বিশ্বকাপে কেমন করবে বাংলাদেশ, কী বলছেন সাবেক অধিনায়করা
বাংলাদেশের ওয়ানডে দলের সফলতম অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা দেড় বছর আগে বলে রেখেছেন, ২০২৩ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে খেলবে বাংলাদেশ। ফরম্যাটটা ওয়ানডে বলে বাংলাদেশের স্বপ্নও এমনই। এ কারণেই অধিনায়কত্ব পেয়ে তামিম ইকবাল বলেছিলেন, বিশ্বকাপ পর্যন্ত নেতৃত্বে থাকলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ঘোষণা দিয়ে খেলতে যাবেন।
এবারের এশিয়া কাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স দেখার পর অবশ্য এসব কথা বাড়াবাড়ি মনে হবে। ব্যাটিং ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দী থাকা বাংলাদেশ দুটি ম্যাচ জিতেছে। প্রথম জয়টি তাদেরকে সুপার ফোরে তুললেও পরের জয়টি তেমন কোনো কাজে আসেনি। এমন পারফরম্যান্সের পর প্রত্যাশার বেলুন চোপষাতে শুরু করে।
যদিও অধিনায়ক সাকিব আল হাসান এবারের এশিয়া কাপকে 'রিয়েলিটি চেক' বলেছেন। আসর চলাকালীনই তিনি জানান, বিশ্বকাপের আগে রিয়েলিটি চেক করাটা দরকার ছিল। তাই লক্ষ্য ছোঁয়া না গেলেও এশিয়া কাপ খেলে উপকারই হয়েছে বলে তার দাবি। বাস্তবতা যাচাই করা গেছে, ৫ অক্টোবর শুরু হতে যাওয়া বিশ্বকাপে কেমন করতে পারে বাংলাদেশ? এ নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের সাবেক পাঁচ অধিনায়ক, করেছেন ভবিষ্যদ্বাণী।
মাশরাফি বিন মুর্তজা: ওয়ানডেতে বাংলাদেশ সব সময়ই ভালো দল, এটা নতুন করে বলার কিছু নয়। এই ফরম্যাটে বাংলাদেশকে সব দলই সমীহ করে, এটা না বলে দিলেও হয়। ঠিক কেমন করবে, সেটা নিশ্চিত করে তো বলা কঠিন। কারণ এটা নির্দিষ্ট দিনের খেলা। ওইদিন যে ভালো করবে, ফল তাদের পক্ষেই যাবে। তখন কে ভালো দল নিয়ে নেমেছিল, সেটা আর বিবেচনায় থাকবে না। তবে কাগজে-কলমের সব হিসাব বাদ দিলেও আমার মন বলে এবারের বিশ্বকাপে ভালো করবে আমাদের দল।
আমি আগে বলেছিলাম, আমার বিশ্বাস ২০২৩ বিশ্বকাপে সেমি-ফাইনালে খেলবে বাংলাদেশ। এখনও সেই বিশ্বাস আছে আমার। তবে বলছি না খেলবেই, এটা শুধুই সম্ভাবনা। বিশ্বকাপের মতো আসরে আগে থেকে বলা কঠিন, এমন মঞ্চে খেলতে গেলে অনেক ব্যাপার থাকে। বাংলাদেশের বিশ্বকাপের দল ভালো, ভালো সমন্বয় হয়েছে। অভিজ্ঞ ও তরুণদের সমন্বয়ে হয়েছে দল। অভিজ্ঞরা আছে, আবার ফ্রেশ ব্লাডও আছে। ভালো একজন নেতা হিসেবে আছে সাকিব আল হাসান, দল ভালো। সব মিলিয়ে আমার মনে হয় এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ভালো করবে।
আমিনুল ইসলাম বুলবুল: সূচি দেখলাম, সূচি দেখে মনে হলো এতোটা ধীর গতির যে, এটা বাংলাদেশের পক্ষে। বাংলাদেশ তাদের স্বাভাবিক খেলা খেললে ভালো করার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশের ভালো করার সম্ভাবনা অনেক, তবে নিউজিল্যান্ড সিরিজ পর্যন্ত যা খেলা দেখেছি, আমার কাছে মনে হয়েছে, বাংলাদেশ এখনও দল হিসেবে থিতু নয়। ভারতকে যেমন দেখতে থিতু লাগছে, অবশ্য আবার অনেক দলকেই তেমন লাগছে না। তবে বিশ্বকাপের আগ মুহূর্তে আমার কাছে মনে হচ্ছে না বাংলাদেশ স্বস্তির জায়গায় আছে। এর কারণ হচ্ছে আমাদের দল গঠন করতে আমরা অনেক সময় নিয়েছি।
এতো বড় একটা ইভেন্টের আগে মানসিক প্রস্তুতি, শারীরিক প্রস্তুতি নেওয়ার থাকে। আমার কাছে মনে হয় না আমরা সেটা করতে পেরেছি। তবে অভিজ্ঞতার দিক আমরা সবেচেয়ে অভিজ্ঞ দল। সেই হিসেবে আমাদের অবশ্যই ভালো করা উচিত এবং ভালো করার সম্ভাবনা আছে। তবে দল থিতু বা স্থির না হওয়ায় আমরা বলতে পারছি না যে, "হ্যাঁ আমরা দারুণ করব।" ও রকম কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তাই সেমি-ফাইনালের আশা করাটা এই মুহূর্তে বাড়াবাড়ি। দল থিতু থাকলে আশা করা যেত। প্রত্যাশার লাগামে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে আমাদের।
