জোতজমিনের বাস্তুপাঠ
যদিও দক্ষিণটোলা আমাদের গন্তব্য ছিল না।
আর ডিসেম্বরের এই ঘোর শীতে আম্মাকে নিয়ে বেরুনোরও কথা ছিল না এভাবে। কিন্তু জানুয়ারিতে রেজিস্ট্রি অফিসের সবকিছুর খরচ বেড়ে যাবে এই অছিলায় মেজ ফুফা হঠাৎ তারিখ-টারিখ ঠিক করে ফেললে একরকম বাধ্য হয়েই ভোর ভোর বেরিয়ে পড়া। বড় ভাই এসেছে গতকালকের ফ্লাইটে। আজ থেকে আগামীকাল ফিরে যাবে। তাই বারবার তাড়া দিচ্ছে। আজ জমি রেজিস্ট্রি না হলে আবার দেড়-দুই মাসের ধাক্কা। এদিকে ফুফারাও পণ ধরে বসে আছে রেজিস্ট্রি ছাড়া জমিতে হাত লাগাবে না। অথচ বোরো চাষের উপযুক্ত সময় এটা। বীজতলাও তৈরি। এখন দলিল রেডি হলেই আবাদে ঝাঁপিয়ে পড়বে তারা। এদিকটায় সনাতনী লাঙল দিয়ে চাষটাষ উঠেই গেছে প্রায়। বলদ পোষা আর হাতি পোষা সমান বলে লোকজন এখন কলের লাঙলের দিকে ঝুঁকেছে। কলের লাঙলে স্মুদলি কাজ সারা যায়। তারপর সারটার, জলসেচ, মই দেয়ার পর মখমলের মত নরম ধানের চারা রোপণ করবে আদিবাসী মেয়েরা। সেই কোন ভোরে পিঁপড়ের সারির মতো এসে হাজির হবে জমির আলে। ধান-দুর্বার ছোট্ট এক রিচ্যুয়াল সেরে লেগে পড়বে কাজে। তারপর কবিতার পঙ্ক্তির মতো মাটির ক্যানভাসে মূর্ত করে তুলবে ধান্য-ইশারা। সে অন্য গল্প। সে গল্প শোনার ধৈর্য বা সময় কোনোটাই তাদের নাই। অথচ মৃত্যুর আগপর্যন্ত আব্বা নিয়মিত আসতেন দেশের বাড়িতে। দাদা মারা যাবার পর আরও বেশি করে আসতেন। যদিও তখন ভিটেবাড়ি ফাঁকা। সারসার ধানের কুঠি, গোয়ালঘর, মুরগির খুল্লা, বেড়াল-কুকুর, ইঁদারা, কলতলা, শিউলি-বকুল-গুটিআম-বাতাবিলেবু-জামরুল... সব আগলায় জরিনা বেটি। সন্ধ্যায় ঘরদোরে আলো জ্বালিয়ে হাঁসগুলোকে ডাকে, আয় আয় চই চই... তখন বোঝা যায়, না—সব গত হয়ে যায় নাই সর্দারবাড়িতে।
এখনো জীবন আছে। জীবন-প্রবাহ আছে। আব্বাকে উপলক্ষ করে ফুফুরা তখন নাইওর চলে আসত আশপাশের পাড়া থেকে। এমনকি ছোট ফুফুটাও অকালে নড়বড়ে হয়ে যাওয়া শরীর হুইলচেয়ারে উঠিয়ে এসে পড়ত। এখনো কী ঢলঢল তরতাজা মুখ তার, হাসি অমলিন। অথচ এটার কী মূল্য সংসারে! তুমি শরীর প্রাণপাত করে সন্তান উৎপাদন করেছ প্রতিবছর, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে তুমি এখন অক্ষম—কী গৃহকর্মে কী গৃহকর্তার মনোরঞ্জনে। সুতরাং তুমি এখন বাতিলের খাতায়। তবে ছেলেদের মা হিসেবে কেবল এখানে থাকতে পারো। দড়ির খাটলায় বসে তাদের তদারকি করতে পারো(এটুকুই। ওদিকে বৈঠকঘরের পাশের আঙিনায় আরেকটা কোঠাঘর ওঠে কী সেখানে নতুন ছাপের খাট, ড্রেসিং টেবিল, ময়ূর বসানো আলমারি আসে ছোট ফুফার নতুন শ্বশুরবাড়ি থেকে, গ্রিল আঁটা বারান্দায় ঝাঁ চকচকে মোটরসাইকেল... হায় কত রঙ্গ দেখব এই দুচোখে বলে কাঁদতে কাঁদতে কতবার বাড়ি ফিরতে চেয়েছে ছোট ফুফু কিন্তু আমাদের দাদায় লৌহমানব। তাঁর পোষা কুকুর, বেড়াল-মুরগির দল অন্ন পায় তিন বেলা কিন্তু সংসারত্যাগী কন্যা কভি নেহি। আরে পাগলি তোর ঘরে বড় হচ্ছে চার-চারটা ব্যাটা(এরাই তো তোর শক্তি, তোর বাঁচার জায়গা, তোর ঢাল... এদের ফেলে কেন ফিরবি বরং ধৈর্য ধর, ওদের বড় হতে দে, তারপর দ্যাখ সবুরে মেওয়া ফলে কি না। বলেই দাদা গফুর ভাইকে গাড়ি জুড়তে বলতেন। মানে অপমানের বোঝা কাঁধে নিয়ে একবস্ত্রে ফের ফিরে যাওয়া। আমার ঘুঁটেকুড়ুনী দাদির সাধ্য কী তাকে ফেরায়।
আতিক মাঝেমধ্যেই এমন দৃশ্যে আটকে যায়। এই যে এখনো আটকে যাচ্ছে দ্যাখো কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে ওঠা কাচের জানালার বাইরের অপসৃয়মান ভোরের দৃশ্যে। হাতের বাঁয়ে লালাভ দিগন্ত থেকে জন্ম নিচ্ছে নতুন দিন। দূরের খেজুরগাছের সারি থেকে রস নামাচ্ছে লোকেরা, কেউ কেউ কুয়াশা আর সরষে ফুলে মাখামাখি হয়ে আলপথ দিয়ে হেঁটে আসছে। আহা জানালাগুলো একটু সরিয়ে দিলে অসুবিধে কোথায়, বাতাস বয়ে আনুক সরষে ফুলের সতেজ গন্ধ। বুক ভরে যাক। প্রাণ ভরে যাক। কিন্তু আমার ভাইবোনদের অ্যালার্জির ধাত, হাঁচি পড়া শুরু হবে। তখন যাওয়া মাটি করে খুঁজতে হবে ওষুধপাতি, ভিক্স ভেপোরাব... বরং আম্মাকেই দেখি তরতাজা হয়ে উঠেছেন দেশে যাবার টানে। কাল পুরোটা দিন শুয়ে ছিলেন কে বলবে! আম্মা একটু চঞ্চল গলায় বলে উঠলেন, কে রস নামাচ্ছে, কুতুব নাকি রে? ওকে ডাক তো। একটু রস খাই মুড়ি দিয়ে। ছোট বোন বলল, এখানে কুতুব মামা কোথায় পাবা, এটা তো গোদাগাড়ি চলছে। ড্রাইভার ভুল শুধরে দিল, এটা গোদাগাড়ি না। আমনূরা লাইনে চলে এসেছি ম্যাডাম। এত তাড়াতাড়ি?
আতিক নিজেও একটু হতভম্ব। এই তো একটু আগে মাইক্রো থামিয়ে চা-টা খাওয়া হলো নাইস না কী রেস্তোরাঁয়। গরম গরম রসগোল্লা সহযোগে। ড্রাইভার এক ডিগ্রি ওপরে। এই ভোরে সে পরোটা-ডিম ভাজি আর রসগোল্লায় পেট বোঝাই করে ফেলল। তারপর মালাই চা আর মসলাদার পান। আম্মা ফ্লাস্কের গরম জলে টি-ব্যাগ ফেলে তাতে গ্লুকোজ বিস্কিট ডুবিয়ে খেলেন। আমাদের ছোটবেলার ঘুম ভাঙা ভোরের নাশতা ছিল ওটাই। তবে লিকার নয়, ঘন দুধের চা থাকত। সঙ্গে টোস্ট অথবা খই-মুড়ি। তারপর ইস্কুলে যাবার মুখে কিছু খেয়ে দৌড়। বড় বোন বলল, ইস্টিশানটা কই, ইস্টিশানটা? যেন তার কথার সঙ্গে সঙ্গে আমনূরা জংশন ইতিহাস-টিতিহাস ঝেড়ে এগিয়ে আসবে কাছে, বিহারি টিকিসবাবু কী লিও তলস্তয় দাড়ির ড্রাইভার বুড়ো একগাল হেসে বলবে, খোঁকি, ভালো আছো? তখনকার বড় বোন তো কাবুলিওয়ালার মিনির মতো ফ্রক পরা, ও রকমই ডাগর ডাগর চোখ, একমাথা চুল। আব্বার এডরুক ওষুধ কোম্পানির উচ্চমার্গের চাকরির জৌলুসে লালিত বোঝ না!
