৈরি করা যায় না, বিশেষায়িত কাঠ প্রয়োজন হয়। তবে আশার কথা হচ্ছে, একটু খুঁজলেই বাংলাদেশে ইলেকট্রিক গিটার তৈরির বিশেষ ধরনের কাঠ পাওয়া যায়। কাঠ ছাড়াও প্রয়োজন হয় মাপ অনুযায়ী কাঠ কাটার যন্ত্র। এরপর শুরু হয় গিটারের বডি ও নেক অংশের কাজ। বডির অংশের জন্য প্রথমে রাউট, তারপর স্যান্ড করতে হয়।
নেক অংশে কাঠ ঠিকঠাক বসে যাওয়ার পর নেকের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন হয় ট্রাস রডের। এরপর বসে ফ্রেট বোর্ড, ফ্রেট বোর্ডের উপরে বসে ফ্রেট ওয়্যার আর নেকের মাথায় বসে টিউন করার কিট। বডি অংশে বসে পিকাপ, যার মাধ্যমে আওয়াজ বের করা যায়। এরপর তার ঠিকঠাক বসানোর জন্য ব্রিজের প্রয়োজন হয়। পিকাপকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভলিউম, টোন, সিলেক্টর সুইচ প্রয়োজন হয় এবং সবশেষে আউটপুট জ্যাক লাগে।
গিটারের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী তারা মূলত চায়না, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকেই আমদানি করে। একসাথে অনেককিছু আনার কারণে তাদের ভাণ্ডারেই সবকিছু মজুত থাকে।
কাস্টম অর্ডারের জন্য তারা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সামগ্রী তারা নিয়ে আসেন বিদেশ থেকে। বর্তমানে পশ্চিমা যন্ত্র হিসেবে গিটার, ল্যাটিন আমেরিকার পারকাশন যন্ত্র হিসেবে কাহন এখন তাদের ভাণ্ডারে পাওয়া যাবে।
বর্তমানে সিয়াম সহ ওসাইরিসে কাজ করছেন তিনজন। একেকটি গিটার তৈরিতে কত সময় লাগে জানতে চাইলে ওসাইরিসের স্বত্বাধিকারী জানান, 'যদি একজন কাজ করে তাহলে কাস্টমাইজড গিটার তৈরিতে ২ থেকে ৩ মাসের মতো সময় লাগে। রেগুলার ভিত্তিতে গিটার তৈরি করতে সময় লাগে ২ সপ্তাহের মতো'।
সিগনেচার গিটার
ইলেকট্রিক গিটারের ক্ষেত্রে ওসাইরিস শুরু করতে যাচ্ছে সিগনেচার গিটার সিরিজ। এখন পর্যন্ত ওয়ারফেজের গিটারিস্ট ইব্রাহিম আহমেদ কমলের সিগনেচারে তারা গিটার তৈরির কাজ করেছে। বছরের শেষে তা বাজারে নিয়ে আসার ইচ্ছে আছে ওসাইরিসের। এছাড়াও বে অব বেঙ্গলের বখতিয়ার হোসেনের সিগনেচার নিয়েও কাজ চলছে তাদের। এছাড়াও নাভিদ ইমতিয়াজ চৌধুরি, গোলাম রাব্বানি শিশির, সামির হাফিজ সহ আরো কয়েকজন গিটারিস্টের জন্য ওসাইরিসের গিটার প্রস্তুত করা হয়েছে।
তবে গ্রাহকদের বিশ্বাসের তালিকায় যে তারা প্রথম স্থানে আছেন সেটাও গ্রাহকেরাই প্রতি মুহূর্তে তাদের বুঝিয়ে দেন। তাই ক্রেতার পুনরাবৃত্তিও ঘটে। বর্তমানে গিটার কেয়ার অর্থাৎ রিপেয়ারিং শপ থেকে তাদের মাসিক এক লক্ষ টাকার মতো আয় হয়। ওসাইরিস যেহেতু বিশেষায়িত গিটার তৈরির প্রতিষ্ঠান, তাই সেখান থেকে আয়ের হিসাব গিটার অনুযায়ীই আসে। সেই হিসেবে দেখা যায় কখনো ১৫ হাজার টাকাও আয় হয় আবার কখনো ৫০ হাজার টাকা।
২০২২ সালের শেষের দিকে ওসাইরিস 'ছয়তার' নামে আরেকটি নতুন যন্ত্র নিজেদের ভাণ্ডারে যুক্ত করতে যাচ্ছে। ছয়তার মূলত ছয়টি তার সম্বলিত যন্ত্র, যা দেখতে অনেকটা ম্যান্ডালিনের মতো। এর মাধ্যমে গিটার, দোতারা, উকুলেলে সব বাজানো যাবে। এই যন্ত্রটি তৈরি করতে ওসাইরিসের তিন বছর সময় লেগেছে।