হাবিবুল বাশার: বাংলাদেশকে ভালো করতে হলে দলের সবাইকে আগে সুস্থ ও ফিট থাকতে হবে। ভালো করার পেছনে এটা অনেক বড় ব্যাপার। পুরো দল যদি সুস্থ থাকে, ফিট থাকে এবং পুরো সামর্থ্য নিয়ে খেলতে পারে, অবশ্যই এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভালো করার সম্ভাবনা আছে। আমি সেমি-ফাইনাল বা ফাইনাল পর্যন্ত যাব না, বিশ্বকাপে কেমন করবে সেটাও বলব না। ভালো তো করবে বলে আশা করি, তবে ফল অনুযায়ী কী করবে সেটা বলব না।
এতোটুকু বলতে পারি বাংলাদেশ এবার সব প্রতিপক্ষকে কঠিন সময়ে ফেলবে। বাংলাদেশ নির্দিষ্ট একটা দল নিয়ে অনেক দিন ধরে খেলছে এবং সফল। পারফরম্যান্স হয়তো ধারাবাহিক নয়, কিন্তু এর পেছনে বড় কারণ ইনজুরি, অসুস্থতার কারণে পুরো দল নিয়ে তারা খেলতে পারছে না। বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখে বিশ্রামও দেওয়া হয়েছে। তবে বিশ্বকাপে যখন দল যাবে, আমার মনে হয় তখন ভিন্ন চিত্র দেখা যাবে। তখন আশা করি সমস্যা হবে না। একটানা খেলা হবে, সবাই যেন ইনজুরিমুক্ত থাকে। ভালো করতে পুরো দলকে একসাথে পাওয়াটা জরুরি।
মোহাম্মদ আশরাফুল: প্রথম ম্যাচটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম ম্যাচটা যদি আমরা আফগানিস্তানের বিপক্ষে জিততে পারি, তাহলে অন্যান্যবারের চেয়ে এবারের বিশ্বকাপটা আমাদের জন্য ভালো হবে। যেহেতু ২০০৭ থেকে শুরু করে প্রতিটা বিশ্বকাপেই আমাদের তিনটা করে জয়, তো এবার আমরা প্রথম ম্যাচটা যদি জিততে পারি, তাহলে আমাদের চার-পাঁচটা ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা আছে। সেমি-ফাইনাল খেললে তো খুবই ভালো, তবে আমি সেই সম্ভাবনা দেখি না। দল হিসেবে বাংলাদেশকে আমি সেমি-ফাইনালে দেখি না সত্যি বলতে।
এই দলের অনেক ইতিবাচক দিক আছে, আবার দুর্বলতাও আছে। ওয়ানডে ক্রিকেট ৪০০ রানে চলে গিয়েছে, আমরা এখনও সেখানে যেতে পারিনি। আমরা এখনও ২৫০, ২৭০ রানের মধ্যেই আছি। শেষ ১০টা ম্যাচের মধ্যে আমরা হয়তো তিন-চারটা ম্যাচে তিন'শ ছাড়ানো সংগ্রহ গড়েছি, কিন্তু সেটা আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। ভালো কোনো বোলিংয়ের বিপক্ষে ওই পরীক্ষাটা আমরা এখনও দিতে পারিনি। আমার কাছে মনে হয়, বিশ্বকাপে হাই স্কোরিং ম্যাচের সংখ্যাই বেশি হবে। সেখানে আমরা ২৫০,২৭০ রানের মধ্যেই আছি। এসব বিবেচনায় সেমি-ফাইনাল চিন্তা করা যায় না। তবে এবারের বিশ্বকাপে জয়ের গড় বাড়বে, যদি আমরা প্রথম ম্যাচটা জিততে পারি।
খালেদ মাসুদ পাইলট: আমরা তো স্বপ্ন দেখা মানুষ, বাংলাদেশের মানুষ বেশি স্বপ্ন দেখে। কাগজে-কলমে আমার কাছে মনে হয়, আমরা বিশ্বকাপে পাঁচ-ছয় নম্বরের দিকে থাকব। অনেকেই বলবে বাংলাদেশ সেমি-ফাইনাল খেলবে, ট্রফি নিয়ে নেবে। ক্রিকেটে সেটা হতেই পারে, অবস্থা পরিবর্তন হতে ১০টা বলের খেলা। যদি ভালো খেলেতে পারে, ভালো মোমেন্টাম পায়; হয়ে যাবে। কিন্তু ব্রাজিল তো নেপালের বিপক্ষে হারবে না ফুটবলে। ব্রাজিল জিতবেই, এটা ১০ বলের খেলা না। ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা, ১০ বলের খেলা, যে কেউ জিততে পারে।
কিন্তু কাগজে-কলমে আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশ পাঁচ থেকে ছয় নম্বরের দিকে। এক্সট্রা অর্ডিনারি খেললে সেমি-ফাইনাল, ফাইনালের সম্ভাবনা থাকতে পারে। এক্সট্রা অর্ডিনারি, ভাগ্য ও পারফরম্যান্স; সব কিছু মিলিয়ে যদি এক হয়, তাহলে হতে পারে এমন। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে। পাঁচ-ছয় নম্বর দল হয়ে থাকলে আপনার লক্ষ্য হওয়া উচিত দুই-তিন নম্বর দল হবেন। তবে এই দলটার সমস্যা একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার নেই। ভালো পর্যায়ে বা উইকেটে এটার দরকার আছে। আমার মনে হয় এই বাংলাদেশ দলের এটা দুর্বলতা। তবে যা আছে, তা নিয়েই লড়তে হবে। বাংলাদেশের জন্য শুভ কামনা।