সদ্য বিলাতফেরত আব্বার কী স্টাইলিস চলাফেরা তখন, মরিস কোম্পানির টুডোর গাড়ি হাঁকান পাবনা শহরে। সকালের ব্রেকফাস্টে জ্যাম-মাখন লাগানো রুটি, ডিমসেদ্ধ, ফ্রুটস। ইলেকট্রিক সেভারে দাড়ি কামিয়ে বড় স্পুলের টেপ রেকর্ডারে হেমন্ত মুখার্জী ছেড়ে অবিকল ছবি বিশ্বাসের মতো ড্রেসিং গাউন চাপিয়ে এমনভাবে খেতে আসতেন যে নানাবাড়িতে বড় হওয়া ছ বছরের বড় ভাই আর চার বছরের বড় বোন লুকোনোর দিশা পেত না। আম্মাও লুকোতে চাইতেন। নাইলনের শাড়ির থেকে সাজাদপুরী তাঁত কত আরামের, এ কথা কাকে বোঝাবে, হাই হিলের চে দু-ফিতার বাটার চটি, অবজারভারের কাঠখোট্টা ইংরেজির চে ইত্তেফাক না হয় বেগম পত্রিকা। বড় বোন আমনূরা জংশন আসছে না বলে বাচ্চাদের মতো ফোঁপায়। আমরা এখানে এসে ট্রেন বদলাতাম। সেই ঈশ্বরদী জংশন ধরে এসে এখানে নামা। ব্রডগেজ থেকে ন্যারোগেজে এবার যাওয়া। টুকুস টুকুস। ট্রেন তো নয় যেন গফুর ভাইয়ের গরুর গাড়ি। দুপুরে রেলওয়ের ক্যাটারিংয়ের তদারকিতে খাওয়া। সাদা ড্রেস, বরের মতো পাগড়ি পরা পরিবেশক। ওরা চাটনিটা যা বানাত না! আলুবোখারা-খেজুর-কিশমিশ দিয়ে। ওটাই জিভে লেগে আছে...।
আর নিতান্তই ভদ্রলোক বড় ভাই এ সময় হাফ প্যান্টের আমলে চলে যায়। তখনো গোলাবাড়ি ইস্টিশান হয়নি, তাই নাচোল ইস্টিশান এলেই আমাদের মনে হতো বাড়ি চলে এসেছি। কারণ, এদিকটায় নানা-দাদাদের যত জমি-টমি। নানার বাথান বাড়িটা ট্রেন থেকেই দেখা যেত। তালগাছ ঘেরা মাটির বাড়ি। পাশে ছোট্ট ডোবা। প্রাচীন এক তেঁতুলগাছ ছায়া দিয়ে তাকে শীতল করে রেখেছে। নানার সাঁওতাল দফাদার মাতলা মাঝি মামার বউ রেণুবালা মামি গোটা বাড়িটাকে লেপে-পুছে তকতকে করে দেয়ালে আঁকত খড়িমাটির আলপনা। ধান ওঠার সময় নানা আমাকে বগলে চেপে নিয়ে যেত সেখানে। দু-চারদিন থাকতাম। পুরোপুরি স্বাধীন জীবন। রোদে ঘুরে ঘুরে চেহারাই পাল্টে যেত। রোগক্ষমতা বাড়ত। খেতে পারতাম প্রচুর। বাগাড়ু পাখির সালুন, ঘুঘুর ভুনা, কবুতরের পাতলা ঝোল, পুঁটি মাছের টক... খেজুর রসের মধু দিয়ে পুয়া। একবার নানার দোস্তরা এল আড্ডা মারতে। রীতিমতো মোচ্ছব লেগে গেল তখন। নতুন ধান বিক্রির কড়িতে পকেট গরম বোঝ না! সুতরাং লাগাও খানাপিনা। তাস পেটাই চলল অনেক রাত অব্দি। মানে জুয়া আর কী। আলতুশ নানা রিফিউজি বলে টাকাটা ভালোই বোঝে। সে একাই গোহারা করে দিল সবাইকে।
মোড়লমামু তো খেপে একসা, তার ওপর পেটে পড়েছে লাল কাঁকড়ার ঝাল আর ধেনো কী তালের তাড়ি; সুতরাং তাকে আর পায় কে, টগবগ করে ফুটতে ফুটতে নিচে নেমে এসে দুহাত তুলে মাথার চুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে 'হাম নেহি হারে গা' বলতে বলতে কী নাচ যেন সাক্ষাৎ কালভৈরব নেমে এসেছে উঠোনে এমন অবস্থা। ধান কাটুনেরা ঘুম থেকে জেগে দুচোখ ডলে রগড় দেখতে বসে গেল যেন ভিসিআরে সিল্কস্মিতার সিনেমা চলছে। তখন এমনটাই ছিল। ঝগড়াঝাঁটি-কাজিয়া চিত্র, ভিলেজ পলিটিকস, বৎসরান্তে সার্কাস কী যাত্রাপালা কী মহররমের মেলা কী নৌকাবাইচ কী লুকিয়ে-চুরিয়ে ভিসিআরে থ্রি-এক্স সিনেমা দেখা, না হয় পূর্ণিমা রাত্তিরে মাদলের তালে তালে নৃত্যপর সাঁওতাল কন্যাদের যৌবনবিভা দেখতে দেখতে একটু মহুয়া চেখে দেখা(এই-ই তো কী বলো? তখন প্রেম-টেমও সরল-সাদা ছিল, সাদাকালো সিনেমার উত্তম-সুচিত্রার মতো। জানালার ফাঁক দিয়ে চোখাচোখি কী নোট দেবার ছলে আঙুলে আঙুল ছোঁয়া। অবশ্যি তখনো ইলোপ করা ছিল, খুনখারাবিও কম ছিল না। এক নীহারবানু হত্যাকাণ্ড গোটা উত্তরাঞ্চলের ভোলাভালা আবহাওয়াকে এক নিমেষে বদলে ফেলেছিল। আর এখন তো সব খোলামেলা। প্রযুক্তি টোটাল পৃথিবীকে তোমার হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। তুমি টিভি চালাও। দ্যাখো বোকা বাক্সটা কতশত চ্যানেল উগরে দিচ্ছে। কতশত কন্টেন্ট তাদের। কম্পিউটার, মুঠোফোন তাদের অন্তর্জালে তোমাকে এমনভাবে আটকে দিচ্ছে যে তুমি চাইলেও সেই জাল কেটে বেরিয়ে আসতে পারবে না। তুমি অবারিত আকাশ-রৌদ্র-জ্যোৎস্না-বৃষ্টি দেখতে চাও তোমার দৃষ্টি স্ক্রিনে থাকতে থাকতে প্রায় ঘোলাটে, ফুলের গন্ধের চেয়ে রুম ফ্রেশনার উত্তম তোমার কাছে, গরম ভাতের চে ম্যাকডোনাল্ডস... আধো ঘুম আধো জাগরণের ভেতর বড় ভাই বিড়বিড় করছিল।
আতিক ঘড়ি দেখল। প্রায় আটটা। আজ সারা দিন বাবু ডাইংয়ে থাকবার কথা ছিল তার। ইনাম ভাই, তারেক অনু, আজাদরা নিশ্চিয়ই এতক্ষণে ঐ অভয়ারণ্যে ঢুকে পড়েছে। খুঁজে পেতে দেখছে রাতচরা পাখিদের গতিবিধি। কদিন আগেই সে খোঁজ পেয়েছে বাবু ডাইংয়ে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে ল্যাঞ্জা রাতচরা, মেঠো রাতচরাদের। শুনে ইনাম ভাই দেরি করেন নাই। ঢাকা থেকে সোজা এসে পড়েছেন। কিন্তু রেজিস্ট্রির দিন পড়ে যাওয়ায় আতিকের যাওয়া হলো না। ফুফাদের অবশ্যি দোষও দেয়া যায় না। সপ্তায় মাত্র ২ দিন মঙ্গল ও বুধ গোমস্তাপুর অফিসে কাজ হয়। বাকি দিন নাচোলে। সুতরাং তাড়া তো থাকবেই। আসলে জমি-টমি বিক্রির ব্যাপারটা তেমনভাবে তাদের মাথাতেই ছিল না। কিন্তু আব্বা মারা যাবার এক বছরের মাথায় বিষয়টা সামনে চলে এল। চেনাজানা অনেকেই নক করতে থাকল নানাভাবে। আম্মা এসব কথায় অস্থির হয়ে পড়তে লাগলেন। কেননা তাঁর ছেলেমেয়েদের বৈষয়িক বুদ্ধি একেবারেই নাই।
বাপের মতো বুদ্ধি থাকলে এদের একেকজনের দু-তিনটে করে ফ্ল্যাট থাকত আজ। আসলে এদের পায়ের তলায় সরষে আছে। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে। আজ এখানে তো কাল ওখানে। ৪টাই অমনধারার। কেবল ছোটটা একটু নাজুক হয়ে পড়েছে বউটা চলে যাবার পর। রাজশাহীর বাইরে তেমন যায়-টায় না। আর্ট কলেজে পড়ানো কী গিটার বাজানো কী নানান ভাষা শেখা-টেখা(এই নিয়েই আছে। তবে তার নেশা পাখি দেখা এবং তাদের ছবি তোলা। বিদেশি পত্র-পত্রিকায় নিয়মিতই তার তোলা এসব ছবি বেরোয়-টেরোয়। দু-একটায় তো রীতিমতো পুরস্কার-টুরস্কারও পেয়ে গেছে। ইনাম সাহেব মাঝে-মধ্যে তাকে ডাকেন, আতিক চলো এবার বান্দরবানের দিকে যাই। পাহাড়ি টিয়ার ঝাঁক কীভাবে সূর্যমুখীর হলুদ বাগানকে সবুজ রং দিয়ে ঢেকে দেয়, তা দেখবে চলো। কিংবা কক্সবাজারের সৈকত ছুঁয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই ঐ ছোট্ট দ্বীপটায় যেটায় লাল কাঁকড়ারা রৌদ্রস্নান করে বলে দূর থেকে রক্তস্নাত দ্বীপ বলে ভুল করে সবাই...। কিন্তু আতিক সরে গেলে আম্মার কী হবে? কোলপোঁছা ছেলে, দশ কাঠার ওপর দাঁড়ানো এই বিশাল বাড়িটায় সে ছাড়া আর কেই বা আছে! তো লোকজন টেলিফোনে কিংবা সামনাসামনি জমি-টমি বিক্রি-বাটার কথা শুরু করলে তারা নিজেরাও একটু চিন্তাভাবনা শুরু করে।
