ইতিহাসের স্বাদ নিন খাবার টেবিলে বসেই
পুরান ঢাকার কথা শুনলেই বেশিরভাগ মানুষের মনে প্রথম যে চিত্রটি ভেসে উঠে তা হলো; রাস্তার কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা হাজারো পুরোনো বাড়ি আর রেস্তোরাঁ। ধুলোবালি ওড়া ঘিঞ্জি রাস্তার কোলে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলোর কোনো কোনটির ইতিহাস বেশ পুরোনো।
তেমনই একটি বাড়ির খোঁজ পেয়ে ছুটলাম পুরান ঢাকার নুর বকস্ লেনে। স্থানীয়দের দিকনির্দেশনা শুনে শুনে হাজির হলাম প্রায় দুইশত বছর পুরোনো সে বাড়ির সামনে। কিন্তু সদর দরজায় পৌঁছানো মাত্রই ক্ষণিকের জন্য দমে গেলাম। এলাকার আর দশটি বাড়ির মতোই সাদাসিধে দেয়ালের এক প্রান্তে তার থেকেও সাদাসিধে একটি গেইট। বাইরে থেকে সন্দেহ জাগে, আসলেই কি এই বাড়ি এত পুরোনো হতে পারে? তবুও গুগল ম্যাপ এবং স্থানীয়দের কথায় আস্থা রেখে কলিংবেল এ চাপ দিয়েই দিই।
দরজা খুলে বের হলেন প্রায় বছর ষাটের এক প্রবীণ। ফোনে কথা আগেই হয়েছিল। এবার পরিচয় দিতেই বলে উঠলেন 'ওয়েলকাম টু মাই হেরিটেজ হোম।'
তাকে অনুসরণ করে বাড়ির বর্ধিত অপেক্ষাকৃত অধুনা অংশের মাঝ দিয়েই চললাম পুরোনো সেই স্থাপনার খোঁজে। সরু সেই রাস্তা পাড়ি দিতে দিতেই গল্পের শুরু সেই প্রবীনের সাথে। আগেই জেনেছিলাম তার নাম আবু মোহাম্মদ ইমরান। এবার শুনলাম তার কর্ম জীবনের কথা।
তিনি বলেন, 'জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন কলেজ) থেকে পড়াশোনা করে ১৯৮৫ সালে মার্কেটিং এন্ড সেলস্ ম্যানেজার হিসেবে ফিলিপাইন এয়ারলাইনে যোগ দিই। পরবর্তীতে ১৯৯৬-২০১৮ সাল পর্যন্ত গালফ্ এয়ারে একই দায়িত্ব পালন করি।' তিনি এই হেরিটেজ হোমের প্রতিষ্ঠাতাদের বংশধর; বর্তমানে এর রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। কোনো অতিথি এলে আগ্রহভরে ঘুরিয়ে দেখান এর প্রতিটি অংশ।
সরু রাস্তা থেকে বেরুতেই চোখ গেল মাটির উঠানের দিকে। উঠানের একপাশে নারিকেল, আম আর নানান রকম ফুল গাছের সমাহার। অন্যপাশে, ছাদের টব থেকে ঝুলে থাকা বিভিন্ন ধরনের ফুল গাছের লতা। তার নিচেই পাতানো বেশ কয়েকটি কংক্রিটের স্ল্যাব। সেগুলো দেখিয়ে দিয়ে অনুসরণ করতে বললেন ইমরান। শ্যাওলা পড়া মাটির উপরে বিছানো সেই স্ল্যাবগুলিকে মনে হচ্ছিলো– সবুজের বিছানায় ছড়িয়ে রাখা পাটাতন। সাবধানে সেগুলি পার হতেই চোখে পড়বে- পুরোনো এক ঘরের বারান্দা।