আইয়ুব বাচ্চুর স্মরণে 'রূপালি গিটার'
গিটারধ্যানী আইয়ুব বাচ্চুর স্মরণে ওসাইরিস প্রবর্তন করেছে 'রূপালি গিটার'। 'রূপালি গিটার'টি মূলত অ্যাক্যুস্টিক গিটার। ওসাইরিসের পরিকল্পনা আছে রূপালি গিটারের অধীনে তহবিল সংগ্রহ করা এবং সেই তহবিলের অর্থ সঙ্গীতজ্ঞদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার। এছাড়াও এই তহবিলের অধীনে গিটার শেখানোর সেন্টার প্রতিষ্ঠা করার তাদের ইচ্ছে আছে।
যারা নতুন করে গিটার শেখার জগতে প্রবেশ করেছে তাদের জন্য এই প্রচেষ্টা ওসাইরিসের। আইয়ুব বাচ্চুকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই কাজ করতে চান তারা।
কেমন দাম গিটারের
ওসাইরিসে ভালোমানের ইলেক্ট্রিক গিটারের দাম শুরু হয় ২৪ হাজার টাকা থেকে। গ্রাহক নিজের পছন্দমতো গিটার তৈরি করাতে চাইলে সেগুলোর দাম ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে হয়। আরো দামী গিটারও পাওয়া যায় ওসাইরিসে।
ওসাইরিস সম্পর্কিত কোনো মজার অভিজ্ঞতা আছে কীনা জানতে চাইলে নিজের ভুলোমন স্বভাবের জন্য হাসলেন সিয়াম। তবে মনে রাখার মতো ঘটনা কথা বলতে গিয়ে বলেন, 'গানস এন রোজেনসের সাবেক গিটারিস্ট রন বাম্বলফুট বাংলাদেশে এসে ব্লুজডেনেই দুইদিনের সেশন করেন। তখন বাংলাদেশের যত মিউজিশিয়ান আছেন, প্রায় সবাই এখানে এসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। যেটা আমার জন্য খুব সুন্দর স্মৃতি। আরেকটা সুন্দর অভিজ্ঞতা আছে কমল ভাইয়ের সাথে। উনার হাতে গিটার তুলে দেওয়ার সময় যে হৃদ্যতা হয় তা সত্যিই অসাধারণ স্মৃতি'।
ক্রেতাদের প্রতি বজায় রাখেন সততা
গিটার বিক্রিকারী বিভিন্ন খুচরা প্রতিষ্ঠানের প্রতি একরাশ আক্ষেপ রয়েছে সিয়ামের। তার ভাষ্যানুসারে, অনেক বিক্রেতার মধ্যেই অসততা দেখতে পাওয়া যায়। অধিকাংশ বিক্রেতাই ক্রেতার গিটার সংক্রান্ত জ্ঞান কম বুঝতে পেরে অনুপযোগী গিটার সরবরাহ করে। এতে ক্ষতি হচ্ছে ক্রেতাদের বলেও মনে করেন তিনি।
তাই বর্তমানে সিয়াম ওসাইরিসের ক্রেতাদের প্রতি সর্বোচ্চ সততা প্রদর্শন করেই পণ্য বিক্রি করেন। গিটার সম্পর্কে কে কতটুকু জানে বা শেখার কে কোন পর্যায়ে আছে বা কে কতটুকু ওজনের গিটারের ভার বইতে পারবে তা যাচাই করেই বিক্রির কাজ করেন তারা। তাই এখনো পাইকারিভাবে তারা সঙ্গীতের কোনো যন্ত্র বিক্রির কাজ করেন না। ক্রেতাকে প্রাধান্য দিয়েই মূলত বিক্রির কাজ করেন।
ইলেকট্রিক গিটার নিয়ে এখনো ওসাইরিস একনাগাড় উৎপাদনে যাচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশের বাজার প্রেক্ষাপটে ইলেকট্রিক গিটার বিক্রির কাজ খুব ধীমালয়ে চলে। তাই এখনো তারা গ্রাহকের চাহিদা ও পছন্দ অনুযায়ীই গিটার তৈরি করে বিক্রির কাজ করছে। ইলেকট্রিক গিটার কেনা নিয়ে যে জ্ঞান থাকা দরকার সেটা মানুষের খুব কম থাকে এবং বাজেটও এখানে বেশি লাগে তাই বিক্রি কম হয়ে থাকে বলে মনে করেন ওসাইরিসের প্রতিষ্ঠাতা।