আব্বা কত কষ্ট করে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে জমিগুলো কিনেছিলেন। সেটাও রাজশাহীর চাকরিতে যোগদানের পর। এর আগে পাবনায় চাকরি করার সময় স্যামসন কাকায় অনেকবার বলেছেন তাঁর সঙ্গে কাজ করতে। গ্ল্যাক্সো ডেকেছে। এডরুকের সিদ্দিক চাচা আজীবন থাকতে বলেছেন। কিন্তু আব্বা তত দিনে বিলাতি অভ্যস্ততা ছেড়ে মাটির কাছে ফিরতে চেয়েছেন। বিলাসিতায় নয়, ছেলেমেয়েরা কাদামাটি ঘেঁটে বড় হোক এটা চেয়েছেন। চেয়েছেন নিজস্ব সংস্কৃতি-ঐতিহ্য চিনে মানুষ হোক তারা। এরই মধ্যে একবার বৈঠকঘরে টাঙানো রবীন্দ্রনাথের বিশালকায় ছবি দেখে বাড়িঅলার এনএসএফ করা ছেলেরা হুমকির স্বরে 'হিন্দু কবির ছবি টাঙায় রাখসেন ক্যান, মহাকবি ইকবালের ছবি রাখতে পারেন না?' বললে আব্বা কদিনের ভেতর বাড়ি বদলে ফেলেন। এবারের পাড়াটা সহনশীল। পাশের বাড়ির টরিক কাকায় গলায় এ্যাকার্ডিয়ান ঝুলিয়ে বিদেশি গৎ বাজান, উল্টো দিকের আমজাদ সাহেবের বাড়ি থেকে নূপুরের শব্দ ভেসে আসে। বুড়ো এক তবলচি সঙ্গে করে মাকুন্দ এক নাচের মাস্টার ওবাড়ি যায় নাচ শেখাতে। রেগুলার। সন্ধ্যের সময়। পাড়ার লোকে বলাবলি করে, নাচ শেখানো না ছাই। বাতের ব্যামোয় হাঁটতে পারে না বলে আমজাদ সাহেব এখন নিজের ঘরেই মাহফিল বসায়। একাই পান করে আর ঐ মাকুন্দ মাস্টার গলায় একটা জড়িদার ওড়না জড়িয়ে সাকীর ভূমিকা নেয়। এদিকে আমাদের এই নতুন বাড়ির বৈঠকঘর গমগম করে এডওয়ার্ড কলেজের উজ্জ্বল ছাত্রদের ভিড়ে। রাজশাহী থেকে কামারুজ্জামান হেনা চাচা, অ্যাডভোকেট সালাম চাচা আসেন। কখনো বগা চাচা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় আব্বা হেনা চাচাদের নিয়ে কখনো ঢাকা কখনো কুমিল্লার বর্ডার এলাকা ঘুরে আসেন।
দেশের অবস্থা উত্তপ্ত। টাউন হোস্টেল কাছে হওয়ায় ছেলেদের মারফত সব খবর দ্রুত পাওয়া গেলেও আব্বার মন পাবনা থেকে উঠে যায়। ওষুধ কোম্পানির মালিকপক্ষ মুসলিম লীগ ভাবাপন্ন এটাই তাঁকে হতোদ্যম করে দেয়। তিনি চাকরি ছেড়ে অতঃপর রাজশাহী চলে আসেন। বড় বোন স্মৃতিচারণা করে ঐ সময়ের। তালাইমারীর এক ছোট্ট বাড়ি। ঠাসাঠাসি ঘর। ব্রেকফাস্টে জ্যাম-মাখন নাই। ব্রেড নাই। বদলে তাওয়ায় সেঁকা লাল আটার রুটি। আলু ভাজা কী সুজি। কী অবস্থা! গিলতে কষ্ট হয়। আম্মা বলেন, এখন থেকে এসবই খেতে হবে। এসবেই অভ্যস্ত হতে হবে বুঝেছিস। তো আব্বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতে করতেই দাদার সুপারিশে দেশের বাড়িতে জমি কেনা শুরু করেন। একটু একটু করে বাড়তে থাকে সেই জমির পরিমাণ। বাৎসরিক চাল, মসুর ডাল, সরষে, দিশি/// গম, পেঁয়াজ-রসুন খুব দ্রুতই আসা শুরু করে সেই জমি থেকে। উদ্বৃত্ত থাকত না। কেননা বাড়িভর্তি তখন লোক। আমরা ৪ ভাই বোন, কলেজপড়ুয়া মামা, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ নেয়া কাকা-ফুফা-চাচাতো ভাই-বোন জামাইয়ের সঙ্গে যুক্ত হতো মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাপ্রার্থী নানান কিসিমের রোগী এবং তাদের বাড়ির লোক। এদের ঠেলায় কোনো দিন সুখী পরিবারের মতো আব্বা-আম্মা-ভাই-বোন খেতে বসেছি এমন ছবি বিরল। তবু আম্মা হাসতেন। আব্বা হাসতেন। ছবিটা খুব মনে পড়ে। যেন এভাবেই বাঁচতে হয়। একা নয়। সবার সঙ্গে জীবন ভাগাভাগি করে বাঁচা।
আমনূরা ছাড়ছি। এখন নাচোলে ঢুকছি। ড্রাইভারের গলায় ছোট বোনের ঘুমের হালকা আমেজ কেটে যায়। ঐ যে দ্যাখো সাঁওতাল মেয়ের দল। প্রিন্টেড শাড়ি। চূড়ো খোঁপা। সারি বেঁধে সরষের হলুদ বন্যা ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওদিকে তো রহনপুর এলাকা। এদের তো যাওয়ার কথা বর্ডার এলাকার দিকে। ছোট বোনের চোখের ওপর স্বপ্ন স্বপ্ন ছায়া। ঐ যে পাঁচ নম্বর মেয়েটা। ওর হাঁটায় আদিবাসী ছন্দ নাই। দেখতেও শুকনা শুকনা। ও কী আমাদের রামচন্দ্রপুরের জমিদারপুত্র রমেন মিত্রর নতুন বউ ইলামিত্র নয়? যার নামে ছড়া কাটে সারা নবাবগঞ্জ। ইলা মৈত্রী নারী/আইন করল জারি/আধি জমি তেকুটি ভাগ/জিন হলো সাত আড়িরে ভাই/জিন হলো সাত আড়ি...। কিন্তু রহনপুর এলাকায় পাকিস্তান সরকারের পেটোয়া বাহিনী ছাউনি ফেলেছে। যেকোনা মূল্যে তারা তেভাগা আন্দোলনের লোকজনকে ধরবে বলে চিরুনি তল্লাশি শুরু করেছে। নাচোল এলাকার দশ-বারোটা গ্রাম মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা হয়েছে তবু রমেন মিত্র-ইলা মিত্রদের সন্ধান পাওয়া যায় নাই। এখন রহনপুরের গ্রামগুলো তাদের লক্ষ্য। অথচ সাঁওতালি কন্যার ছদ্মবেশে ইলা মিত্র কিনা দিক ভুলে ওদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। ছোট বোন তাদের থামানোর চেষ্টা চালায় ঘুমের ভেতর। ডান হাত উঁচিয়ে বিড়বিড় করে, থামো, থামো। কিন্তু তাদের থামার কোনো লক্ষণই নাই। এদিকে বড় বোন খাবারের বাস্কেট থেকে ডিম সেদ্ধ বের করে। ছোট, খাবি? ছোট বোন শিউরে ওঠে। তার মাথায় তেভাগার অঞ্চল পাক খায়। রহনপুর ইস্টিশানের এক শ বছরের পুরোনো তেঁতুলগাছ, কপিকল লাগানো ছোট ইটের গাঁথুনি দেয়া ইঁদারাটা পাক খায়। পাক খায় নাচোল থানার কর্কশ অন্দর। রহনপুর থেকে গ্রেপ্তার করে আনা ইলা মিত্রদের এখানেই চালান করা হয়। নিষ্ঠুর, ক্রুর ছবি ধারণ করা আছে তাঁর জবানবন্দিতে:
ক. আমার যেহেতু বলার কিছু ছিল না কাজেই তারা আমার সব কাপড়-চোপড় খুলে নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গভাবে সেলের মধ্যে আমাকে বন্দি করে রাখে। আমাকে খাবার দেয়া হয়নি। এক বিন্দু জল পর্যন্ত না। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় এস আই এর উপস্থিতিতে সেপাইরা তাদের বন্দুকের বাঁট দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে শুরু করে। সে সময় আমার নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়তে থাকে। এরপর আমার কাপড় চোপড় ফেরত দেয়া হয়।
খ. রাত প্রায় ১২ টার সময় সেল থেকে আমাকে বের করে সম্ভবত এসআই এর কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়... সেখানে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নানারকম অমানুষিক পদ্ধতিতে চেষ্টা চালাল। দু'টো লাঠির মধ্যে আমার পা দুটি ঢুকিয়ে চাপ দেয়া হচ্ছিল এবং সে সময় চারধারে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা বলেছিল যে আমাকে 'পাকিস্তানী ইনজেকসন' দেওয়া হচ্ছে। এই নির্যাতন চলার সময় তারা একটা রুমাল দিয়ে আমার মুখ বেঁধে দিয়েছিল... আমার চুলও উপড়ে ফেলছিল।
গ. সেলের মধ্যে আবার এসআই সেপাইদের চারটে গরম সেদ্ধ ডিম আনার হুকুম দিল এবং বলল, 'এবার সে কথা বলবে।' তারপর চার-পাঁচজন সেপাই আমাকে জোরপূর্বক ধরে চিত করে শুইয়ে রাখল এবং একজন আমার যৌনাঙ্গের মধ্যে একটা গরম সেদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দিল। আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন আগুনে পুড়ে যাচ্ছিলাম।