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারদিকে নজর দিতেই মনে হলো ঢাকা শহরের কোলাহলকে বিদায় জানিয়ে পৌঁছে গেছি এক ব্যস্ততাহীন নির্জন জগতে। যেখানে প্রকৃতি নিজেকে মেলে ধরার সম্পূর্ণ সুযোগ পেয়েছে। বিস্তৃর্ণ সেই আঙ্গিনার গল্প বলতে শুরু করলেন ইমরান, 'বাপ-দাদার মুখে শুনেছি, তারা ১৯২০-৩০ এর দশকের প্রাণপ্রকৃতির কথা বলতেন। বলতেন, আমাদের এই এলাকাতেও ছিল কত খোলা মাঠ আর গাছপালা। এই বারান্দাতেও আসতো নানান রকম প্রাণী, পাখপাখালি। আমার ছোটবেলাতেও এখানে হরিণ, ময়ূরসহ আরও কত প্রজাতির প্রাণী দেখেছি। প্রথম দিকে ছয় একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠে এই বাড়ি। এখন বাড়িটির আকার কমেছে, নেই আগের সে সবুজের রাজত্বও। একইসাথে শহরের নিষ্ঠুর আগ্রাসনে হারিয়ে গিয়েছে সেসব প্রাণী। আজো অবশ্য কিছু পাখপাখালির কলতান শোনা যায় এখানে বসে। সেওতো ঢের'।
'চল্লিশের দশকে এই আঙ্গিনা থেকে ঈদ কিংবা অন্য যেকোনো উৎসবের মিছিল বের হতো'- যোগ করেন তিনি।
বারান্দা থেকে ঘরে প্রবেশের সময় হাতের পাশেই দেখা মিললো একটি সুড়ঙ্গের। আগেকার দিনে যুদ্ধের সময় রাজা বাদশাদের গোপন যাতায়াতের জন্য এমন সুড়ঙ্গ পথের কথা শোনা যায়। তাই দেখা মাত্রই প্রশ্ন করে বসলাম ইমরান ভাইকে। তিনি বলেন, 'এটি আন্ডারগ্রাউন্ডের সুড়ঙ্গ। অনেক বছর থেকেই এর ব্যবহার নেই।' খুবই সাদামাটা উত্তর!
চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরের ভিতরে পা ফেলতেই ইমরান ভাই ঘরের আসবাবপত্রের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, 'আপনার চারপাশে যা দেখছেন তার সবই প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো। কোনটি তারও আগে থেকে আমাদের পূর্বপুরুষরা ব্যবহার করছিলেন।'
কথা বলতে বলতে বসলাম একটি ডিভানের ওপর। বসতেই ইমরান হাজির হলেন দুটি পেন্সিল স্কেচ নিয়ে। তার বাবা আবুল মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের আঁকা সেই ছবিগুলোর একটিতে দেখা যাবে, ডিভানের উপর ইমরানের মাকে বসে থাকতে। অন্যটিতে মোগল সম্রাটদের প্রতিকৃতি। এসব দেখিয়ে বললেন, 'এই ডিভানে বসে ছবি এঁকেছেন এস এম সুলতান; এ বাড়িতেও থেকেছেন তিন-চার মাস'।
একে একে আরও পরিচয় করিয়ে দিলেন প্রাচীন ঘরটির প্রতিটি আসবাবের সাথে। এর প্রতিটিই ভিন্ন ভিন্ন সময়ের।
বিশেষভাবে দেখতে চাইবেন
খাবার গরম রাখার জন্যে বর্তমানে আধুনিক হটপট থাকলেও আগেকার দিনে সে ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেসময় চীনা মাটির প্লেটেই খাবার গরম রাখার ব্যবস্থা ছিল। বিশেষ এই প্লেটের নিছে পানি জমা রাখার জন্য একটি ফাঁপা অংশ থাকতো। সেখানে গরম পানি রেখে তার উপরে খাবার পরিবেশন করা হতো। ফলতঃ খাবারও গরম থাকতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ইমরান সাহেবের বাসায় দেখা মিলল এমন তিনটি প্লেটের যার মধ্যে একটি ব্রিটেন থেকে; অন্য দু'টি জার্মানি থেকে আনা হয়েছে।
দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের আঁকা চিত্রকর্ম ঝুলতে দেখা যাবে এ বাড়ির দেয়ালে। তিনি পুরান ঢাকার এ বাড়িতে অতিথি থাকার সময়েই কোনো একদিন এঁকেছেন এই ছবি। তার দক্ষ হাতে গ্রাম বাঙলার মনোমুগ্ধকর এক দৃশ্য ফুটে উঠেছে এতে।
ধীরে ধীরে বাইরের আলো কমে আসতেই ঘরের ভিতরে আলোর পরিবর্তন লক্ষ করলাম। চারদিকে তাকাতেই দেখা মিলল, বিশেষ ধরনের এক গ্লাসের। জিজ্ঞাসু চোখ দেখেই ইমরান ভাই আন্দাজ করতে পারলেন পরবর্তী প্রশ্ন সম্পর্কে। কিছু না বলেই তিনি ঘরের আলো কমিয়ে দিলেন। ঠিক তখনই গ্লাসগুলো আলাদা আলাদা বর্ণ ধারণ করে। এবারে তিনি এগুলোর সম্পর্কে বলতে শুরু করেন, 'বিশেষ এই গ্লাসগুলো তৎকালীন সময়ে ইউরোপ থেকে আনা হয়েছে। এর বিশেষত্ব আলোর সাথে সম্পর্কিত। আলোর বিপরীতে এই গ্লাসগুলো বিভিন্ন রঙয়ের দেখায়, তবে আলো পড়লে কালো বর্ণ ধারণ করে।'
এখানে দেখা মিলবে চারশো বছর পুরোনো সোনার হরফে লেখা কোরআন। সম্পূর্ণ হাতে লেখা এই কোরআনে আরবীর পাশাপাশি ফারসি অনুবাদও স্থান পেয়েছে। কেউ চাইলে এই কোরআন ধরে দেখারও সুযোগ দেন ইমরান। তবে বর্তমানে এর অনেক পৃষ্ঠাই নষ্ট হতে বসেছে।
ঘরের ভিতরের সব জিনিসপত্র দেখানোর সময় হঠাৎই ইমরান একটি আতরের কৌটা খুলে বললেন 'এর একটু ঘ্রাণ নিন। প্রায় একশ বছর পুরোনো এই আঁতর। চাইলে একটু গায়ে মাখতে পারেন।' ক্ষণিকেই পুরো ঘর আঁতরের মিষ্টি ঘ্রাণে ভরে উঠল। পুরোনো ঘ্রাণ, আসবাব আর ঘর। সব মিলিয়ে সেই শ'খানেক বছর আগের সময়কে উপভোগ করার এই দিনের কথা সহজে ভুলার নয়।
ঢাকাইয়া আতিথেয়তা ও খাবার
এতক্ষণ ধরে এই ঘরের প্রতিটি জিনিস ছুঁয়ে দেখে আর ইতিহাসের সহজ পাঠ শেষে– সাধারণভাবেই প্রশ্ন জাগে এর বাসিন্দাদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে। খাবার-দাবারের কথা তুলতেই ইমরান বলতে শুরু করেন তার পূর্বপুরুষদের কথা।
ইমরানের পূর্বপুরুষরা বিশ্বাস করতেন 'মেহমান মহান স্রষ্টার তরফ থেকে আসেন এবং বরকত দিয়ে যান।' এই বিশ্বাস ধারণ করেন ইমরান নিজেও। তাইতো তিনি এখানে আসা মানুষদের কৌতুহল মেটাতে ও মেহমানদারিতে রেখেছেন মধ্যাহ্ন ও নৈশভোজের ব্যবস্থা।
বাংলাদেশে এটিই প্রথম হেরিটেজ লাঞ্চ এবং ডিনারের আয়োজন– দাবি তার। তবে এই আতিথেয়তা পেতে চাইলে দুইদিন পূর্বে খাবারের অর্ডার করতে হয়।
