দ্বিতীয়বার করোনা আক্রান্ত হওয়ার অর্থ কী?
একবার করোনা আক্রান্ত হলেই কি দেহে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক সুরক্ষার অ্যান্টিবডি আমাদের পুনরায় আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচাবে?
সার্স কোভ-২ ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাই বা ঠিক কতদিন এবং কিরকম পর্যায়ের সুরক্ষা দেবে- আসলে তার উপর নির্ভর করছে এই ভাইরাসের সংক্রমণ এবং রোগের পুনঃবিস্তার।
যদিও কিছু গবেষণায় দেখা গেছে পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ, তবে ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকায় কমবয়সী তরুণদের দ্রুত ভাইরাসের নতুন ধরন দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে।
১. পুনরায় আক্রান্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা কত?
ডাচ সংবাদ সংস্থা বিএনও-এর একটি ট্র্যাকার দ্বারা ২০২১ এর এপ্রিল পর্যন্ত পুনরায় সংক্রমণের ৭১টি কেস রেকর্ড করা হয়েছে। এর সঙ্গে এখন তুলনা করা হচ্ছে সারা বিশ্বের মোট সাড়ে ১৩ কোটি কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষকে। তাদের করা রিপোর্ট প্রকৃতপক্ষে কোভিড-১৯ এর লক্ষণ রয়েছে কিন্তু চিহ্নিত করা হচ্ছে না, এমন মানুষদের উপর ভিত্তি করে তৈরি। এর মানে দাঁড়ায় যে সংক্রমিত হওয়ার লক্ষণ অনেকের মধ্যেই দেখা দেওয়ার পরও তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে না।
ডেনমার্কের গবেষকরা তাদের দেশের বিশাল জাতীয় স্বাস্থ্য নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে আরো সুসংগঠিত উপায়ে দেশের ৪০ লাখ (মোট জনসংখ্যার ৬৯%) মানুষের মধ্যে পুনরায় সংক্রমণের ঘটনা খুঁজেছেন।
২০২০ সালেই ডেনমার্ক ১ কোটির বেশি পরীক্ষা করিয়েছে। গত ১৭ মার্চ ল্যানসেট মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুযায়ী, কোভিড আক্রান্তদের থেকে ০ দশমিক ৬৫ শতাংশ মানুষ ভাইরাসের দ্বিতীয় সংক্রমণে আবার আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
২. তাহলে কি একবার কোভিড-১৯ থেকে বেঁচে ফিরলে আপনি পুনরায় আক্রান্ত হবেন না?
উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, তেমন একটি সম্ভাবনা থেকেই যায়। ডাচ গবেষণায় ৬৫ বছরের কম বয়স্কদের ক্ষেত্রে ৮০-৮৩ শতাংশ পর্যন্ত ইমিউনিটি সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে । কিন্তু ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে তা ৪৭ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।
৩. বয়স কেন গুরুত্বপুর্ণ?
এই পরিবর্তনগুলো প্রতিরোধ ব্যবস্থা তথা ইম্যিউন সিস্টেমের অনেক অংশকে প্রভাবিত করে এবং কিছু সংক্রমণজনিত রোগের ক্ষেত্রে বেশি বয়স্ক মানুষদেরকে আক্রান্ত হওয়ার মতো সংবেদনশীল করে তোলে।
ডেনমার্কের গবেষকরা দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যে 'ইমিউন সেনেসেন্স' নামে পরিচিত একটি প্রাকৃতিক, বয়স-সংক্রান্ত পরিবর্তনের প্রভাব আবিষ্কার করেছেন, যা বয়সের সঙ্গে সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধির বিষয়টির ব্যাখ্যা দেয়। আসলে বয়সের কারণে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় হওয়া- এসব পরিবর্তনই হচ্ছে বয়স্কদের মারাত্মক সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকির প্রধান কারণ।
৪. প্রথম সংক্রমণের পর গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক সুরক্ষা কতদিন থাকতে পারে?
যুক্তরাজ্যে ২৫ হাজারের বেশি স্বাস্থ্যকর্মীকে ২-৪ সপ্তাহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায় রাখার মাধ্যমে যে ফলাফল বেরিয়ে এসেছে তা হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে সার্স কোভ-২ ভাইরাসের ক্ষেত্রে ইম্যিউন সিস্টেম গড়ে সাত মাস সুরক্ষা দিতে পারে। ল্যানসেট জার্নালে গত ৯ এপ্রিল প্রকাশিত এ গবেষণায় দেখা যায়, পুনরায় সংক্রমিত হওয়ার সব ধরনের আশঙ্কা থাকার পরও যারা একবার আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অন্তত ৮৪ শতাংশ কম।
৫. কোনো ভাইরাসে পুনঃসংক্রমণ কি অস্বাভাবিক?
এমনটা একেবারেই নয়, শুধুমাত্র হামের মতো কিছু ভাইরাসের একবার সংক্রমণের পর দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দ্বিতীয়বার সংক্রমণের বিরুদ্ধে জীবনভর কিছু মাত্রায় সুরক্ষা দেয়।
পুনঃসংক্রমণের মারাত্মক ক্ষমতার জন্যেই ফুসফুস আক্রান্তকারী করোনাভাইরাস গোত্রের জীবাণুগুলো ব্যাপক আকারে ছড়াতে পারে। সাধারণ ফ্লু'র ভাইরাসও একই রকম অপ্রতিরোধ্য।
অর্থাৎ, শ্বাসপ্রশ্বাসতন্ত্র আক্রান্তকারী অধিকাংশ ভাইরাস সংক্রমণ থেকে একবার সেরে ওঠা ব্যক্তির দেহে সারা জীবন এর বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা থাকে না। তাছাড়া, এসব জীবাণু অভিযোজনের মাধ্যমে একবার গড়ে ওঠা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতেও সক্ষম হয়ে ওঠে।
৬. অভিযোজন কি তবে পুনঃসংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে?
হ্যাঁ। একবার সংক্রমণের পর পাওয়া রোগ সুরক্ষাকে নতুন ধরনগুলো ফাঁকি দেওয়ার যে শক্তি সঞ্চয় করেছে সেটাই পুনরায় আক্রান্ত করার ঝুঁকি বাড়াতে প্রধান ভূমিকা রাখছে।
এমন কয়েকটি ধরন হলো; ব্রাজিলে পাওয়া P.1 এবং ২০২০ এর আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া 501Y.V2 ধরন। এই দুটির মধ্যে P.1 এর দ্বারাই পুনঃসংক্রমণ হচ্ছে বেশি। অন্তত ৪৫টি দেশে ব্যাপক সংক্রমণের জন্য ব্রাজিলের এই ধরনটাই দায়ী।
এদিকে গবেষকরাও জানিয়েছেন, এই নতুন ধরনটি আগেরটির চেয়ে আড়াই গুণ বেশি হারে সংক্রমিত করতে পারে। সেই সাথে এর দ্বারা পুনঃসংক্রমণের হার গড়ে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। কিছু বিজ্ঞানী আরও বলছেন, একবার সংক্রমণের দ্বারা প্রাপ্ত গোষ্ঠীবদ্ধ অনাক্রম্যতা বা হার্ড ইম্যিউনিটিও কোন সমাধান নয়।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে দেখা গেছে, B.1.1.7 ধরনের বিরুদ্ধে আগেরবারের স্বাভাবিক ইনফেকশনই তাদের সুরক্ষা দিচ্ছে।
তবে সুখবর হচ্ছে, মারাত্মক নতুন ধরনগুলোকে মোকাবিলা করতে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যেই নতুন ভ্যাকসিন বানানো শুরুও করে দিয়েছে।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