ছোট বোন ঘুমের চটকা ভেঙে হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো কাঁপতে কাঁপতে বড় বোনের হাত থেকে সেদ্ধ ডিম কেড়ে নিয়ে জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলল। এটা নাচোল এলাকা বুঝলে। এটা নাচোল। নাচোল। আর তেভাগা আন্দোলনের ৫০ বৎসর পূর্তি উদ্যাপন অনুষ্ঠানের চা বিরতিতে ইলা মিত্র আব্বাকে বলেছিলেন, আপনারা কৃষককে বাঁচান। কৃষক বাঁচলে জমি বাঁচবে। জমি বাঁচলে রাষ্ট্র। আতিক সময় দেখল। সাড়ে আটটার দিকে যাচ্ছে। এ রাস্তা মেন রাস্তা নয়। ড্রাইভার সময় বাঁচাতে অন্য এক পথ ধরেছে। দুপাশে তুঁতগাছের সারি। 'সিল্ক হেভেন' তকমা পাওয়ার পর নতুনভাবে পরিচর্যা হচ্ছে এসব গাছের। খুঁজলে এঘর-ওঘরে রেশমগুটির আবাসও পাওয়া যেতে পারে। সুতো কাটার চরকাও। কিন্তু আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে ইদানিং পলু পোকার চাষে ধস নেমেছে। অতিরিক্ত উষ্ণতা ও আদ্রতায় রেশম পোকা বাঁচতে পারছে না। এখন গবেষকরা দিশি পোকার সন্ধান করছে ঐ যাদের সব ধরনের আবহাওয়ায় খাপ খাইয়ে নেবার ক্ষমতা আছে। তুঁতের সারি শেষ। এখন বরই আর পেয়ারাবাগান চলছে মাইক্রোর সঙ্গে সঙ্গে। পেছন দিকটায় আমবাগান। সারসার। মানে আমরা যে ট্রেনের জানালা দিয়ে অবারিত ফসলের জমি দেখতাম সেগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে ফলচাষিদের কাছে। অল্প পরিশ্রমে বেশি মুনাফা। তিন মিনিটের নুডুলস থিওরি। দ্রুত লাভ। ওসব ধান-টানের হ্যাপায় কে যায় কহেন? মামাতো ভাইদের সোজাসাপ্টা কথা। আব্বাদের আমল আর নাই যে রোদে, বৃষ্টিতে ভিজে জমি দেখে বেড়াব। আইধররা চুরি-চামারি করছে কি না, সেই হিসাব মিলাব। দিনের পর দিন পড়ে থাকব বাথানে। এরচে বাগান করা সহজ। বরই, পেয়ারা, মালটা, ড্রাগন। তুমি চেয়ারে বসে পা নাচাবা আর চায়ে চুমুক দিবা। দেখবা পাইকাররা এসে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকছে। শুনে মেজ মামা স্যান্ডেল উঁচিয়ে এই মারে কী সেই মারে। শালার বেটা শালা। ভাত কোথায় পাবি ধান না বুনলে? ঐ বালের ফল খ্যায়া প্যাট ভরবে? মেজ মামার এটা বলা সাজে। আতিক খেয়াল করেছে একদা তার ৫ নানায় শ শ বিঘা খেত-খামার নিয়ে যে পদস্থ চাষির জীবন যাপন করেছে সেই অতীত-গৌরব আর থাকেনি।
লেখাপড়া জানা মামারা এদিক-ওদিক চাকরি নিয়ে শহরবাসী, বছরে দু-একবার আসে। তাদের হিস্যার হিসেব বুঝে নিয়ে ফের চলে যায়। বাকিরা কাছে-পিঠের স্কুলে মাস্টারি, মুহুরি কী কেরানিগিরি কী দোকানদারির দিকে ঝুঁকে পড়লে চাষাবাদে একনিষ্ঠতা হারাতে থাকে। নানারা বেঁচে থাকতেই দেখে গেছেন প্রায় শূন্য কুঠিঘর। গোলাঘরের গা বেয়ে জঙ্গুলে লতা বাড়ছে। শরিকে শরিকে মন কষাকষি, ভাগাভাগির দেয়ালে হতশ্রী ৫ বাড়ির সৌন্দর্য। গোয়ালঘর উজাড়। রাখালদের আর হইচই নাই। নিমফুল জ্যোৎস্নার আঙিনায় আর ডাংগুলি খেলতে কেউ ছড়া কাটে না, এউরি দেউরি তিলিয়া চউরি...। ৫ ঘরের ১৪ পুত্র। অথচ এদের মধ্যে মেজ মামাটাই একটু অন্য ধাঁচের। যে স্কুলে মাস্টরি করতে করতে জমির শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবে, উন্নত মানের বীজ-সার নিয়ে ভাবে। বিশ্বাস করে জমি নারীর মতো। তার পরিচর্যা করো, তাকে ভালবাসো(দেখবে সে তোমাকে ফেরাবে না। কিন্তু আমাদের ব্যাপারটা আলাদা। আতিক নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে। আব্বা মারা যাবার পর একরকম বাধ্য হয়েই ফসলের জমিগুলো বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। মেজ মামার বারণ সত্ত্বেও। কেননা এত দিন আব্বা ছিলেন। ঘন ঘন দেশের বাড়িতে যেতেন। খোঁজখবর রাখতেন। এখন কে এসব করবে?
বড় ভাই ঢাকায়। তারা ৩ জন রাজশাহীতে থাকলেও জমিবিষয়ক ঝঞ্ঝাট কেউ পোয়াতে চায় না। এই যে আব্বার দু-দুইটা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে অর্থকড়ি জমে আছে সেগুলো আম্মার অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা দরকার(সেটাই এখনো করা হয় নাই। কেবল পেনশনের ব্যাপারটা সারা হয়েছে। আম্মা পাচ্ছেন। ফুফারা অবশ্য বলেছিলেন, তোমার আব্বা যাদের দিয়ে জমি করাতেন তারাই করবে। আমরা দেখেশুনে বুঝিয়ে দেব তোমাদের। অসুবিধা হবে না। কিন্তু আম্মা জানেন ঈশপের গল্পটা। প্রকৃত মালিক ছাড়া সব কথাই ফিকে হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং যা করার আমাকেই করতে হবে। বলে বৈঠকে বসে গেলেন ফুফাদের নিয়ে। ঘরের জমি ঘরেই থাকবে, বাইরে যাবে না এমন ভদ্রতা এখনো বহমান বলে সাব্যস্ত একরকম হয়েই গেল জমিগুলো তারাই নেবেন। দাম-টামে অবশ্যি একটু ঝামেলা বেধেছিল। বাজারদর থেকে কমেই দিচ্ছে তারা তবু অসন্তোষ। ফুফাতো ভাইদের যত সব কথার মারপ্যাঁচ, হট্টগোল। নতুন ফসল উঠে গেছে এসব কথার অনেক আগেই তবু তারা ফসলের ভাগ চায়। শেষে অতিষ্ট হয়ে আম্মা সেসবও ছেড়ে দিলে হট্টগোল কমে। হাসি ফোটে মুখে। আম্মা বললেন, দেখছিস তো তোরা... দেখছিস তো। আমি বেঁচে আছি বলে যাও পেলি-টেলি, মরে গেলে কিছুই পেতি-টেতি না। এখন ভালোই ভালোই রেজিস্ট্রির ঝামেলা চুকিয়ে ফেলতে পারলে বাঁচি। আতিক হাসে। আম্মার মাথা তার কাঁধে। পান-সুপুরি-বাবা জর্দার খুশবু পাওয়া যাচ্ছে। কেমন ছেলেবেলা ছেলেবেলা গন্ধ। বুকটা ভরে যাচ্ছে।
আবদুল মান্নান ঠিক এই সময় ফোন দেয়। কদিন ধরেই ফোনে লেগে আছে সে। নদিয়াড়ি যাবার জন্য। ওখানকার ৬ বিঘার ওপর দাঁড়ানো আমবাগানটা নানার নিজের হাতে সাজানো। গোপালভোগ, ক্ষীরসাপাতি, ল্যাংড়া, রাণীপসন্দ, সুরমা ফজলি—এমনকি আচারের জন্য মোহনভোগ, সিঁদুরে আমের গাছও মজুত ওখানে। একমাত্র কন্যার জন্য এরচে ভালো উপহার আর কী হতে পারে! মামারা গোস্যা করবে বলে তাদের জন্যও প্রস্তুত আশ্বিনা বাগান। দামুসের পাড়ের ঐ বাগান প্রতিবছর ভালো ফলন দেয়। কিন্তু নদিয়াড়ির সমস্যা অন্যখানে। একে পুরোনো গাছ তার ওপর বিষ প্রয়োগে প্রয়োগে জীর্ণ-দশা। মেজ মামা দূর থেকে আর কত দেখবে এই মওকায় সরকারি রাস্তার পাশে যে ক-ঝাড় উদ্বাস্তু ঘরটর বানিয়ে বসতি গড়ে তুলেছে, তাদের পোয়াবারো। তারা একটু একটু করে আমগাছের ডালটাল ছাঁটতে ছাঁটতে জায়গা দখল করা শুরু করেছে, সুতরাং এর বিহিত করতে অন্য পন্থায় যেতে হবে। প্রায় বন্ধ্যা ঐ গাছগুলো আবদুল মান্নান কিনে নিক। ইটভাটার সিজন চলছে। প্রচুর লাকড়ির দরকার এখন। তাই গাছের কদরও খুব। একটা তো নয়, পুরো ৪৫টা গাছ। সুতরাং ভালো দামেই বিকোবে। এক মাস সময়। সে গাছটাছ কেটেকুটে শেকড়-বাকড় তুলে মাটি সমান করে দিয়ে চলে যাবে। এরপর আসল কাজ। যেহেতু গ্রাম বাড়ছে সেহেতু ঘরবাড়ি তৈরির জন্য জমির দরকার হচ্ছে। তোমাদের এই বাগান মেন রোড লাগোয়া বলে এর ডিমান্ড বেশি। ৬ বিঘা নানা মাপে প্লট করে ছেড়ে দাও। এরপর দ্যাখো ভানুমতি কা খেল। আমার বুবু কোটি কোটিপতি বনে যাবে। শুনে আম্মার কোনো ভাবান্তর হয় না। বরং তাঁর যত উৎসাহ আব্বার জমিগুলোর ব্যাপারে। এই যে কদিন ধরে ধুন্ধুমার শীত এখানে। কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া কাটতেই চাইছে না। আম্মার নিজের শরীরও ভালো নয়। শরীর থেকে লবণ চলে যাচ্ছে তাই বাড়তি লবণ, ওষুধপাতি খেতে হচ্ছে। কিন্তু জমি রেজিস্ট্রির কথা শুনে ঠিকই ভোর ভোর উঠে পড়েছেন। মোজায়-সোয়েটারে-শালে মুড়িয়ে একেবারে রেডি। বরং বড় ভাই-ই গাঁইগুঁই করে। লেপের ওম ছেড়ে বেরোতে চায় না। আমার কী যেতেই হবে, সইটই কী করতেই হবে?