এবারে তিনি বর্ণনা করতে শুরু করেন, পূর্ব পুরুষদের ভোজন রসিকতার কথা। তিনি বলেন, 'আমাদের বাড়িতে দুপুরের খাবার রাতে পরিবেশনের রেওয়াজ কখনও ছিল না। প্রতি বেলাতে আলাদা আলাদা খাবার রান্না করা হতো। এই বাড়ির খাবারের প্রশংসা চারদিকে এতোটাই ছড়িয়ে পড়ে যে তা রীতিমতো কিংবদন্তি হয়ে ওঠে'।
আগেকার সেইসব বাবুর্চিদের কেউ বেঁচে না থাকলেও, টিকে আছে তাদের কিছু রেসিপি। এখনও সেগুলো ব্যবহার করেই তৈরি করা হয় এখানকার খাবার। বর্তমানে অতিথিদের জন্য সুস্বাদু খাবারগুলি তৈরির কাজ করেন ইমরানের স্ত্রী ও বোন।
ইমরান বলেন, 'এই বাড়ির খাবারে জাফরান এবং পনিরের ব্যবহার ছিল আবশ্যক'।
গল্প শেষে নিয়ে গেলেন খাবারের ঘরে। বড় টেবিলের চারপাশে রাখা ১০-১২টি চেয়ারের দু'টি টেনে দিয়ে বসতে বললেন। তারপর একে একে আনতে থাকলেন বাটি ভর্তি খাবারগুলো— মুরগি মাসাল্লাম, পটলের দোলমা, বিফ কাটা মাসালা…
এখানে পরিবেশিত খাবারের মধ্যে মুর্গ মাসাল্লাম অত্যধিক জনপ্রিয়। এর জন্য একটি আস্ত মোরগকে দই, আদা, রসুন, জিরা এবং অন্যান্য মশলা দিয়ে মেরিনেট করা হয়; তারপর বিশেষ প্রক্রিয়ায় রান্না করা হয়। এই খাবারটি জনপ্রিয় ছিল- সেকালের ঢাকার অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব নওয়াব সলিমুল্লাহ-র। ঠিক সেই পুরোনো স্বাদের অথেনটিক মুর্গ মাসাল্লাম খেতে হলে আপনাকে যেতে হবে ইমরানের হেরিটেজ হোমে। সবজি আইটেমের মধ্যে পটলের দোলমার কথা অনেকেই শুনে থাকবেন— হয়ত খেয়েছেনও। এখানকার পটলের দোলমায় কিন্তু নারকেলের দুধ আর দইয়ের ব্যবহারে আলাদা স্বাদের ছোঁয়া পাবেন।
বাটি ভর্তি বিফ কাটা মাসালা পরিবেশন করা হয়েছে বেরেস্তা দিয়ে। দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি খেতেও সুস্বাদু। মুখে দিতেই গলে যায় এত নরম ভুনা মাংস। বিশেষ এক ধরনের মশলার ব্যবহারে মাংস হয়ে উঠেছে একেবারেই মোলায়েম।
এই বাড়িতে পরিবেশিত খাবারের অন্যতম আকর্ষণ হলো আনারস ইলিশ। শুনতেই কেমন ভ্রু কুঁচকে যায়! আনারসের সাথে ইলিশ মাছ! এই আইটেম রান্না করার জন্যে ইলিশ মাছের সাথে আনারসকে লম্বা ফালি করে কেটে দেওয়া হয়। স্বাদও অবর্ণনীয়। এ ছাড়াও আছে ডিমের কোরমা, চিংড়ি মালাই কারিসহ হরেক পদের আয়োজন।
'আপনাদের যে খাবার পরিবেশন করা হয়েছে তার অধিকাংশই ঐতিহ্যগতভাবে এই বাসায় পরিবেশন করা হতো। আমরা দুইশ বছর পূর্বের সেই পুরোনো স্বাদ ধরে রাখার চেষ্টা করছি,' ইমরান জানান। তিনি আরো বলেন, 'যে টেবিলে বসে খাবার খেয়েছেন তার বয়সও প্রায় দু'শ বছর। এখানে টেবিলের অর্ধেক, বাকি অর্ধেক খুলে রেখেছি। বাইরের মেহমানরা আসলে এই টেবিলে খাবার পরিবেশন করা হত।'
