পিএসজি আর ইংলিশ ক্লাবগুলোর কাছেই চলে যাচ্ছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের রাজত্ব?
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা কার হাতে উঠবে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী করাটা আসলেই কঠিন। গত চার মৌসুমে চারটি ভিন্ন ক্লাব জিতেছে এই শিরোপা। সর্বশেষ নয় ছয় ফাইনালে খেলেছে নয়টি ভিন্ন দল। কিন্তু সম্প্রতি আর্থিক অব্যবস্থাপনা এবং করোনাকালীন অর্থনৈতিক সংকটের কারণে যেভাবে ইউরোপীয় ফুটবলের শক্তি কাঠামোর মেরুকরণ হয়েছে, তার প্রভাব নিশ্চিতভাবেই পড়তে যাচ্ছে মাঠের ফুটবলেও।
পূর্বাভাস বলছে, এ মৌসুম এবং সামনের কয়েক মৌসুমে প্যারিস সেন্ট জার্মেই (পিএসজি) এবং প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর ব্যক্তিগত যুদ্ধে পরিণত হতে পারে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। বায়ার্ন মিউনিখেরও সুযোগ আছে এদের সাথে লড়াইয়ে নামার। কিন্তু এই গ্রীষ্ম আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ফুটবল বিশ্বের কোন অংশে অর্থের ঝনঝনানি সবচেয়ে বেশি। আর যেখানে যেখানে অর্থকড়ি থাকে, শিরোপাও সাধারণত তার আশেপাশেই লুটোপুটি খায়।
শিরোপার সমীকরণে হাই-প্রোফাইল খেলোয়াড়দেরও থাকতে হয়। এ কারণেই লিওনেল মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এই গ্রীষ্মে যথাক্রমে পিএসজি ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দিয়েছেন, যা তাদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার সম্ভাবনাটা আরও বাড়িয়েছে। মেসি (চার) এবং রোনালদো (পাঁচ) নিজেরাই মোট নয়বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন। মৌসুম শেষে যদি এদের একজনের নামের পাশে আরেকটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা যোগ হয়, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
গত দুই মৌসুমে ইউরোপীয় ফুটবলের শক্তি কাঠামো কতটা বদলেছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ মৌসুম পর্যন্ত টানা পাঁচ মৌসুম ধরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিতেছে রিয়াল মাদ্রিদ বা বার্সেলোনা। দুইবার ফাইনাল খেলেছে অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদ।
কিন্তু সর্বশেষ তিন ফাইনালে জায়গা করে নিতে পারেনি লা লিগার কোনো ক্লাব। এই তিনটির মধ্যে দুটিই হয়েছে 'অল-ইংলিশ ফাইনাল', যেখানে চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরেছে লিভারপুল ও চেলসি। আর রানার আপ হয়েছে টটেনহাম ও ম্যান সিটি। ২০১৯-২০ মৌসুমে পিএসজিকে হারিয়ে বায়ার্নের শিরোপা জেতাও আমাদের কিছুটা ইঙ্গিত দিচ্ছিল ফুটবল কোনদিকে যাচ্ছে।