ছোট বোন চোখ পাকিয়ে বলে, যেতে তো হবেই। ওঠো। ওঠো। আব্বার ওয়ারিশন তুমি। ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনারের সই করা ওয়ারিশন সার্টিফিকেটে তো দেখছি আম্মার পরেই তোমার নাম। সুতরাং তোমাকে উঠতেই হবে। ওঠো। আতিক চা খেতে খেতে ভ্রু কোঁচকাল। আব্বার পেনশন আম্মার নামে ট্রান্সফারের জন্য অনেক ধরনের প্রমাণপত্র লেগেছে। এর মধ্যেই একটির ভাষা তার একেবারেই মনঃপুত হয় নাই। কী অস্বস্তিকর ব্যাপার। প্রত্যয়নপত্রটি এ রকম:
আমি এই মর্মে প্রত্যয়নপত্র প্রদান করিতেছি যে, লতিফা কায়েস, স্বামী: মৃত প্রফেসর মুহাম্মদ কায়েস উদ্দিন, মাতা: মৃত কমিরুননেসা, মহল্লা: কাজলা, হোল্ডিং নং ১৩৪, ডাকঘর: কাজলা-৬২০৪, থানা: মতিহার, জেলা: রাজশাহী কে ব্যক্তিগতভাবে চিনি ও জানি। তিনি অত্র ২৮ নং ওয়ার্ডের একজন স্থায়ী বাসিন্দা। আমার জানা মতে তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন নাই এবং তিনি আরও অঙ্গীকার করেন যে, আগামীতেও পুনর্বার বিবাহ করিবেন না।
আমার মায়ের জন্য কী অপমানকর অনুভূতি! আতিকের হাত নিশপিশ করে উঠছিল বারবার। কারোর কলার ধরতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কার কলার বলতে পারো?
জানালার বাইরে রোদ ফুটে উঠছে। দূরে রেললাইন। একটা অলস মালগাড়ি অনিচ্ছুকভাবে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ তুলে এগোচ্ছে। সামনে কোন ইস্টিশান, গোলাবাড়ি? এ জায়গাটা গঞ্জ মতন। দোকানপাট, স্টলের কমতি নাই। খড়ের গোল ছাউনির নিচে কলাইরুটি বানাতে বসেছে এক মহিলা। মাটির আখায় বেগুন পুড়ছে। বড় ভাই উত্তেজিত। তোরা খা বা না খা। আমি খাবোই। এই ড্রাইভার রোকো। তখন কী আর করা। নামতেই হয়। যদিও আমাদের কারোর দাঁতই ঠিকঠাক নাই। আমারগুলো ডাক্তার রাজুর হাতের ক্যারিশমায় টিকেটুকে আছে। অধিকাংশই রুটক্যানেলের শিকার। নো হাড্ডি। নো পেয়ারার বিচি। কিন্তু মহিলার রুটিতে ভেজাল নাই মনে হচ্ছে। বেগুনগুলোও তাজা। তাহলে তো টেস্ট করতেই হচ্ছে। দাঁতটাত চুলোয় যাক। আতিক রুটি থেকে কড়কড়ে বুকলা তুলে চিবোতে চিবোতে লক্ষ করল গোলাপি-সাদা স্কুলড্রেস পরা ছাত্রীরা দল বেঁধে স্কুলে যাচ্ছে। মাথা হিজাবে ঢাকা। দু-তিনজন মিসট্রেসকেও দেখা গেল সঙ্গে যেতে। গোলাপি শাড়ি, সাদা অ্যাপ্রোন। যথারীতি তাদেরও মাথা ঢাকা।
আমি বড় বোনের দিকে তাকালাম। এখনো কত চুল তার মাথায়। তার হাঁটু অব্দি লম্বা যে চুল একদা ছেলে-ছোকরাদের মাথা ঘুরিয়ে দিত, তারা জীবনানন্দ কী বোদলেয়ার কোট করে চিঠি লিখত(এখনো সেই চুল কত মায়াময়। ঐ যে মাচায় বসে রুটি খাচ্ছে। খোলা চুল, কপালে বড় টিপ, সিম্পল একটা তাঁতের শাড়ি পরা(সহজ-সরল বাঙালিয়ানা কি একেই বলে না। অথচ ঐ খোলা চুলের ওপরই আমাদের যত রাগ যত আক্রোশ। আমরা তাই সেগুলো ঢেকে দেয়ার ব্যবস্থা করি। কেউ একটু চুল দেখিয়েছে কী সঙ্গে সঙ্গে তাকে তুলে কারাগারে নিক্ষেপ করি। বিদ্রোহী হওয়ার ফল সে ভোগ করুক কিংবা মারা যাক(তাতে কারও কিছু যায় আসে না। বরং এসব কিছুর মধ্যেই খবর আসে আফগানিস্তানে নারীর উচ্চশিক্ষা বন্ধ। আর আমাদের বোকাবাক্সে হিজাবফ্রেশ শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন ভাসতে থাকে তখন, ইরানি-পাকিস্তানি বোরকা জৌলুস ছড়ায় দোকানে দোকানে। বড় বোন হাত ধুতে ধুতে বলে, যখন ক্লাস নিতে যাই বুঝলি তখন মনে হয় আমি যেন আরবি-ফারসির ক্লাসরুমে চলে এসেছি। এ কিছুতেই সাহিত্যের ক্লাস হতে পারে না। কিছুতেই না। আতিক হাসে। তাহলে ভাবো একবার আমার অবস্থা! কিন্তু কিছু বলে না। মাইক্রোর সামনে বাঁদুরে টুপি পরা কে এক লোক আম্মার সঙ্গে কথা বলছে হেসে হেসে। কাছে এগোতেই চিনতে পারলাম মোসতা কাকা। সে আবার এখানে কী করছে। তার তো থাকার কথা রেজিস্ট্রি অফিসে ফুফাদের সঙ্গে। অবশ্য সকাল ১১টায়। এখন তো কেবল সাড়ে আটটা। বলল, সারের টাকা দিতে এসেছে। এই যে এই দোকানটা তার বড় সম্মন্ধির। বেশ বড়সর দোকান। প্রোপাইটার কাজী আনোয়ার হোসেন। দেখতে অবিকল তাঁরই মতো। আমাদের ছেলেবেলার 'কুয়াশা' সিরিজ আরেকটু বড় বেলার 'মাসুদ রানা'র জনক। আব্বার বন্ধু ছিলেন। কিন্তু বেশি বলতেন তাঁর বাবা কাজী মোতাহার হোসেনের কথা। কেননা আব্বা দাবা অনুরাগী ছিলেন।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে তাঁর দাবা খেলা দেখতেন। তো পাশটাশ করার পর যখন ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছি, তখন ধ্রুবদার মাধ্যমে একদিন ঢুকে পড়েছিলাম সেবা প্রকাশনীতে। আঁকতে-টাকতে জানি, তার ওপর অনুবাদের হাত খারাপ নয়। কাজী চাচা প্রথমেই ধরিয়ে দিলেন লুইজা মে স্কটের উপন্যাস। অনুবাদ করে আনো। তারপর দেখছি কী করা যায়। বলে চা-টা খাওয়ালেন। আব্বার খোঁজখবর নিলেন। যদিও তখনো শেখ আবদুল হাকিম তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলেন নাই, বলেন নাই... একটা মানুষ যিনি পরের নামে লেখেন তাঁর তো নিডি অবস্থা। আমারেও লিখতে হইসে। নিজের জন্যি, পরিবারের জন্যি। এহন আমারে যদি জিগান আপনে জাইন্যা-শুইন্যা ক্যান অন্যের নামে ল্যাকতে গেসেন, তাইলে হ্যার জবাব আমি দিবার পারুম না। আমি করতে বাধ্য হইসি। আমি মাসুদ রানা লিখসি উনি কিইন্যা লইসেন। দয়া কইরা বছরের পর বছর টাকা দিসেন। আমারে বাঁচাইসেন... কিন্তু যহন আমি আইন জানসি তহন আমার এই পোড়া চোখ খুইল্যা গেসে।
আতিকের নিউজক্লিপিংস সব মনে আছে। কাজী চাচা বলেছিলেন, শেখ আবদুল হাকিমের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করার প্রয়োজন মনে করিনি। সে অনেক ছোট বয়সে আমার কাছে এসেছিল। আমি তাকে খুব স্নেহ করতাম। হাত ধরে ধরে অনেক কিছু শিখিয়েছি কিন্তু আস্তে আস্তে অন্য রকম হতে শুরু করল সে। বদলাতে শুরু করল। সে যে এমনটা করবে এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। কেউ যদি ডিফেম করে তাহলে তো আমি ঠেকাতে পারব না। সে এবং আমিন আমাকে বলেছিল, তাদের কথামতো ২ কোটি ৯ লাখ টাকা যদি আমি না দিই, তাহলে তারা আমার ঘুম হারাম করে দেবে। এই হুমকি দিয়েছিল ২০১০-এর আগে। আর হাকিম বলেছিলেন, গোলমাল তো একটা হইবই। আমার বই তারা ছাপতাসেন কিন্তু খাতায় তুলতাসেন না। এইটা তো সিরিয়াস একটা সমস্যা। একটা বই হেরা ছাপলেন ৬০ হাজার কপি অথচ আমারে দেখাইতাসেন ৭ হাজার। আমি তো ৫৩ হাজার বইয়ের পয়সা পাইতেসি না, এইটার জবাব কী হইতে পারে, কইতে পারেন আপনেরা?