যাইহোক, এখানে পরিবেশিত খাবারগুলো খেতে হলে জনপ্রতি ৮০০ ও ১,২০০ টাকার দুইটি প্যাকেজের একটি বাছাই করতে হবে। এরসাথে বাড়তি কোন ডিশ নিতে চাইলে তারজন্যে আরও ৩০০ টাকা বাড়তি গুণতে হবে।
তবে অনেকটা আক্ষেপের সুরেই ইমরান ভাই বললেন, 'খাবার পরিবেশন করে টাকা নেওয়ার কথা কখনও ভাবিনি। কিন্তু তৈমুর ভাই (স্থপতি ও ইমরানের মেন্টর) ও আমার বন্ধুরা আমাকে বাণিজ্যিকভাবে রান্নাঘর খুলতে এবং বাড়িতে একটি ঐতিহ্যবাহী ডাইনিং শুরু করতে রাজি করেছেন।'
এখানকার খাবারের প্রশংসা করে আইনুল ইসলাম নামের একজন বলেছেন, 'এইখানে পরিবেশিত খাবারগুলোর প্রতিটির স্বাদ স্বতন্ত্র্য। এগুলোর স্বাদ বর্ণনা করা যেমন কঠিন তেমনি এর স্বাদ ভুলে যাওয়াটাও কঠিন।'
বংশপরম্পরায় যেভাবে মালিক হলেন ইমরান
মুফতি মোহাম্মদ আলম সতেরো শতকে ইসলাম প্রচারের জন্যে ইয়েমেন থেকে মোগল দরবারে এসে হাজির হন। তখন তাকে চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পান নোয়াখালীতে কিছু ভূসম্পত্তির জায়গীর।
পরবর্তীতে তার পুত্র- নূর বকসকে বিয়ে দেন নোয়াখালী অঞ্চলের এক জমিদারের কন্যার সাথে। সেখানে নূর বকস্ বিরাট জমিদারি এলাকা শাদির 'তোহফা' পান। পরে তিনি আশেপাশের এলাকাতেও জমিদারি বাড়াতে থাকেন। এক পর্যায়ে তার জমিদারি ছড়িয়ে পড়ে ত্রিপুরা, সিলেট, চট্টগ্রাম আর নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায়।
নূর বকস্-এর একমাত্র সন্তান– মৌলভী আবুল খায়রাত মোহাম্মদ জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন সোনারগাঁও, মোগরাপাড়া ও বৈদার বাজার এলাকায়। প্রশাসনিক সুবিধা বিবেচনায় তিনি ঢাকা শহরেও কিছু সম্পত্তি ক্রয় করেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বসতভিটা হিসেবে ঢাকার বেচারাম দেউড়ি এলাকায় ৬ বিঘা জমির উপর গড়ে তোলেন প্রাসাদোপম অট্টালিকা।
নূর বকস্ সাহেবের পর এই জমিদার পরিবারের হাল ধরেন খান সাহেব টাইটেল প্রাপ্ত মৌলবি আবুল হাসনাত আহম্মদ। তার সময় থেকেই জমিদার বাড়িটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে সেসময়ে তার সাথে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বরা আড্ডা দিতে জমায়েত করতেন। সে সময় থেকে বাড়িটি পরিচিতি পেতে থাকে সাহেব বাড়ি নামে।
কথিত আছে, সেকালে বিখ্যাত ব্যক্তিদের মুসাফিরখানা ছিল এই বাড়িটি। এখানে পদচারণা ছিল; হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শিল্পী এস এম সুলতানসহ ঢাকার নামকরা সব ব্যক্তিবর্গের।