ইউরোপের সবচেয়ে বড় ক্লাবগুলো তাদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে এ সপ্তাহে। শুরুর আগেই কোনো স্প্যানিশ বা ইতালিয়ান ক্লাবের শিরোপা জেতার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিতে পারেন আপনি। রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা দুই দলই একরকম পালাবদলের মাঝখানে আছে। ১৩৫ কোটি ইউরো ঋণের উপর বসে থাকা বার্সেলোনা এই গ্রীষ্মে ধরে রাখতে পারেনি মেসিকে, বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে আন্তোয়ান গ্রিজমান, জুনিয়র ফিরপো ও মিরালেম পিয়ানিচের মতো খেলোয়াড়দের। ওদিকে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর ৭০ কোটি ইউরোর সংস্কার কাজ ও ক্লাবের ৪০ কোটি ইউরোর ওয়েজ বিলকে সামলাতে সার্জিও রামোস, রাফায়েল ভারান ও মার্টিন ওডেগার্ডের মতো ফুটবলারদের ছেড়ে দিয়েছে মাদ্রিদ।
এই মুহূর্তে তাই বাস্তবিকভাবে রিয়াল বা বার্সা কারোরই সামর্থ্য নেই পিএসজি বা ইংলিশ ক্লাবগুলোর সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার। অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের একটি নিয়মিত শক্তি হলেও তারা কখনোই পুরো পথ পাড়ি দিয়ে শিরোপায় হাত রাখতে সামর্থ্য হয়নি। এ মৌসুমে সেটা হওয়ার সম্ভাবনাও তাই ক্ষীণ।
ইতালিতেও প্রায় একই অবস্থা। ২০১৫ ও ২০১৭ সালে ফাইনাল খেলা জুভেন্টাস এবার কোনোমতে জায়গা পেয়েছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে (সিরি আ'য় চতুর্থ হয়ে)। অর্থনৈতিক মন্দা ও ঋণের বোঝা লাঘব করতে দলের সবচেয়ে বড় তারকা, রোনালদোকে বিক্রি করে দিয়েছে বিয়াঙ্কোনেরিরা। ওদিকে কোচ অ্যান্থনিয়ো কন্তে, এবং রোমেলু লুকাকু ও আশরাফ হাকিমির মতো মূল তারকাদের হারিয়ে লিগ চ্যাম্পিয়ন ইন্টার মিলান যে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার কথা চিন্তাও করছে না, সেটা অনুমান করা যায়।
সর্বশেষ ২০২০ সালে চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরা বায়ার্ন এবার দলে ভিড়িয়েছে আরবি লাইপজিগের দায়ত উপামেকানো ও মার্সেল সাবিতজারকে। হ্যান্সি ফ্লিকের বদলি হিসেবে এনেছে লাইপজিগ কোচ জুলিয়ান নাগেলসম্যানকে। কিন্তু জার্মান চ্যাম্পিয়নদের দীর্ঘদিনের সেবকরা এবার কতটুকু কার্যকর হবে, তার উপরই মূলত নির্ভর করছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তাদের সম্ভাবনা।
ম্যানুয়েল নয়্যার (৩৫), টমাস মুলার (৩২) এবং রবার্ট লেভান্ডফস্কি (৩৩) এখনো দলের মূল চালিকাশক্তি। এদের সাথে জশুয়া কিমিখ, আলফনজো ডেভিসের মতো তরুণদের সংমিশ্রণে বায়ার্ন ভালো একটি দল তৈরি করলেও এ মৌসুমে পিএসজি আর ইংলিশ দলগুলো যেভাবে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে, তাদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়াটা কঠিনই হবে বাভারিয়ানদের জন্য।
সার্জিও আগুয়েরোর শূন্যস্থান পূরণে মরিয়া ম্যান সিটি হ্যারি কেইন বা রোনালদোকে দলে ভেড়াতে না পারলেও অ্যাস্টন ভিলা থেকে ব্রিটিশ ট্রান্সফার রেকর্ড ১০ কোটি পাউন্ড ফি দিয়ে জ্যাক গ্রিলিশকে ঠিকই দলে টানতে সক্ষম হয়েছে। কোনো স্বীকৃত সেন্টার-ফরওয়ার্ড ছাড়াই গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল পেপ গার্দিওলার দল। ইনজুরি-জর্জরিত আগুয়েরোর প্রস্থান যে তাই সেভাবে অনুভব করবে না সিটি, সেটা বলেই দেওয়া যায়।