আতিক অনুবাদটা শুরু করেছিল। সিরিয়াসলি। কিন্তু শেষ করার আগেই বেসরকারি কলেজে চাকরি হয়ে যাওয়ায় রাজশাহী ফিরে আসে সে। সাধে কী লোকে বলে, রাজশাহী অঞ্চলের লোক বিশেষত চাঁপাইয়ের লোকজন মায়ের কোলের কাছে থাকতে ভালোবাসে। এদের একটা আমবাগন আর কিছু ধানি জমি থাকলেই চলে। আতিকের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি। অনেক ধরনের সুযোগ তার ছিল। গিটারের জন্য। আর্টের ওপর বড় ডিগ্রি করার জন্য। ভাগনিটা মিউনিখ থেকে খবর পাঠায়, মামা এসব জায়গা তোমার জন্য। একবার আসো। ঘুরে যাও। এক একটা মাস্টারপিস দেখবা আর আকুলি-বিকুলি করবা সারা রাত। ঘুমাতে পারবা না। আতিক হাসে। ছাত্রাবস্থায় একবার জোড়াসাঁকো গিয়েছিলাম। রবীন্দ্র আবহাওয়া তখনো অস্ত যায় নাই। বাণিজ্য এসে লুট করে নেয় নাই শিল্প-সুষমাকে। বান্ধবী লালীর কাজের সুবাদে ওখানে বেশ গুরুত্ব-টুরুত্ব পেয়েছিলাম। দোতলা না তিনতলার এক ছায়া ছায়া ঠান্ডাঘরে মন কেমন করা পুরোনো গন্ধের ভেতর দেখতে পেয়েছিলাম ঠাকুরদের আঁকা সব মাস্টারপিস। লালী প্রফেশনাল গলায় কী কী যেন বোঝাচ্ছিল। আমার কান সেসব নিচ্ছিল না। বরং অভিভূত হয়ে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকৃত সন্ধ্যার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এ কোন সন্ধ্যা এঁকেছেন গগন ঠাকুর? বিমর্ষ এক সন্ধ্যা। যেন পৃথিবীর সব লেনদেন চুকেবুকে গেছে। মহাপ্রস্থানের সময় হয়ে এসেছে। দূরের বাঁক থেকে কেউ ডাকছে, গগন উঠে এসো। কিন্তু আমাদের মন যে বাঁধা পড়ে আছে ঐ সন্ধ্যার কাছে। পুজোর কাঁসর বাজছে। তুলশিতলায় প্রদীপ জ্বলল বোধ হয়। সন্ধ্যাতারা ফুটি ফুটি করছে(এইসব আনন্দ এইসব বেদনাভরা জগৎ-সংসার ফেলে কী করে যাই বলো অচেনা ঐ পথের ডাকে! আতিক ঐ ম্লান সন্ধ্যার ছবিটাকে আবার দেখতে পেয়েছিল আব্বার শেষ যাত্রার দিন। মনে হতেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। ঐ দিন কী বার ছিল, বিষ্যুদবার কী নয়?
এমনতিইে সুস্থ-সবল দিব্যকান্তি ছিলেন আব্বা। রিটায়ারমেন্টের পরও ভালো ছিলেন। বাগান করতেন, ঘাস নিড়াতেন, ডাল-পালা ছেঁটে দিতেন কামিনী কী রঙ্গন কী করবী কী গন্ধরাজের। বিকেলে নিয়ম করে হাঁটতেন। পুরো এক ঘণ্টা। পাড়ার রিপনের সঙ্গে। ছেলেটা খুব ভালোবাসত আব্বাকে। দুজনে যখন গল্প করতে করতে হাঁটত, তখন মনে হতো দুই প্রাণের দোস্ত। এ ছাড়া প্রতিমাসে শতবর্ষী দাদাকে দেখে আসতেন। দাদার শরীর একটু ভেঙে পড়েছে দাদির মৃত্যুর পর। মসজিদে যাওয়া বন্ধ। টুকটুক করে কেবল বারান্দায় গিয়ে বসেন। কুরআন তেলয়াত করেন, বইপত্র পড়েন। আব্বা সামনে দাঁড়ালে বকা খান। কী রে এত দুর্বল হয়ে গেছিস কেন? দুধ-ডিম খাস্ না, ছোট মাছ, শাকসবজি? বলে সরষের তেল মাখা এক পাথি মুড়ি-গুড় খান। একটু বাদে লাহারি আসবে। জরিনা বেটি চালের রুটি গড়িয়ে আনবে সঙ্গে ঘন দুধের হালুয়া আর পেঁয়াজকলি দেয়া বেগুন ভাজা। আব্বা অন্যমনস্ক হয়ে রুটি ছিঁড়বেন। হালুয়া থেকে কিশমিশ তুলে রাখবেন। দাদার চোখের জ্যোতি তখনো কাবু হয় নাই। দেখতে পাবেন সারা জীবন কর্মের পেছনে ছুটে ছেলেটা ক্লান্ত শেষবেলায়। বলবেন, ৪ ছেলেমেয়ে উপযুক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে তাহলে কিসের এত দুশ্চিন্তা তোর? আমার দিকে তাকিয়ে দ্যাখ। থাকার মধ্যে ছিল তো ঐ ক বিঘা জমি। সেটা থেকেই সব। ৩ মেয়েকে পার করা, তোকে পড়ানো। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও হজে যেতে পারি নাই। কিন্তু তোর কিসের অভাব যে হজে যেতে পারছিস না? আব্বা কোনো উত্তর দেবেন না। কারণ, কেউ জানে না আব্বা ইতিমধ্যে হজের জন্য বেসরকারি এক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। বেশ কিছু অর্থকড়িও দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষে দেখা গেছে, লোকগুলো জোচ্চর। টাকাপয়সা নিয়ে হাওয়া। আব্বা যে কাউকে বলবেন, এটা তার জন্য অস্বস্তিকর বলে চুপচাপ আছেন। আর এরপর থেকেই তাঁর মাথায় কুয়াশা ঢুকতে শুরু করে। তারা তাঁর স্মৃতিসত্তাকে জাপ্টে ধরে, ঠোকরায়, অতীত-বর্তমানের ব্যবধান ভুলিয়ে দেয়। তাই কোনো কোনো দিন ভোরে উঠে নাশতা-টাশতা খেয়ে বাইরে পরার জামা-কাপড় পরে রেডি। এখন সুগন্ধি মাখলেই বেরিয়ে পড়া যাবে। এই সুগন্ধিটা জুয়েল পাঠিয়েছে এডিনবরা থেকে। অথই ওখানে পিএইচডি করছে। ওরা দুজন গ্লাসগো ঘুরে এসেছে, খুঁজে এসেছে আমার ফেলে আসা স্মৃতিগুলোকে। আহা আমার পিতৃবৎ গুরু প্রফেসর ফিসের কথা মনে পড়ল। মাতৃবৎ মেরি ফিসকে মনে পড়ল। কত অন্ন কত নুন খেয়েছি তাঁদের। কিন্তু কেন গিয়েছিলাম রয়েল কলেজে, কেনই বা ওখানে আমার স্মৃতি থাকবে তা মনে পড়ে না। কুয়াশাগুলো সব ভুলিয়ে দেয়। তাই দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ি। আজ ডিপার্টমেন্টে অনেক কাজ। ঢাকা থেকে প্রফেসর কামাল আহমেদ তাঁর বিশেষজ্ঞ টিম নিয়ে আসবেন ঝিনঝিনা রোগের ব্যাপারে সরেজমিনে তদন্ত করতে। তাঁরা মেহেরচণ্ডীকে বেছেছেন স্পট হিসেবে। ওখানে এই রোগে আক্রান্ত অনেক। এবং এরা নিয়মিত খেসারি ডাল খেয়ে থাকে। আব্বা একটু থমকান। খেসারি না অড়হর? অড়হর না খেসারি? মনে পড়ে না। গাড়ি বের করতে গিয়ে দেখি গ্যারেজ খালি। গাড়ি কই? পাবনা ক-৮১১। একাত্তরে পাকিস্তানি আর্মিরা গাড়িটা তুলে নিয়ে গিয়েছিল। নতুন গাড়ির কিছুই ছিল না শুধু ইঞ্জিনটা ধুকধুক করছিল। যেন কাঁদছিল। এই যে আমার চোখেও জল। ছোট ছেলে লাফিয়ে আসে। আব্বা কোথায় যাচ্ছেন? আপনার তো কোথাও যাবার কথা নাই। তারচে পেপার পড়েন। দ্যাখেন চীন থেকে এক মহামারি আসছে। সাবধান হতে হবে সবাইকে। দ্যাখেন, দ্যাখেন। বলে হাতে পেপার ধরিয়ে দিলে আব্বা ঘরে ফিরে ফোন করতে বসেন। নাম্বারটা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। হ্যালো, কে বলছ? তুমি আমার কে হও? অপর প্রান্ত থেকে বড় মেয়ে হাসে, আব্বা আমি আপনার মেয়ে হই। আব্বা নামটা মনে করতে পারেন না। কিন্তু কুয়াশাচ্ছন্ন স্মৃতিতে দুজনকে দেখতে পান। বড় মেয়ে। ছোট মেয়ে। বড়টা জন্মের পর থেকেই খুব শার্প ছিল। ৩ বছর বয়সের কথাও বলে দিতে পারত। আর খুব টকেটিভ। খালি প্রশ্ন আর প্রশ্ন। আমার সেই মেয়েটা নষ্ট হয়ে গেল সাহিত্যের পাল্লায় পড়ে। বড় মেয়ে রিসিভার ধরে বসে থাকে। আব্বাও। কোনো কথা নেই। কখনো কখনো নীরবতার ভেতরেও অনেক কথা থাকে। অনুচ্চারিত। শুধু বুঝে নিতে হয়।
এর মধ্যে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল এসে পড়ে। ডাক্তাররা আলঝেইমার বলে শনাক্ত করেন। লক্ষণগুলোও পুরোপুরি মিলে যায়।
যেমন
ক. আলঝেইমারের অন্যতম লক্ষণ হলো কোনো কিছু মনে রাখতে না পারা বা চিনতে না পারা।