যন্ত্র তৈরিতে প্রয়োজন দক্ষ হাত
দেশীয় যন্ত্র বা লোকজ যন্ত্র বা যেসব যন্ত্র মূলত অ্যাক্যুস্টিক আওয়াজ ধারণ করে সেগুলোকে ইলেকট্রিক আওয়াজে নিয়ে আসার পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে সিয়াম জানান, 'দেশে বিভিন্ন যন্ত্র উৎপাদন করাই ছিলো ব্লুজ ডেনের মূল পরিকল্পনা। পশ্চিমা যন্ত্রের চাহিদা বেশি হওয়ার কারণে ব্যবসায়ের দিক থেকে এখন সেগুলোকেই এগিয়ে রাখা হচ্ছে।'
'তবে তবলা, দোতারা, সরোদ, বাঁশিসহ অন্যান্য যন্ত্রগুলোকে ইলেক্ট্রিকের আওতায় নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন দক্ষ কারিগর। যেটা আমাদের দেশে খুব অভাব। কেউ কাস্টমাইজ করে একটা নিতে পারে কিন্তু আমাদের দেশে প্রোডাকশন লেভেলে সেটা সম্ভব না, যেটা ইন্ডিয়াতে হচ্ছে। কারণ ওদের ঐতিহ্যতে তা আছে এবং ওরা অনেক অনেক বছর যাবৎ বানাচ্ছে।'
কেন দক্ষ হাত আমাদের দেশে তৈরি হচ্ছে না প্রশ্নের জবাবে সিয়াম উত্তর দেন, 'প্রকৃতভাবে একেকটা যন্ত্র বাজানোর পেছনে কতটা শ্রম দিতে হয় কিংবা তৈরির পেছনে কতটা প্রয়াস করতে হয়, সেই সংক্রান্ত জানাশোনা বর্তমানে অনেক কম। বর্তমানে যারা মিউজিকের চর্চা করছে কিংবা মিউজিকে ঢুকতে চাচ্ছে তারা এর যথার্থ মূল্য দিতে পারছে না। একটা ইন্সট্রুমেন্ট বানাতে কতটুকু সময় দিতে হয় এবং কীভাবে এর মূল্যায়ন করা উচিত, তা অনেকেই বোঝে না। বাজারে ভালোমানের একেকটা দোতারা কোনোভাবেই ১৫ হাজার টাকার নিচে কমে হওয়া উচিত না। কিন্তু বাজারে ৫ হাজার বা ৬ হাজার টাকায় দোতারা বিক্রি হতে দেখা যায়। কারণ কারিগর সেভাবেই বানায়, অতটুকু শ্রমও তিনি দেন না। কারণ তিনি জানেন তিন থেকে চার হাজার টাকা পাচ্ছেন, দোকানদারও আয় করছেন ঠিকঠাক'।
বর্তমান পরিকল্পনা
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে গিটার তৈরির জায়গাটা দিন দিন আরো নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে বলে মনে করেন সিয়াম। সিয়াম বলেন, 'আশির দশকে বাংলাদেশে অ্যাক্যুস্টিক গিটার যা বানাতো, এখন তার কিছুই নেই। দিন দিন অবস্থা খারাপ হচ্ছে, জাস্ট বানাতে হবে বলে কিছু একটা বানিয়ে দিচ্ছে।'
ওসাইরিসের বর্তমান পরিকল্পনা আগামী দুই বছরের মধ্যে গিটারের বাজারে দেশীয় গিটারকে প্রতিষ্ঠা করা এবং দেশের বাজারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। চাইনিজ গিটারের যে প্রতাপ দেশীয় বাজারে রয়েছে, তা দূর করে নিজেদের গিটারকে সমৃদ্ধ করাই ওসাইরিসের লক্ষ্য।
বাংলাদেশের সঙ্গীতের জগত দিন দিন বড় হলেও কাজ জানার মতো যোগ্য মানুষ সবসময় পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে সঙ্গীতকে ভালোবেসে এই অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা পেতে অনেক সময় লাগে। তাই দীর্ঘদিন যাবত আঁকড়ে না ধরে থাকলে ভালো ফল পাওয়া যায় না বলেই মনে করেন ওসাইরিসের প্রতিষ্ঠাতা সিয়াম।