মৌলবি আবুল হাসনাত আহম্মদের কোন সন্তান না থাকায়, তার ছোট ভাই মৌলবি আবুল খায়রাত মোহাম্মদ এই বাড়ির দেখভাল করেন। সেময়ে আবুল খায়রাত মোহাম্মদ ও তার বোনদের মধ্যে তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায় বাড়িটি।
পরবর্তীতে মৌলবি আবুল খায়রাত মোহাম্মদের ছোট ছেলে– মৌলবি আবু জাফর জিয়াউল হক হয়ে এই সম্পত্তির মালিকানা আসে আবুল মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের কাছে।
আবুল মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরই ইমরানের বাবা। পৈত্রিকসূত্রে বাড়ির মালিকানা পান ইমরান ও তার বোনেরা। ইমরান নিজের অংশে তিনি এই হেরিটেজ হোম পরিচালনা করতে শুরু করেন ২০১৮ সালে।
বিখ্যাতদের ছোঁয়া লেগে আছে বাড়িটির সবখানেই
১৯২৬ সালে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্বরাজ দলের হয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচনে ১,০৬২ ভোট পেয়ে তার ভরাডুবি হলেও– এই বাড়ির ইতিহাসের সাথে কবির যোগসূত্র জুড়ে যায়। তিনি এখানে বারবার এসেছেন, আতিথেয়তা নিয়েছেন। এ ছাড়াও, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নামও জুড়ে আছে এই বাড়ির সাথে। কৃষক-প্রজা পার্টি থেকে নির্বাচিত হয়ে প্রথম যখন পার্লামেন্টে যান– সেবার সর্বপ্রথম সংবর্ধনা পান এই বাড়িতেই।
বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান এই সাহেব বাড়িতে থাকার সময় বারান্দায় বসে বসে ছবি আঁকতেন একমনে।
বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আড্ডায় মেতেছেন এখানে। রাজনৈতিক আড্ডার পাশাপাশি বসে তাস খেলতেন তারা। আড়াইশো বছর পুরোনো লোহা কাঠের টেবিল সেইসব কীর্তিমানদের ছোঁয়া নিয়ে চলছে।
ঐতিহ্য সংরক্ষণ
ইমরান তার বাবাকে এই বাড়িটি সংরক্ষণ করবেন কথা দিয়েছিলেন। তিনি তা করেছেনও যথাযথভাবেই। বাড়িটির অন্য অংশগুলোর তুলনায় তার অংশটি বেশ পরিপাটি। বাড়িটির পূর্বের কাঠামো ঠিক রেখে সংস্কার করেন ইমরান। পূর্বের কাঠামোর সাথে পরিবারের ৫ সদস্যের আবাসনের ব্যবস্থা করতে নতুন একটি রুম সংযুক্ত করেন।
তার বাদে অন্য শরীকদের অংশ নষ্ট হওয়ার পথে। দেখে মনে হয়, জীর্ণশীর্ণ সেই অংশগুলো ভেঙে পড়তে পারে যেকোনো সময়েই। আর্মেনিয়ান নিও-ক্লাসিক্যাল স্থাপত্যের এই নিদর্শনের সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়ে ইমরান বলেন, 'আজকাল এইসব পুরোনো বাড়ি সংরক্ষণ নিয়ে কারোই তেমন মাথাব্যাথা নেই। বাংলাদেশ সরকারের উচিত, এসব স্থাপত্য ও ইতিহাসের আঁধার রক্ষায় এগিয়ে আসা'।