খ. মনের ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে সঠিক শব্দ খুঁজে না পাওয়া।
গ. একই প্রশ্ন বারবার জিজ্ঞেস করা কিংবা একই কথা বহুবার বলা।
ঘ. নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস কোথায় রাখা হয়েছে তা ভুলে যাওয়া বা এক স্থানে রেখে অন্যত্র খোঁজা।
ঙ. পরিচিতদের নাম ভুলে যাওয়া এবং পরিচিত স্থান চিনতে না পারা।
চ. এ ছাড়া সামাজিকভাবে নিজেকে গুটিয়ে ফেলা। অস্বস্তি, ঘুমের সমস্যা, আক্রমণাত্মক হওয়া, বিভ্রান্তি, কিছু চুরি হয়ে গেছে বলে ধারণা করা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।
আতিক দোতলার ঘর ছেড়ে রাতে আব্বার কাছে থাকতে শুরু করে। কেননা আম্মা আর ম্যানেজ করতে পারেন না তাঁকে। আব্বার ২৪ ঘণ্টার রুটিন পুরোটা বদলে যায়। দিনের বেলা ঘুমোন। রাতে জাগেন। দুষ্টু বালকের মতো আচরণ করেন। মধ্যরাতে কখনো মোজাহার চাচা, কখনো লুৎফর চাচা কখনো আনিস চাচাকে ফোন করে ডাকেন, বেলা যে পড়ে এল। চলেন যাই। জুবেরিতে টেনিস খেলে গা গরম করে আসি। কখনো শহীদুল চাচাকে বলেন, ঐ গানটা ধরেন তো। কাঁচা ঘুম ভাঙা চাচা হতভম্ব, কোন গান? আব্বা অবলীলায় বলে ওঠেন, প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন তবু প্রাণ কেন কাঁদেরে...। চাচা আরও হতচকিত। তাহলে আতিক তোমরা কেন বলো ডিমেনশিয়া...। আর আব্বা তক্ষুণি নীচতলার সব লাইট জ্বালিয়ে ধড়ফড় করতে করতে টিভি রুমের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। কেউ একজন পুড়ে যাচ্ছে... লেপের ভেতর... পোড়াগন্ধ পাচ্ছ? আহা বড় কষ্ট পাচ্ছে ছেলেটা... ওকে ডাকো, ডেকে তোলো... নুরুদ্দিন ও নুরুদ্দিন।
মোসতা কাকা আম্মাকে এতক্ষণ ফসলপাতির ফিরিস্তি দিচ্ছিল। ওদের দেখে বলল, এখন তো বেশি বাজে না। চলেন আপনাদের আব্বার জমিগুলান একটু দেখায় লিয়া আসি। কুনুদিন তো এ্যালেন না, খুঁজখবরও রাখলেন না। ছোট বোন বলল, জমিগুলা বরিন্দে না? তাহলে তো আমাদের দেরি হয়ে যাবে। মোসতা কাকা হাসল। আম্মাদের দেখছি লিজের দ্যাশগ্রাম সম্মন্ধে কোনো জ্ঞানই নাই। আরে আপনারা তো বরিন্দেই খাড়িয়া আছেন। বলে ড্রাইভারকে বুঝিয়ে দিল, হামি মটরসাইকেল লিয়া আগাচ্ছি, আপনি পিছে পিছে আসেন। ড্রাইভার একটু গাঁইগুঁই করছিল। এমনিতেই সে শর্টকাট রাস্তা মেরে দিতে দিতে আসছিল এখন আবার ঘুরপথে কত দূর যেতে হবে কে জানে! কিন্তু বড় ভাইকে দেখলাম উত্তেজিত। বড় বোনও। এই দুজনের ছেলেবেলাটা গাঁয়ের আলো-বাতাসেই বেশি কেটেছে। একটু ছুঁতো পেলেই তারা নানাবাড়ি ছুটত। এই যে এখন দেখতে পাচ্ছি কেমন উত্তেজনায় ফুটছে। যেন নামিয়ে দিলেই কাগজের চরকি ঘুরাতে ঘুরাতে দৌড়ে যাবে লোকালয় ধরে। ঐ যে পথের ধারে আনাজপাতি নিয়ে বসে আছে ইন্দির ঠাকরুন। অবিকল আমার দাদিমা কী নানিমা। লোহার ঘুটনিতে পান ছেঁচে মুখে দিয়েছে বলে ঠোঁট দুটো কী লাল কী লাল। সেই রাঙা ঠোঁটে ছড়া কাটছে শুনতে পাচ্ছি, লাথি ঝাঁটা পায়ের তল, ভাত পাথরটা বুকের বল...। সামনে একদল ছাত্র মাথায় লাল টুপি হাতে লাল ঝাণ্ডা নিয়ে মার্চপাস্টের ভঙ্গিতে কোথাও যাচ্ছে। বেশ দেখাচ্ছে। স্কাউট জাম্বুরি-টাম্বুরি আছে নাকি এদিকে, নয়তো এত স্মার্ট ছেলের দল এই শুকনো এলাকায় কেনই বা এমন বীরদর্পে হাঁটবে! নাকি 'খেলাঘর'-এর পাইওনিয়ার একেকজন? উপদ্রুত অঞ্চলে ত্রাণসেবা দিতে চলেছে! ঐ লাল টুপির ওপর বড় দুর্বলতা আমার, বড় বোন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে, ঐ লালটুপি পরব বলে খেলাঘরে যোগ দিয়েছিলাম। সমাজ বদলানোর মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলাম। ফুটু ভাই, প্রশান্ত দা, বাবুল ভাই, হেনাবু...। এই সেদিনও কম্বল, পুরোনো কাপড় সংগ্রহ করেছি শীতার্তদের জন্যে। বানভাসিদের জন্য শুকনো খাবার, ঔষুধপত্তর। ক্যাম্পে থাকা শিশুদের জন্য পড়ার বই, খাতা, রং-পেন্সিল। এই সেদিন...।
বড় বোন কেমন দুঃখিত হয়ে ছেলেদের লাল টুপি মাথা দ্যাখে। এর মধ্যে ঢাকায় একটা নাটক দেখা হলো। কার যেন লেখা, কামাল উদ্দিন নীলু নির্দেশিত 'স্তালিন'। এর মঞ্চ পরিকল্পনা দারুণ। লাউঞ্জ থেকে শুরু হয়েছে এর সজ্জা। লাল কাপড় আর লাল টুপি দিয়ে। আমি কী ঐ দর্শকদের মতো লাল টুপি মাথায় দিয়ে কমরেড সেজে সেলফি তুলব, নাকি মঞ্চে উপস্থাপিত ঐ মদ্যপ মশকরারত লৌহমানবটিকে দেখে বেকুবের মতো হাততালিতে ফেটে পড়ব, যে কিনা আইজেনস্টাইনের সিনেমা দেখে ক্ষিপ্ত হচ্ছেন, টেবিলের ওপর লাফিয়ে উঠে মানুষকে হত্যার নির্দেশ দিচ্ছেন অথবা পাঠিয়ে দিচ্ছেন সাইবেরিয়ার কুখ্যাত কারাগারে। বড় বোন ব্যাটেলশিপ পটেমকিন ভাবা বাদ দিয়ে দস্তয়েভস্কি নিয়ে পড়ল। একদা বছরের পর বছর সাইবেরিয়ার কুখ্যাত কয়েদখানাগুলোয় যাঁকে থাকতে হয়েছিল। কোথাও লিখছেন: এলাকাটা গরমের দিনে প্রচণ্ড গরম, শীতের দিনে নির্মম ঠান্ডা। সিলিং থেকে অনবরত জল পড়ছে। মেঝে আবর্জনা আর জলে পিচ্ছিল। এরই মধ্যে এক একটা ঘরে আমাদের এমন ঠেসেঠুসে রাখা হয়েছিল যেন আমরা বরফ চাপা এক বাকসো হেরিং মাছ। কোথাও মন্তব্য করেছেন,... আমরা খালি পাটাতনের ওপর ঘুমোতাম। বিছানা বলতে খড়ের বালিশ। গায়ে দিয়েছি ভেড়ার চামড়া। সেই খাটো চামড়া পা অব্দি পৌঁছাত না। সারা রাত শীতে ঠকঠক। চারধারে লক্ষ লক্ষ উকুন, ছারপোকা, আরশোলা। বড় বোনের শরীর শিরশির করে। ...তবুও যদি ঘুম হতো। ঘুমের আগে ৩-৪ ঘণ্টা জেগে থাকত সবাই। হৈ-হল্লা, অট্টহাসি, অভিসম্পাত, গালাগালি, মারামারি, অবিশ্রান্ত-অবিরাম শেকলের ঝনঝনাৎ, তামাকের ধোঁয়া, অপরিচ্ছন্ন জামা-কাপড়ের গন্ধ যেন শুয়োরের পাল সারাক্ষণ ঘোঁতঘোঁত করছে।
বড় বোন দেখতে পাচ্ছে ওদের মধ্যে দস্তয়েভস্কি একা। নিঃসঙ্গ। তাঁর সঙ্গে তেমন কেউ মিশতে চাইত না। বিশেষত তাঁর সম্ভ্রান্ত চাল-চলনে ব্রীতশ্রদ্ধ ছিল চাষিরা। কী আমার শিক্ষিত রে! দু-চার পাতা বই পড়ে আমাদের মাথা কিনে নিয়েছে! একজন তো সরাসরি বলে ফেলল, তোমরা বড়লোকেরা আমাদের জমি কেড়ে নিয়েছ, আমাদের শুদ্ধ কিনে নিয়েছ শুধু নয়, তোমরা আমাদের জমিতে আমাদেরকেই ভূমিদাস করে খাটাচ্ছ। আমাদের শ্রমের টাকায় বাবুগিরি করছ আর এখন কেমন মজা দ্যাখো তাদেরই একজন হয়ে কিনা আজ আমাদের সঙ্গে কয়েদ খাটতে এসেছ! এখন খাটো। খেটে মরো। বড় বোন আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সামনের মটরসাইকেলে মোসতা কাকা। পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আব্বার সব জমি ওই করে। এর মধ্যে ৭ বিঘা ওর বাবার কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন আব্বা। ঐ জমিটা খুব সরেস। কোনো বছরই ফলনে ক্লান্তি নাই। তো সেই জমিতে চাষ দিতে দিতে কখনো কী এমনধারা ভাবে মোসতা কাকায়?