ওদিকে সিটিকে হারিয়ে শিরোপা জেতা চেলসি তাদের দলকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। ইন্টার থেকে ৯.৭৫ কোটি পাউন্ডের বিনিময়ে দলে ভিড়িয়েছে লুকাকুকে, যার উপস্থিতি ইতোমধ্যেই লন্ডনের ক্লাবটিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এছাড়া অ্যাতলেটিকো মিডফিল্ডার সাউল নিগুইজকেও দলে ভিড়িয়েছে টমাস টুখেলের দল।
লিভারপুল এই মৌসুমে মিডফিল্ডার জর্জিনিয়ো ওয়াইনাল্ডামকে হারিয়েছে পিএসজির কাছে। আর লাইপগিজ ডিফেন্ডার ইব্রাহিমা কোনাতেকে দলে ভিড়িয়েছে। দলবদলের বাজারে তেমন সরব না থাকলেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ইয়ুর্গেন ক্লপের দল কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, সে সম্বন্ধে ভালোভাবেই অবগত ইউরোপের বাকি ক্লাবগুলো।
ইনজুরি-জর্জরিত গত মৌসুমেও কোনো স্বীকৃত সেন্টার-ব্যাক ছাড়াই কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে লিভারপুল। ইনজুরি শেষে ভার্জিল ভ্যান ডাইকসহ সব সিনিয়র সেন্টার-ব্যাকের প্রত্যাবর্তন, অ্যানফিল্ডে দর্শক ফিরে আসা, এবং ইউরোপীয় ফুটবলে ক্লাবের অভিজ্ঞতা, এ সব কিছুর মিশ্রণ স্বাভাবিকভাবেই লিভারপুলকে ফেভারিটদের কাতারে নিয়ে যায়।
এদিকে ইউনাইটেড এখনো ওলে গুনার সুলশারের অধীনে কোনো শিরোপার দেখা না পেলেও এই মৌসুমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দলবদল করতে সমর্থ হয়েছে তারা। রোনালদো, ভারান ও জ্যাডন সাঞ্চোর মতো তারকাদের অন্তর্ভুক্তি, এবং ডেভিড ডি হেয়া ও পল পগবার মতো তারকাদের ছন্দে ফেরা ইউনাইটেডকেও খাতায়-কলমে ফেভারিটদের কাতারে নিয়ে যাবে।
কিন্তু সব ইংলিশ ক্লাবকে ছাপিয়ে এই মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে চূড়ান্ত ফেভারিটের তকমাটা নিয়ে নিচ্ছে পিএসজিই। প্রশ্নাতীতভাবেই এই মুহূর্তে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী দলটির নাম পিএসজি।
এই গ্রীষ্মে মেসি, রামোস ও ওয়াইনাল্ডামের মতো তারকাদের দলে ভিড়িয়েছে ফরাসি ক্লাবটি, যাদের প্রত্যেকেরই চ্যাম্পিয়ন্স জেতার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এছাড়া আশরাফ হাকিমি, জিয়ানলুইগি দোনারুমা, নুনো মেন্ডেস ও দানিলো পেরেইরার মতো তরুণদের অন্তর্ভুক্তি মউরিসিও পচেত্তিনোর দলকে একরকম গ্যালাকটিকোতেই পরিণত করেছে।
সফল ট্রান্সফার উইন্ডো শেষে নেইমার ও কিলিয়ান এমবাপেকেও বেঁধে রাখতে সক্ষম হয়েছে পিএসজি। তাই দলগত শক্তিমত্তার বিবেচনায় এই মুহূর্তে পিএসজির ধারেকাছেও নেই ইউরোপের কোনো ক্লাব।
স্প্যানিশ ও ইতালিয়ান পরাশক্তিরা পিএসজিকে আটকাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। শুধু ইংলিশ ক্লাবগুলোই পারে ইউরোপিয়ান কাপকে প্রথমবারের মতো প্যারিসে পৌঁছানো থেকে আটকাতে। এ সমীকরণ কিন্তু শুধু এই মৌসুমের জন্য না। সামনের কয়েক মৌসুম এই বাস্তবতার সঙ্গেই মানিয়ে নিতে হবে আমাদের।
- সূত্র: ইএসপিএন