দূর এসব আমি কী ভাবছি! বড় বোন নিজের মাথায় টোকা মারে। এসব ভাবনা আসছেই বা কোথা থেকে? এসব তো আমাদের কৈশোর আমাদের তারুণ্যের ভাবনা ঐ যখন চে গেভেরা খুব বুকের কাছে থাকে, কাস্ত্রোর চুরুটের ধিকিধিকি আগুন বুঝিয়ে দেয় মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কথা। আর এরপর তো জীবিকার ধান্ধা, ঘর-সংসারের উচাটন, ব্যাংক-ব্যালেন্স, সঞ্চয়পত্র, প্রভিডেন্ট ফান্ড(এসবের মধ্যে জড়াতে জড়াতে আমরা ভুলে যাই, একদা আমাদেরও স্বপ্ন ছিল সমাজ বদলাবার, আমরাও ভাবতাম সমষ্টির কথা। বড় ভাই বলল, আর কদ্দুর? মোসতা কাকায় তো দেরি করিয়ে দেবে মনে হচ্ছে! আতিক বাইরেটা পর্যবেক্ষণ করে। এখনকার রাস্তাটা লোকালয় ছেড়ে হঠাৎ নেমে পড়েছে অঢেল জমির মাঝখানে। মাটির রাস্তা। দুপাশে কেবল জমি আর জমি। সরষে ফুলের হলুদ, তাল না হয় খেজুরগাছের পাহারা। রোদ ভরা আকাশটা নেমে গেছে ঐ দূরে, যেখানে কুয়াশারা এখনো উড্ডীন। এর মধ্যে কোথায় আমাদের জমি?
আতিক একটু চমকালো। একটু বাদেই এসব জমি ফুফাদের নামে হয়ে যাবে। টাকাপয়সা চলে যাবে আম্মার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। তারপর সেখান থেকে যার যার কাছে। তখন আর আমরা বলতে পারব না এ জমি আমাদের। অবশ্যি এখনো কী বলতে পারছি? বরং আমরা মনে মনে হিসেব কষছি কোন কোন খাতে কীভাবে এ টাকা ব্যয় করব। বড় ভাই তো বলেই দিয়েছে, এ টাকা তার ছোট ছেলের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির পড়ার খরচ হবে। বড় বোনের ঢাকার ফ্ল্যাটের ডিবিএইচ লোন শোধ হয়ে যাবে পুরোটাতেই। ছোট বোন সঞ্চয়পত্র কিনে রাখবে মেয়ের নামে। কেবল আমি জানি না কী করব! বউটা থাকলে নাহয় বলতে পারতাম, তোমার তো বিদেশ ঘোরার শখ অনেক দিনের। চলো ঘুরে আসি আব্বার জমির এ টাকায়। কিন্তু সে তো অন্য এক শহরে নতুন করে বাসা বেঁধেছে। শুনেছি মালদার আদমি। ঢাকার বাসাটা বউয়ের নামে করে দিয়েছে। আর কী চাই?
মোসতা কাকায় ড্রাইভারকে ইশারা করতেই চিকন রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল মাইক্রো। দুটো যমজ খেজুরগাছ গোড়ায় বেশ কিছু ঝোপঝাড় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গলায় ঝুলছে তাদের রসের হাঁড়ি। তাল চড়ুইয়ের ঝাঁক উড়ছে মাথার ওপর। শ্যালো মেশিনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে ভটভট। ভটভট। জলগন্ধ বাতাস। দূরে সাঁওতাল মেয়েরা কী এক গান করতে করতে কাদাটে জমিতে কচি ধানগাছ রোপণ করছে। মোসতা কাকা বলল, এই মাথা থেকে যদ্দুর চোখ যায় দ্যাখেন আব্বা-আম্মারা। এগুলান সব আপনারঘে জমি। আমরা তাকালাম। সকাল নটার রোদে শীত অনেকটা মিইয়ে এসেছে। হালকা ভাপ লাগছে গায়ে। দূরের তালগাছটা ডাকল যেন, এই যে। এই যে। তাকাও এদিকে। আমরা আবার দৃষ্টি বিছালাম চতুর্দিকে। কী বিস্তির্ণ চরাচর। প্রকৃতি উপুড় হয়ে শুয়ে আছে এখানে। শুষে নিচ্ছে পৃথিবীর সব রং-রূপ-রস। আর কী শান্তি। যেন কোথাও কোনও হানাহানি নাই, কাটাকাটি নাই, ঝগড়া নাই, বিবাদ নাই, যুদ্ধ নাই, মহামারি নাই, অত্যাচার নাই, নিপীড়ন নাই, স্বার্থ নাই, স্বার্থপরতা নাই... এমন এক নিটোল পৃথিবী সামনে।
—আপনারঘে আব্বায় এখানে এসে খাড়িয়া থাকতেন। প্রায়ই। বলতাম, কী এত দ্যাখেন ভাই?
—ও তুই বুঝবি না। আমার ছেলেমেয়েরাও বুঝবে না। বলে আব্বা ফের তাকাতেন ফসল ভারানত পৃথিবীর দিকে। বুক ভরে শ্বাস নিতেন। কান পেতে শুনতে চাইতেন যেন পিতৃ-পিতামহের সেই চিরচেনা ডাক, ভাই হে...। কত কত পথ পরিক্রমা শেষে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে মানুষ। লাঙ্গল-গরুর বদলে যন্ত্র। তবু ধান রুইতে এখনো মানুষের হাত লাগে। ঐ যে কোমর বাঁকিয়ে সাঁওতাল মেয়েরা সারিবদ্ধ ধান রুইছে, গাইছে ঝুমুর তালের কোনো গান। আমাদের শেকড়ে টান পড়ে। মৌমাছির গুঞ্জরণের মতো সেই সুর কানের ভেতর ঢুকে যায়। রোদে ভেজা কুয়াশারা মাথা খুবলে খায়। আম্মা হু হু করে কেঁদে ওঠেন এ সময়। আমরাও একে অপরের দিকে ভেজা চোখে তাকাই। আব্বা কী দেখতেন এই বিশাল চরাচরে? ঐ একাকী তালগাছ দেখে কী ভাবতেন? একটা সময় ছিল যখন আমরা আব্বা-আম্মার চোখের ভাষা পড়তে পারতাম, কণ্ঠস্বরের ওঠানামায় বুঝতে পারতাম তাঁদের মনের গতি-প্রকৃতি। এরপর বড় হতে হতে কত সহস্র দিন কত সহস্র রাত পেরিয়ে গেছে, ঐ ভাষা আর পড়িনি (ভালো করে দেখিনি তাঁদের চশমার আড়ালের ঐ ক্ষয়িত দৃষ্টি। আজ (এই মুহূর্তে হঠাৎ আবার নতুন করে জানতে ইচ্ছে করল তাঁদের। নতুন করে ভাবতে ইচ্ছে করল। ক্রন্দনরত আম্মাকে ঘিরে ধরে আমরা ৪ ভাইবোন অতঃপর আবার তাকালাম দূরের তালগাছটার দিকে। উড্ডীন কুয়াশার দিকে। ঝুমুর তালের সাঁওতাল মেয়েদের দিকে। আমরা পথ ভুলে চলে গিয়েছিলাম অনেক দূর।
আজ ফেরার পালা।